হতাশা থেকেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন সাদি ভাই: ফারুক আহমেদ
হঠাৎই গতকাল বুধবার সাদি মহম্মদের মৃত্যুর কথা শুনে ভেঙে পরেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তাঁরা ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁদের মধ্য ছিল পারিবারিক বন্ধন। প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কথা শুনে ছুটে গিয়েছিলেন সাদি মহম্মদকে দেখতে। সাদি মহম্মদের প্রয়াণ ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এল অভিনেতা ফারুক আহমেদের কথায়।
ফারুক আহমেদ জানান, সর্বশেষ তাঁদের বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখা হয়। সেই সময় তাঁদের অতীতের নানা প্রসঙ্গে কথা হয়। মজার ছলে সেদিন সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, ‘তোমাকে হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় দেখতাম, সেই তুমি কত বড় হয়ে গেছো। নাম করেছ অভিনয়ে।’ তখন ফারুক আহমেদও জানান, গান নিয়ে সাদি মহম্মদের দেশজুড়ে সাফল্যের কথা।
‘তিনি ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। সেই হিসেবে আমাকে সব সময় স্নেহ করতেন। পছন্দ করতেন। আমাদের যেকোনো আনুষ্ঠানিকতায় সাদি ভাই থাকতেন। অমায়িক ব্যবহার। কিন্তু মানুষটা হঠাৎই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তার পর থেকেই সাদি ভাই এতটা একা হয়ে পড়েছিলেন, সেটা কেউই বুঝতে পারেনি,’ বলেন ফারুক আহমেদ।
গত বছর থেকে অনেকটাই অন্তরালে ছিলেন সাদি মহম্মদ। সংগীতাঙ্গনেও ছিলেন অনিয়মিত। ফারুক আহমেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কখনোই তিনি ভুলতে পারেনিন। এর মধ্যেই জীবন চালিয়ে নিয়েছেন। পরে দুই বছর আগেও সাদি মহম্মদকে অনেকটাই উৎফুল্ল অবস্থায় দেখেছিলেন। তখনো সাদি মহম্মদ অনেক কথা বলতেন। পারিবারিক আড্ডায় গান করতেন। গান নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। কিন্তু গত বছর এই গায়কের মায়ের মৃত্যু হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সাদি।
এ প্রসঙ্গে ফারুক আহমেদ বলেন, ‘গত বছর সাদি ভাইয়ের মা মারা যান। তার পর থেকেই তিনি ভেঙে পড়েন। মায়ের জন্য শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। যত দূর জানতাম, বাসায় সাদি ভাইয়ের বেশির ভাগ সময় কাটত মায়ের সঙ্গে। মা না থাকায় তিনি অনেকটাই একা থাকতেন। এই সময়ে তাঁকে একাকিত্ব পেয়ে বসে। তিনি খুব বেশি বাইরেও বের হতেন না। দিন দিন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলেন। জানতে পারলাম, হতাশা থেকেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন, সাদি ভাই।’
সাদি মহম্মদসহ সব ভাইবোন শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শৈশবেই তাঁরা বাবাকে হারিয়েছেন। ১৯৭১ সালের এক শুক্রবার মসজিদ থেকে বাসায় ফিরছিলেন তাঁর বাবা সলিমুল্লাহ। সেদিনই বাসার সিঁড়িতে বিহারিরা তাঁকে খুন করেন। সেই সময় সন্তানদের নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন সাদি মহম্মদের মা। সন্তানেরা তখন সবাই স্কুলশিক্ষার্থী। উপার্জনকারী কেউ ছিলেন না। পরে দেশ স্বাধীন হয়। তাঁদের বাবার নামে শহীদ সলিমুল্লাহ সড়কের নামকরণ হয়। কিন্তু সহজেই অবস্থা আর ফেরে না এই পরিবারের। নানা সময় ঘটনাগুলো কখনো সাদি, কখনো শিবলী মহম্মদের কথায় উঠে এসেছে।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সাদি মহম্মদ আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে পড়াশোনা করতেন। আমার বাবার ছাত্র। একই স্কুলে আমরা পড়াশোনা করেছি। সাদি ভাইয়ের বোনেরাও একই স্কুলে পড়তেন। সবার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সখ্য ছিল। সাদি ভাই ৭২-এ মেট্রিক পাস করেন। আমরা ৭৫-এ। তখন অনেক স্ট্রাগল করেছেন সাদি ভাইয়ের মা। এমন দিনও গেছে, আন্টিকে জামাকাপড় বানিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন,‘শিশু বয়সে মায়ের এমন সংগ্রাম দেখায় মায়ের প্রতি তাঁদের অন্য রকম ভালোবাসা জন্মে। পরবর্তী সময় যখন সব ভাইবোন প্রতিষ্ঠিত হলেন, তখনো একই রকম ভালোবাসা ছিল মায়ের জন্য। কিন্তু সাদি ভাই একাকী জীবন পার করায়, মায়ের সেবাযত্ন করার সুযোগটা বেশি পেয়েছেন। পরে মায়ের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেন নাই। সবকিছু থেকেই দূরে চলে যান। অনেকটা একাকী থাকতে হতো বাসায়। যে কারণেই হতাশ হয়ে পড়েন।’
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মারা গিয়েছেন সাদি মহম্মদ। এই গায়কের ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ প্রথম আলোকে জানান, গতকাল তানপুরা নিয়ে সংগীতচর্চা করছিলেন তিনি। সন্ধ্যার পর হঠাৎ ঘরের দরজা বন্ধ দেখেন। কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, শিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত।