শাহ আবদুল করিমের গানকে ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দিল ভারতের টি সিরিজ
শাহ আবদুল করিমের পরিবারের অনুমতি ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে তাঁর গান পরিবেশন করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামিয়েছে ভারতের শীর্ষ দুই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সারেগামা এবং টি সিরিজ। এমনকি ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের স্রষ্টা করিমের নামও নেওয়া হয়নি, গানটিকে ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দিয়েছে টি সিরিজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৬ সালে করিমের ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’, ২০০৭ সালে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ ও ‘গান গাই আমার’ রেকর্ড করেছে সারেগামা। ২০১২ সালে ‘আমি তোমার কলের গাড়ি’ প্রকাশ করেছে টি সিরিজ; গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সারেগামা কিংবা টি সিরিজ—কোনো প্রতিষ্ঠানই করিম কিংবা করিমের পরিবারের অনুমতি নেয়নি।
টি সিরিজ ও সারেগামা আমাদের অনুমতি ছাড়াই গান করেছে; এমনকি টি সিরিজ বাবার নামও দেয়নি।শাহ নূর জালাল, বাউলশিল্পী ও শাহ আবদুল করিমের ছেলে
করিমের গানকে ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে করিমের পরিবার। ১ অক্টোবর বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে টি সিরিজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন করিমের ছেলে বাউলশিল্পী শাহ নূর জালাল। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর সারেগামার বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেন তিনি।
সারেগামা ও টি সিরিজের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন শাহ নূর জালাল। গতকাল সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টি সিরিজ ও সারেগামা আমাদের অনুমতি ছাড়াই গান করেছে; এমনকি টি সিরিজ বাবার নামও দেয়নি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুর পর ২০১০ সালে ৪ নভেম্বর ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানের কপিরাইট করান শাহ নূর জালাল। কপিরাইট সনদ নম্বর ১২০৯৪। করিমের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর সংগীতকর্মের স্বত্বাধিকার পেয়েছেন নূর জালাল।
স্বত্বাধিকারের অনুমতি ছাড়া সারেগামা ও টি সিরিজের গান প্রচারকে ‘ভয়ংকর অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের সাবেক রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী। তাঁর ভাষ্যে, শাহ আবদুল করিমের নামে গানটির মেধাস্বত্ব নিবন্ধন করা আছে। এটিকে মনগড়াভাবে ‘প্রচলিত’ লিখে দিলে তো হবে না।
কপিরাইট আইন অনুসারে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’সহ আবদুল করিমের যেকোনো গান বাণিজ্যিকভাবে প্রচারের আগে স্বত্বাধিকার শাহ নূর জালালের অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় তা কপিরাইট আইনের ৭১ ধারার লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
শাহ আবদুল করিমের নামে গানটির মেধাস্বত্ব নিবন্ধন করা আছে। এটিকে মনগড়াভাবে ‘প্রচলিত’ লিখে দিলে তো হবে না।জাফর রাজা চৌধুরী, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের সাবেক রেজিস্ট্রার
লোকসংগীত মানেই ‘প্রচলিত’ নয়
১৯৭৬ সালে গ্রাম সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলে বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে গ্রাম সরকারে প্রচারণার অংশ হিসেবে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ রচনা করেন শাহ আবদুল করিম। নিজেই সুরারোপ করে গানটি পরিবেশন করেন তিনি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে লন্ডনেও গানটি করেছেন করিম। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত শাহ আবদুল করিমের ‘কালনীর ঢেউ’ বইয়ে গানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই বইয়ের সব গানের কপিরাইট করেছে তাঁর পরিবার।
জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘এটা যে শাহ আবদুল করিমের গান, সেটা আর প্রমাণের দরকার নেই। গানের মধ্যে শাহ আবদুল করিমের নাম আছে। জীবদ্দশায় দশকের পর দশক ধরে গানটি করেছেন তিনি।’
লোকগান পরিবেশনের সময় আমরা কোনো গবেষণাই করি না, দুম করে “প্রচলিত” লিখে দিই। মান্না দে, লতা মঙ্গেশকরের গানকে প্রচলিত লিখি না। কিন্তু লোকসংগীতকে প্রচলিত লিখি। মানে, লোকসংগীত অনাথ, বাবা-মা নেই। লোকসংগীত পরিবেশনের আগে গানটি কার, তা খোঁজ নেওয়া উচিত।পৌষালী ব্যানার্জি, কলকাতার লোকসংগীতশিল্পী
শুধু শাহ আবদুল করিমই নন, লালন, রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজার গানও হামেশাই ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা কিংবা কলকাতা—দুই শহরের শিল্পীদের মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা যায়। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানকে ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দেওয়া নিয়ে কলকাতার লোকসংগীতশিল্পী পৌষালী ব্যানার্জি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলছেন, বিষয়টি তাঁরও নজরে এসেছে, এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
পৌষালীর ভাষ্যে, ‘লোকগান পরিবেশনের সময় আমরা কোনো গবেষণাই করি না, দুম করে “প্রচলিত” লিখে দিই। মান্না দে, লতা মঙ্গেশকরের গানকে প্রচলিত লিখি না। কিন্তু লোকসংগীতকে প্রচলিত লিখি। মানে, লোকসংগীত অনাথ, বাবা-মা নেই। লোকসংগীত পরিবেশনের আগে গানটি কার, তা খোঁজ নেওয়া উচিত।’
রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা ও শাহ আবদুল করিমের গান নিয়মিত চর্চা করেন পৌষালী; কোনো গানের সুরকার ও গীতিকারের নাম না জানলে বাংলাদেশের গবেষকদের সহযোগিতা নেন বলেও জানান তিনি।
গা করছে না টি সিরিজ
টি সিরিজকে ভারতের সবচেয়ে বড় রেকর্ড লেবেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চার দশক ধরে হিন্দি গান করছে টি সিরিজ, বছরখানেক ধরে বাংলা গানও প্রকাশ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
টি সিরিজের ব্যানারে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ভারতের তরুণ গায়ক গুরুজিৎ সিং। তিনি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানটি মুম্বাই থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, প্রকাশের পর দেখলাম, শাহ আবদুল করিমের নাম নেই। সঙ্গে সঙ্গে টি সিরিজকে জানিয়েছি। আজও জানালাম, তবু নাম যোগ করা হয়নি।’
বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছেন গুরুজিৎ সিং, গানটিকে ‘প্রচলিত’ বলে চালিয়ে দেওয়ায় তিনি নিজেও বিব্রত হয়েছেন বলে জানান। ঢাকা ও সিলেটেও গান করে গেছেন এই শিল্পী।
বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর তরফ থেকে টি সিরিজের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা বরুণ অরোরাকে গতকাল সোমবার ই-মেইল করা হয়েছে, তবে তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
বক্তব্য জানতে ভারতের সবচেয়ে পুরোনো রেকর্ড লেবেলের মধ্যে অন্যতম সারেগামাকেও ই–মেইল করা হয়েছে, তাঁরাও সাড়া দেননি।
১৯৫২ সাল থেকে কপিরাইট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশন’-এর আওতায় বৈশ্বিকভাবে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা হয়। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত স্বাক্ষর করেছে। ফলে শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস ভারতের কপিরাইট অফিসে অভিযোগ জানাতে পারবে।
এখন কী উপায়
দেশে কোনো ব্যক্তি কিংবা কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। দেশের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করলে কী করণীয়?
জাফর রাজা চৌধুরী বলছেন, ১৯৫২ সাল থেকে কপিরাইট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশন’-এর আওতায় বৈশ্বিকভাবে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা হয়। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত স্বাক্ষর করেছে। ফলে শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস ভারতের কপিরাইট অফিসে অভিযোগ জানাতে পারবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভারতের কপিরাইট অফিস অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা (ক্ষতিপূরণ আদায়) নিতে পারবে।
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস ভারতের কপিরাইট অফিসে অভিযোগ না করে বিকল্প উপায়ে হেঁটেছে। কালেকটিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশনের (সিএমও) তালিকাভুক্ত সংগঠনের মাধ্যমেও এই ধরনের জটিলতার সুরাহা করা যায়। দেশে সিএমওর প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি (বিএলসিপিএস)।
বিএলসিপিএসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হামিন আহমেদ গত সোমবার প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস থেকে শাহ আবদুল করিমের পরিবারের অভিযোগটি তাঁরা পেয়েছেন। সেটি ইতিমধ্যে ভারতের সিএমও সংগঠন আইপিআরএস, টি সিরিজ ও সারেগামাকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জাফর রাজা চৌধুরী বলছেন, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস সরাসরি ভারতের কপিরাইট অফিসে অভিযোগ জানালে দ্রুত সুরাহা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।