‘জোনাক জ্বলে’ তৈরির পেছনের গল্প জানতে চাই।
হাবিব ওয়াহিদ : এ বিষয়ে বলতে গেলে কোভিডের সময়কে ধরে বলতে হবে। কোভিডে সারা দুনিয়া প্রায় বন্ধ ছিল। আমার কাছে মনে হয় কোভিডের সময়টাতে একেকজন একেকভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। যেটি আমার বেলাতেও হয়েছে। সে সময় ঘরে বসে কাজ করতে গিয়ে সেই শুরুর দিনের ফিল পাচ্ছিলাম। তখন গানে ভিন্নতা তৈরির একটা তাগিদ পেয়েছিলাম। যার প্রভাব এ গানটিতে পড়েছে। গানের গীতিকার জিকো ভাই ভালো লেখেন। একদিন আড্ডা দিতে দিতে তাঁর কাছ থেকে গানের কথাগুলো পাই। কথাগুলোর মধ্যে সুখ, দুঃখ, বেদনার গভীরতা আছে। মনে হয়েছিল একটি স্যাড-রোমান্টিক মিউজিক তৈরি করা যাবে; যে ধরনের গান আমার আর ন্যান্সির কণ্ঠে শ্রোতার মধ্যে একটা মুড তৈরি করে। সেই ভাবনা থেকেই ন্যান্সির সঙ্গে করে গানটি তৈরি করলাম। এরপর মিউজিক ভিডিওর পালা। ২০১৫ সালে ‘হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা’সহ বেশ কয়েকটি গানের ভিডিও পরিচালনা করেছেন তামিম রহমান অংশু। আমার গানের গল্পের দৃশ্যায়ন খুবই ভালোভাবে ভিডিওতে তুলে আনতে পারেন তিনি। গানের ভাবনাটা ধরতে পারেন। তাঁর সঙ্গে পরিকল্পনা করে ভিডিও তৈরি হয়ে গেল।
প্রথম আলো :
গানটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা?
হাবিব ওয়াহিদ : আমার করা প্রতিটি গানই আমার সন্তান। সব গান নিয়ে আমার প্রত্যাশা থাকে। এ গানটিও ব্যতিক্রম নয়। তবে গানটিতে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। কোভিডের সময়ে গান তৈরির আমার অভিজ্ঞতা গানে প্রতিফলিত হয়েছে। তা ছাড়া গানটিতে নারীকণ্ঠের অংশটিতে ভিন্নতা বেশি। ন্যান্সির গাওয়া কথাগুলো শুনতে আলাদা একটা ধাক্কা আসে। সংগীতায়োজনের সঙ্গে গানটির ওই অংশটিতে ভিডিওতে আলাদা গল্প তৈরি হয়। যেটি দর্শক দেখতে বসেই বুঝতে পারবেন। তা ছাড়া গানটির কথা ও আবহের সঙ্গে মিল রেখে বান্দরবানের পাহাড়সহ বিভিন্ন লোকেশন ব্যবহার করা হয়েছে। ন্যান্সির কারণে গানটি বেশি ফুটে উঠেছে।
সেই ২০০৬ সালে আপনার সুর-সংগীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যান্সির গানে অভিষেক হয়। এত দীর্ঘ সময় পেরিয়েও এখনো এই জুটির দর্শক চাহিদা রয়ে গেছে। এর রহস্য কী?
হাবিব ওয়াহিদ : এটি আমার কাছেও বিস্ময়কর মনে হয়। এখনো ন্যান্সির সঙ্গে গান করার অনেক অনুরোধ আসে। ন্যান্সির সঙ্গে আমার স্যাড গান একটা ভিন্নতা তৈরি করে। তবে ওর সঙ্গে আমার রোমান্টিক গান সংখ্যায় বেশি। হিসাব করে দেখলে দেখা যাবে, ন্যান্সির সঙ্গে আমার খুব কম গান হয়েছে। গত প্রায় ২০ বছরে মনে হয় গুনে গুনে দুজনের ২০টি গানও হয়নি। অথচ দর্শকের যে চাহিদা তাতে এই দীর্ঘ সময়টাতে আমাদের দুজনের দুই শ গান থাকার কথা ছিল। এ জন্য মাঝেমধ্যে অবাকও লাগে। এত কম গান তারপরও এত দিন ধরে শ্রোতা-দর্শকেরা আমাদের জুটিকে কে স্মরণ করেন, মনে রেখেছেন! তবে এ বিষয়টি আমাকে উৎসাহিত করে। মাঝেমধ্যে আমি ও ন্যান্সি স্টেজ শো করি। সেখানে একটা পর্ব রাখি দুজনের ডুয়েট গানের। কিন্তু আধা ঘণ্টা গাওয়ার পর দুজনের বেশি গান খুঁজে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, দুজনের এত আগের গানগুলো আগের প্রজন্ম, চলতি প্রজন্মের অনেকেই এখনো আবেগ দিয়ে শোনেন। ফলে গানগুলোর আবেদনটা রয়েই গেছে। এ কারণে দুজনের নতুন নতুন গান এখনো চান তাঁরা। আর এটিই আমার জন্য প্রেরণার। এ গানটি দিয়ে দর্শকেরা দুজনকে নতুন করে পাবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ, ন্যান্সির সঙ্গে সব সময়ই নতুন কিছু আলাদাভাবেই হয়। ভবিষ্যতেও সেটি হবে।
বেশ কয়েক বছর ধরে সিনেমার গান বেশ আলোচিত। কিন্তু অডিও গান সেইভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না কেন?
হাবিব ওয়াহিদ : অডিও গান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না, এটি যে পুরোপুরি সঠিক, তা নয়। এরই মধ্যে মুজা, জেফারসহ বেশ কিছু শিল্পীর গান শ্রোতাদের মধ্যে চর্চা হচ্ছে। তা ছাড়া কোক স্টুডিওর গানও তো শ্রোতা-দর্শক শুনছেন। অডিও গানের সঙ্গে ভিডিওর ব্যাপারটা সঠিকভাবে হতে হবে। যেটি এ সময়ে অডিও গানের ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বলতা আছে। অথচ ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দারুণ জমজমাট ছিল অডিও গান। ওই সময়টাতে বিভিন্ন শিল্পীর সব দারুণ দারুণ ভিডিও গান দেশের আনাচকানাচে পৌঁছেছে। আবার সব সিনেমার গানই যে এখন সমানভাবে দর্শক নিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। সবকিছুর একটা ম্যাটার অব কমিউনিকেশন লাগে। সিনেমার গান বা অডিওতে সঠিক উপাদান থাকতে হবে। সেটি হলে উভয় সেক্টরেই ভালো করা সম্ভব।
প্রথম আলো :
একসময় নিয়মিতই সিনেমার গান করতেন। ‘হৃদয়ের কথা’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘প্রজাপতি’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’সহ অনেক ছবির জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। এখন সেভাবে কাজ করেন না কেন?
হাবিব ওয়াহিদ : আমি যখন শুরু করি সেই সময় থেকে টানা একটা সময় পর্যন্ত সিনেমার গানের জোয়ার ছিল। কিন্তু মাঝে একটা সময় এসে সিনেমার সেই জোয়ারটা থেমে যায়। সিনেমার অবস্থা কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই সুদিন আবার ফিরে আসছে। দেড়-দুই বছর ধরে সেই জোয়ার লক্ষ করছি। সেই জায়গা থেকে সিনেমার কোনো ভালো প্রজেক্ট পেলে কাজ করব। মাঝের সময়টাতে আমাকে সিনেমার কাজে টানে নাই। টানতে হলে তো ওই জিনিসের ওপর বিশ্বাস থাকতে হয়। একটি গান আমি কষ্ট করে তৈরি করব, সেটি সবার কাছে পৌঁছাবে, সেই বিশ্বাস মাঝের সময়টিতে পাইনি আমি।
প্রথম আলো :
সম্প্রতি আপনার ছেলে আলীম ওয়াহিদকে মঞ্চে ড্রাম বাজাতে দেখা গেছে। সেই মঞ্চে আপনি ও আপনার বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদও উপস্থিত ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
হাবিব ওয়াহিদ : আলীম নিজে নিজেই শেখে। আমি যেমন আবার বাবাকে দেখে উৎসাহিত, ও হয়তো আমাকে দেখে উৎসাহিত। আমার যত শো হয়, সব শোতেই ও যায়। যেতে যেতে টিম মেম্বারের মতোই হয়ে গেছে। শোতে যখন সাউন্ড চেক করা হয়, ওই সময় ও খুব মজা করে ড্রামটা বাজায়। আমি কখনোই ওকে বাজানোর ব্যাপারে কিছু বলি না। ও স্বাভাবিকভাবে কতটুকু পারে, সেটাই দেখতে চাই আমি। আমি তো ওভাবেই শিখেছি। তাই ভাবি, ও যদি মিউজিকে জড়াতে চায়, ওভাবেই শিখবে। ওর ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেব না। আর ওই ভিডিওটি ছিল আমার ছেলের স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের। ও তো এখনো পাকাপোক্ত বাজায় না। কোনো পেশাদার শোতে তাকে ওঠাই না। ওই অনুষ্ঠান স্কুলেরই ছিল। একেবারেই উপযুক্তভাবে না বাজাতে পারলেও স্কুলের ছাত্র হিসেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির ব্যাপার ছিল। এ কারণেই সে বাজিয়েছে। তবে আমরা তিন প্রজন্ম একসঙ্গে স্টেজে গান করেছি, এটি আমাদের জন্য গর্বের।