কেন ওস্তাদ রশিদ খান আমাদের প্রিয়
কারও কাছে পৌঁছাতে হলে নিজেকেও এগিয়ে যেতে হয়। সে পথ কতখানি দীর্ঘ, তা নির্ভর করে মানুষটির অবস্থানের ওপর। পথের মাপের দৈর্ঘ্য মাপা যায়, কিন্তু তা যদি হয় ‘সুর’, কীভাবে বোঝাবেন শ্রোতা? অনুভবই একমাত্র মাপকাঠি।
মঙ্গলবার অন্যলোকে চলে গেলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম একজন কালাকার ওস্তাদ রশিদ খান। সুরের শ্রোতারা বিষাদে ডুবলেন। সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেছে এ খবরে। এর মধ্যেও আবার আলোচনা-সমালোচনাও আছে পদ্মশ্রী ভূষিত রশিদ খানের গায়কির দক্ষতার মাপ নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন তিনি ঠিক সেই মাপের নন, যেমনটা ছিলেন আল্লাদিয়া খাঁ, ওস্তাদ আমির খাঁ, বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে অথবা বড়ে গুলাম আলীর মতো কালাকাররা। সংখ্যায় গুটিকয় সমালোচক, তবে তাঁদের কথা মনে রেখেই ওস্তাদ রশিদ খানের স্মরণে দুটি কথা বলতে ইচ্ছে হলো।
কেন রশিদ খান আমাদের কাছে প্রিয়? কেন রশিদের সুর স্পর্শ করে? রশিদ খানের কণ্ঠের গুণের সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার ছিল। তিনি জানতেন শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে হলে শিল্পীর নিজেকে শ্রোতার মন বুঝতে হয়। মন বুঝতে হলে শিল্পীর নিজেকে আরও অনেকটা পথ বেশি হাঁটতে হয়। এই যে তিনি শ্রোতার মনের কদর করলেন, সেখানেই উতরে গেলেন রশিদ। তবে জাত কালাকারের কৌশলও কম থাকে না।
তাই দীর্ঘ তালের প্রলম্বিত সুরের যে শাস্ত্রীয় সংগীত আমাদের মতো আটপৌরে শ্রোতার কানে বড্ড বেশি দীর্ঘ মনে হতো, ধৈর্য চ্যুতি ঘটাত এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করত, সেই সংগীতকেই আমাদের কাছে প্রিয় করে তুললেন ওস্তাদ রশিদ খান। ঠিক সেই কৌশলটিই তিনি প্রয়োগ করলেন, যাতে শ্রোতার হৃদয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে আগ্রহও হলো আবার তাঁর নিজের ঘরানার সুরকে তিনি স্থায়ীও করতে পারলেন।
সুর কতখানি প্রভাবিত করতে পারে, এ প্রসঙ্গে আরেকটি গল্প মনে পড়ল। সম্ভবত এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিনপঞ্জিতে পড়া। গত শতকের মাঝামাঝিতে এলাহাবাদে এক আসরের কথা।
মাহফিলের বাদশাহ ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর আসর বসেছে এলাহাবাদে। তিনি যখন মঞ্চে উঠলেন তখন রাত বাজে একটা বা তার একটু আগে। উঠে ধরলেন ভৈরবী (ভোরবেলার সুরের জন্য পরিচিত) সুর। একেবারে অসময়ের সুর ধরতে সবাই একটু অবাক। দু–একজন ইঁচড়ে পাকা আবার বলেও বসল, ওস্তাদজি আভি তো ওয়াক্ত বাকি, আভি আভি ভৈরবিকা টান লাগায়া। কলকাতা থেকে তখন একদল তরুণ ছাত্রও গিয়েছিলেন সে গান শুনতে এলাহাবাদের আসরে। সকলে একটু উসখুস করল তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের সুরে মন লেগে গেল।
তন্ময় হয়ে ভৈরবী শুনতে শুনতে দেখল চোখের সামনে আলো বদলে গেল, ভোর হতে শুরু করল, এমনকি কেউ কেউ পাখির ডাকও শুনল। ফৈয়াজ খাঁ ঘণ্টা দুই গেয়েই শেষ করলেন। সকলেই বলল, এই না হলে ওস্তাদ লোক। গাইতে গাইতে ভোর আনলেন, আলো জাগালেন। ওস্তাদের গান শেষ হলে সকলে একটু আড়মোড়া দিয়েও বসলেন, যেন ভোরে জাগলেন সবে।
কিন্তু হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ ভাবলেন, তাঁর ঘড়িতে দম দেওয়া হয়নি। কেউ ভাবলেন, ঘুমের ঘোরে ভুল দেখেছে। এখন কেমন করে রাত মাত্র সাড়ে তিনটা বাজে? এতক্ষণ যে মনে হলো ভোর হয়ে গিয়েছে। তখন শ্রোতাদের বোকা বোকা মুখ দেখে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ হাসলেন এবং কণ্ঠে গমক এনে বললেন, ‘ওস্তাদ লোক সময়ের পরোয়া করে সুর বাঁধে না, সময় তাদের সুরের কাছে এসে ধরা দেয়’।
রশিদ খান নিজের রেওয়াজ করা নিয়ে বলেছিলেন, আমি ঘড়ি ধরে রেওয়াজ করি না। যতক্ষণ ঠিকঠাক না হচ্ছে, ততক্ষণ চলে। ৫ ঘণ্টাও হয়, আবার ১০ ঘণ্টাও হতে পারে।
এবার তাহলে ঢাকা শহরের এক আসর নিয়ে দুটি কথা বলি। এক যুগেরও বেশি সময় আগের কথা। ঢাকার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে গাইতে আসছেন রশিদ খান। তখন ৫ হাজার টাকা দিয়ে (সবচেয়ে কম দামের টিকিট) একটি টিকিট কাটা কল্পনাতীত, এই কম বোঝা সংগীত মূর্খ শ্রোতার জন্য। কিন্তু রশিদ খানের নাম শুনে আগ্রহটা আকাশসমান। বুঝি আর না বুঝি অন্তত টেবিল চাপড়ে বলা যাবে আমি তার লাইভ কনসার্ট শুনেছি। এই যেমন এখন এত বছর পর লিখছি আরকি। তো রশিদ খানের গানের আসরের একটি টিকিট বহু চেষ্টার পর জোগাড় হলো।
আসর শুরু হলো শীতের রাতে একটু দেরিতেই। এত ৮০ বছর আগের এলাহাবাদের মাহফিল নয়, এ হচ্ছে ঢাকা শহরের এক গানের আসর। তা–ও আবার মূর্খ শ্রোতাদের জন্য শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর একরকম যন্ত্রণারও বটে। কিন্তু সে যন্ত্রণা সুখে পরিণত হলো ওস্তাদ মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। যেন বাড়ির পাশের মন্টু মামা এসেছেন আমাদের মামুলি বাগানে বসে একটু রেওয়াজ করতে।
পান মুখে গুঁজে দিয়ে একটু ভিন্ন উচ্চারণের বাংলা ভাষাতেই তিনি শুরু করলেন বৈঠক। এ আলাপ, সে আলাপ জানতে চাইছেন। সামনে বসা শ্রোতার কোনো ইচ্ছা আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু ধারেকাছে গেলেন না সুরের। মঞ্চে উপস্থিত যন্ত্রীদের নিয়ে কথা শুরু করলেন।
রশিদ খানের দীর্ঘদিনের যুগলবন্দী শিল্পী জ্যোতি গোহা হারমোনিয়ামে সংগত করেছিলেন কি না, এখন আর মনে নেই। তখন সবাইকে চেনার মতো এলেমও ছিল না। কিন্তু এটুকু মনে আছে, মঞ্চে তিনি পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে শুধু নাম নয়, কোন যন্ত্রীর হাতে কোন সুর ভালো আসে, সেসব কথাও বলছিলেন। কালক্ষেপণ মনে করে তখন বিরক্ত হয়েছি। এক যুগ পর অনুভব করি, শিল্প মানেই এক সমবেত প্রচেষ্টা। শিল্পী কখনো একা শিল্পী নন। সমষ্টিগত প্রচেষ্টাতে একজন শিল্পী হয়ে ওঠেন ওস্তাদ কিংবা ‘মায়েস্ত্রো’। সে কথা স্মরণ করেই রশিদ খান সবসময় মূল্য দিতেন তাঁর চারপাশের সবাইকে।
এরপর যখন তাঁর সুর পর্দায় লাগল, শ্রোতারা বুঝেছিল শাস্ত্রীয় সংগীতকে শিল্পী আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে এসেছেন। কেবলমাত্র নিজের ঘরানার আটকে রেখে শাস্ত্রীয় সংগীতকে শুধু উঁচু বোদ্ধাদের জন্য শিকেয় তুলে রাখতে রাজি না এ শিল্পী। এরপর মন্ত্রমুগ্ধ নীরবতা নামল সেই হলঘরে, যেখানে রক, ডিসকো বা অতি দ্রুত লয়ের গান শোনা অনেক শ্রোতাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও একটু শব্দ না করে দুই ঘণ্টা শুনলেন ওস্তাদ রশিদ খানের সংগীত।
ছয় বছর আগে দেওয়া ভারতীয় গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে রশিদ খান নিজেই সঞ্চালককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভালো মানুষ না হলে কি দিল খোলে? দিল না খুললে কি সুর, রাগের বিস্তার ঘটানো যায়? মৃত্যুর পর যেন কেউ না বলে আপদ বিদায় হয়েছে। মানুষটা খারাপ ছিল। আল্লাহ যেন আমাকে সেই দম্ভ কখনো না দেন যে আমি অমুক-তমুক বিশাল কেউ হয়েছি।’
ভালো শিল্পী হওয়ার জন্য ভালো মানুষ হওয়ার শর্ত দিয়েছিলেন রশিদ খান। তবে তাঁর কিছুটা অপরিমিত যাপন নিয়ে বিশেষত পান বা তামাকের আসক্তি নিয়ে অনেক ভক্তের হৃদয়ে আফসোস ছিল।
আফসোস ছিল খোদ কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়েরও। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং শিল্পীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন এ সংগীতবোদ্ধা। কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী বইয়ের কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আলোচনার সুবিধার্থে আগ্রা ঘরানা, পাতিয়ালা, গোয়ালিওর, জয়পুর ঘরানার ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। তুলে ধরেছেন ভাস্কর বুয়া, দিলীপচন্দ্র বেদী, ওঙ্কারনাথ, এনায়েত খাঁ, রাজাভইয়া পুছওয়ালে, ওস্তাদ আমির খাঁ সম্পর্কে বিচিত্র সব গল্প। এর মধ্যে ‘সহসওয়ান: গোয়ালিওর’ নিয়ে লিখতে গিয়ে বলছেন, ‘রাশিদ খাঁর কাছে অনেক আশা ছিল, কিন্তু আধাখ্যাঁচড়া তালিমের মাঝখানে সে খাঁ সাহেবের নাতনির পরিবর্তে একটি টুকটুকে বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে গুরুকুল থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। খাঁ সাহেব একে ক্ষমা করলে ভালো করতেন, কারণ এঁর গলা ও প্রতিভা অসাধারণ। এবং বয়সও বেশি নয়। এ সহসওয়ানের নাম রাখত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে।’
বাংলা ১৪০২ সালে প্রথম প্রকাশিত কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গীর সময় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানতেন না, রশিদ খান আমাদের মতো কম বোঝা শ্রোতাদের কাছে রামপুর সহস্ওয়ান রাগের পরিচয় তুলে দিতে পারুক না পারুক, তিনি কিছু সুর তুলে দিয়েছেন। যখন ‘আয়ো গে যাব তুম সাজনা, আঙনা ফুল খিলে’র সুরে টান দেন আমরা বুঁদ হয়ে অনুভব করি প্রিয়জন আসছে আমার কাছে।
তাঁর স্বীকৃতির একটি অনন্য উদাহরণ ভীমসেন যোশি। গতকাল রশিদ খানের প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে লাইভে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন তাঁর পরিচিত প্রতিবেশী সংগীত বোদ্ধা সুমন চট্টোপাধ্যায় নামে একজন। একটা ছোট্ট গল্প বললেন তিনি। অনেক দিন আগে রশিদ তখনো ছোট। একবার ভীম সেন যোশির কনসার্ট হচ্ছে। তাঁকে কাছ থেকে দেখবেন বলে ছোট্ট রশিদ মঞ্চের কাছে চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন। আয়োজকেরা তুলে দিয়েছিলেন রশিদকে।
অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে আসতে রশিদ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আজ যাঁরা তাঁকে তুলে দিল একদিন যেন তাঁরা তাঁকে গাইতে ডাকে এমনভাবে গান শিখবেন তিনি। পূর্ণ হয়েছিল সে বাসনা।
শুধু তা–ই নয় স্বয়ং ভীমসেন যোশি রশিদ খানকে সঙ্গে নিয়ে গানের আসর করেছেন। একমঞ্চে বসেছিলেন পণ্ডিত ভীমসেন যোশি আর ওস্তাদ রশিদ খান। এক যুগ আগে ডি ডি বাংলা সম্প্রচার করেছে এই যুগলবন্দীর ‘মিয়া কি তোরি’ রাগের পরিবেশনা।
নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় চলে আসার সময় লিখেছিলেন ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুট হি যায়ে’। গানটি ভারতের অনেক গুণী শিল্পী পরিবেশন করেছেন। তবে ভীমসেন যোশির কণ্ঠে শুনলে আপনার মনে হতে পারে, এ গানটি তাঁর গাওয়ার জন্যই।
ভীমসেন যোশি নাকি শরীর না বাঁকালে ঠিক ও রকম সুর বের করতে পারতেন না। তাই গাইবার সময় তাঁর হাত–পা মুখভঙ্গি নানা হাস্যসদৃশ হয়। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে সেই অমোচনীয় সুর। ভীমসেন যোশি বলে গিয়েছিলেন, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের পরম্পরা ধরা থাকবে রশিদ খানের কণ্ঠে।
সেই রশিদ খানের নৈহার অকালে ছুটে গেল মঙ্গলবার। কিন্তু আমাদের প্রজন্ম মনে রাখবে তাকে। যে শাস্ত্রীয় সংগীতকে আমাদের অনুভবের মধ্যে নিয়ে এসে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন সুরও টেস্ট, ওয়ানডে ম্যাচ এবং টি–টোয়েন্টি ম্যাচের মতো। শ্রোতার মন বুঝে রাগ দীর্ঘ মধ্যম এবং স্বল্প সময়ে পরিবেশন করতে হয়।
রশিদ খান শাস্ত্রীয় সংগীতকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের প্রজন্মের কাছে শ্রুতিমধুর করে। আমাদের কাছে সুর নিয়ে পৌঁছাতে রশিদ খানের যাত্রার পথটুকু আমরা অনুভব করতে পারি শুধু হৃদয় দিয়ে। পথের দূরত্বে তা মাপা যায় না। ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া, কলকাতায় গায়কি জীবনযাপন করা ওস্তাদ রশিদ খান আমাদের জানিয়ে গেলেন, কৃষ্টির বিকাশ ভূগোলের রেখা মেপে চলে না।