মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

পদ্মহেম ধামের বটতলায় বসেছিল সাধুসঙ্গ। ছবি: কবির হোসেন

সিরাজদিখান থানার পরেই সেতু পেরিয়ে বাঁয়ের রাস্তায় ঢুকতেই লোহা-ইস্পাতের সরু দীর্ঘ এক সেতু। নিচ দিয়ে বেয়ে যাচ্ছে ইছামতী। এই সেতু পেরিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ ধরে কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে ভাসানচর সেতু। বছরখানেক আগেও এখানে গাড়ি থেকে নেমে নামতে হতো সেতুর নিচে। নদীর পার ধরে গ্রামীণ হাঁটা পথ। এবারও নামতে হলো, তবে গাড়ি নিয়ে। সরু পিচঢালা পথ তৈরি হয়েছে। ইছামতী এখানেও।

পদ্মহেম ধামের বটতলায় বসেছিল সাধুসঙ্গ। ছবি: কবির হোসেন

ইছামতীর পার ধরে যেতে যেতেই গন্তব্যের আবহ ভালোই বোঝা গেল। মানুষ যাচ্ছে, মানুষ আসছে। একটু পরপর মোটরবাইক আর ইজিবাইক। ধীর লয়েই চালাতে হচ্ছিল গাড়ি। এগোতে এগোতে সুরের মূর্ছনা আর গানের বাণী স্পষ্ট হচ্ছিল, ধন্য ধন্য বলি তারে...।

ইছামতীর পাড়ে পদ্মহেম ধাম। বটবৃক্ষের তলায় শানবাঁধানো মঞ্চে শ্বেতসঙ্গতে সাধু-বাউলেরা শোনাচ্ছেন লালন সাঁইয়ের বাণী। গত শনিবার, রাত তখন ১২টা পেরিয়ে গেছে। দরাজ গলায় চুয়াডাঙ্গার লতিফ শাহ গাইছেন, ধন্য ধন্য বলি তারে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হওয়া ‘ধন্য প্রহর’ চলছে তখন।

আরও পড়ুন

পদ্মহেম ধামের সাধুসঙ্গ এবার এক দিনের। শনিবার বিকেলে আগমনী পর্ব দিয়ে শুরু হয়েছে সাধুসঙ্গ। বিকেল পেরোনোর পর সন্ধ্যায় ভক্তি পর্ব।

কবির জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতে এবারের আয়োজনে দূরের অনেক সাধু-গুরু আসতে পারেননি। আগামী ফাল্গুন মাসে আবারও সাধুসঙ্গ আয়োজনের ইচ্ছা রয়েছে তাঁদের।

এ পর্বে লালন সাঁইয়ের ভক্তিমূলক গান করেছেন সাধক বাউলেরা। তাঁদের কাছে এসব হলো বাণী। অধ্যাত্মবাদ, প্রকৃতি—বিষয় সবই। তবে এগিয়ে থাকে মানবতা, মানবিকতা।

সাধুসঙ্গের ভক্তিপর্বের শুরু হয় ধন্যপর্ব। এই যে আমি মানে আমি, আমাকে, আমার প্রকৃতি যে সৃজন হয়েছে, তাতে আমি ধন্য। কৃতজ্ঞচিত্তের গান-বাণী। মধ্যরাত পেরিয়ে চলে এই পর্ব।

পদ্মহেম ধামের সাধুসঙ্গ এবার এক দিনের। শনিবার বিকেলে আগমনী পর্ব দিয়ে শুরু হয়েছে সাধুসঙ্গ। বিকেল পেরোনোর পর সন্ধ্যায় ভক্তি পর্ব। ছবি: কবির হোসেন

ইছামতী নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের পাশে বটগাছ। এসব ঘিরেই গড়ে উঠেছে পদ্মহেম ধাম। রাজধানীর কাছে লালনচর্চার দারুণ এক উদ্যোগ। পদ্মহেম ধামের প্রতিষ্ঠাতা কবির হোসেন (একতারা সাঁই হিসেবে দীক্ষিত)। তিনি বললেন, ‘২০০৬ সাল থেকে এই সাধুসঙ্গের আয়োজন করা হচ্ছে। এবার এটি ১৯তম সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গের মাধ্যমে আমাদের এই অঞ্চলে লালন সাঁইয়ের বাণী প্রচারিত হচ্ছে, এটা বড় কথা। তরুণসহ সব প্রজন্মের মানুষের মধ্য লালন সাঁইয়ের গান ও বাণী ছড়িয়ে দিতে আমাদের এই চেষ্টা।’ প্রতিবছরের মতো এবারও দেখা গেল রাজধানী থেকে অনেক তরুণই এসেছেন সাধুসঙ্গের গান শুনতে।

কবির জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতে এবারের আয়োজনে দূরের অনেক সাধু-গুরু আসতে পারেননি। আগামী ফাল্গুন মাসে আবারও সাধুসঙ্গ আয়োজনের ইচ্ছা রয়েছে তাঁদের।

এরপরও পদ্মহেম ধামের বটতলায় লালনের বাণী শুনিয়েছেন কুষ্টিয়ার রাজ্জাক বাউল, ছমির বাউল, চুয়াডাঙ্গার আজমেরি ফকির, ফরিদপুরের পাগলা বাবলু, শিল্পকলা একাডেমির সাধুমেলার সেবক বিদ্যুৎ খ্যাপা, বাউলশিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিরক রাজা, বাউল লগ্নাসহ অনেকে। আর পুরো দোসরপাড়া গ্রাম, ইছামতীর এপার-ওপারের মানুষ অপার হয়ে শুনেছেন লালনসংগীত।

পদ্মহেম ধামের বটতলায় বসেছিল সাধুসঙ্গ। ছবি: কবির হোসেন

রাত দুইটা পেরিয়ে যখন ফিরতি পথ ধরেছি, তখন গোষ্ঠলীলা শুরু হয়েছে। সহযাত্রী নর্মদা মিথুন বললেন, ‘এখানে এসে মনে হলো সবকিছুর উৎস মানুষ। মানুষকে কেন্দ্র করেই সব।’ ইছামতীর পারের এ আয়োজন আলো-আঁধারি, প্রকৃতি-মানুষে একাকার হয়ে যায়। সাধুসঙ্গকে কেন্দ্র করে ইছামতীর তীরে বসে যায় গ্রামীণ খাবারের স্টল, লেইস-ফিতাসহ নানা পণ্যের বাহারি স্টল। নাগরদোলাও চলে আসে আনন্দ দিতে। এভাবেই সার্থক হয় মানুষের চেষ্টা।

ধন্য প্রহর শেষ হতে হতে পেরিয়ে যায় মধ্যরাত। সাধুসঙ্গের রীতি মেনে শুরু হয় গোষ্ঠলীলা। এরপর রাত আড়াইটার দিকে বাল্যসেবা বা বিশ্রাম। সবার জন্যই সবজি খিচুড়ি। রোববার সকালে দিন বরণ করা হয় সাধুসঙ্গে। আগমনী পর্ব দিয়ে সমাপন ঘটে এবারের আয়োজনের। এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছিল দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড।