‘কুঁড়েঘর’ থেকে কোটিপতি
বাসায় সবার সামনে তাঁকে জোর করেও গান গাওয়ানো যেত না। তবে সুযোগ হলে ওয়াশরুম বা বেডরুমের দরজা বন্ধ করে একা একা গান গাইতেন। এমন লাজুক ছিলেন যে বন্ধুদের আড্ডাতেও গান গাইতে বুক কাঁপত। গানগুলো কে কীভাবে নেবে, এই ছিল ভয়। সেই লাজুক গায়কই সব দ্বিধা কাটিয়ে ‘নিথুয়া পাথারে’ শিরোনামে একটি গান মুঠোফোনে রেকর্ড করেন। ২০১৫ সালে বন্ধুর বাসা থেকে ভয়ে ভয়ে ফেসবুকে গানটি পোস্ট করেন। সেই গানে ৯০ জন ইতিবাচক মন্তব্য করে। সেদিনই তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি গান করলে ৯০ ভাগ না হলেও ৫০ ভাগ মানুষ তো তাঁর গান পছন্দ করবেন। এই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে গান করতে উৎসাহ জোগাল। কুঁড়েঘর নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তুললেন তরুণ গায়ক তাসরিফ খান।
সেই কুঁড়েঘর ব্যান্ডের কোনো কোনো গানের ভিউ এখন তিন–চার কোটি। ভিউয়ে কোটিপতি তাসরিফদের ফেসবুকে পোস্ট করা গান ভাগাভাগি করেন লাখ লাখ ভক্ত। প্রতিদিন তাঁরা দেশের নানা প্রান্ত থেকে যেমন ডাক পান, তেমনি বিদেশ থেকেও গান করার বায়না আসে। তাঁদের আমন্ত্রণ থাকা মানেই আয়োজকদের আলাদা প্রস্তুতি। কারণ, সেই কনসার্টে ছয়–সাত জেলার ভক্তরা এসে হাজির হন। শত শত ভক্ত তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। ‘ময়নারে’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘তাইতো আইলাম সাগরে’, ‘ব্যাচেলর’, ‘মধ্যবিত্ত’ গানগুলো শুনতে চান হাজার হাজার ভক্ত। ভক্তদের অতি প্রিয় এই কুঁড়েঘরকে গড়ে তুলতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাসরিফকে।
‘ভবিষতে গায়ক হতে চাই,’ তাসরিফের মুখে এসব কথা শুনেই অভিভাবকদের এক কথা—‘না, আগে পড়াশোনা করতে হবে।’ কিন্তু পড়াশোনায় তাঁর মন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় একের পর এক অকৃতকার্য হতে থাকেন। অন্যদিকে ব্যান্ড গড়ার জন্যও তেমন কাউকে পাচ্ছেন না। শেষে বড় ভাই তানভীর সিদ্দিকী আর ছোট ভাই তানজীব খানকে নিয়েই শুরু হলো কুঁড়েঘর ব্যান্ডের পথ চলা। পরে যুক্ত হন বন্ধুরা। কিন্তু কাউকেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না। কেউ বাবার কথায়, কেউ বিয়ে করে কুঁড়েঘর থেকে সরে দাঁড়ায়, কারও আবার মনে হয়েছিল, এই দল টিকবে না। তিন বছর ধরে এভাবেই চলে কুঁড়েঘর। তবে ২০২১ সাল থেকে দলে নিয়মিত আছেন তানজীব খান, ইয়ামীন প্রান্ত, প্রিয়ম মজুমদার, ইমরান হোসেন, ফরিদুল হক ও শামসুল আলম।
তাসরিফ বলেন, ‘ব্যান্ড শুরুর পেছনে জেমস ভাইয়ের স্টেজ শোগুলো দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর কনসার্টে গিয়ে দেখতাম, গাছের ডালে, বাড়ির ছাদে ও মাঠে কানায় কানায় শ্রোতারা। তখন ভাবতাম, ইশ্ আমাদের গান যদি এত মানুষ শুনতেন। ভাবতাম আমরাও বড় হব। পরে আমাদের ব্যান্ডের প্রথম গান ইউটিউবে ছাড়ি। সেখানে এক দিনে গানটি দেখেন চার শ মানুষ। আমার সাবস্ক্রাইবার ছিলেন ২৪ জন। সেদিন রাতে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার শুধুই মনে হচ্ছিল, চার শ মানুষ একটা মাঠে আমার গান শুনছেন। এটাই বিশাল ছিল। মনে হয়েছিল, আমাকে গানই করতে হবে।’
২০১৬ সাল থেকে তাঁদের গানগুলো আলোচিত হয়ে উঠতে থাকে। এর মধ্যে ‘মধ্যবিত্ত’ গানটি রাতারাতি ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। অল্প সময়ে গানটি আড়াই লাখ বার শেয়ার হয়। গানটিতে মধ্যবিত্তদের মনের কথা ফুটে ওঠে। তাসরিফ বলেন, ‘তাই তো আইলাম সাগরে’ আমাদের ব্যান্ডের টার্নিং পয়েন্ট। গানটির ভিউ প্রায় ৪০ মিলিয়ন। এরপরে আমাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি।’ তাসরিফের ফেসবুক অনুসারী প্রায় ষাট লাখ। তাদের কুঁড়েঘর ব্যান্ডের ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার ২৪ লাখ। কিন্তু বেশির ভাগ ভক্তের প্রশ্ন, তাসরিফ ভাই, আপনি দেড় বছর ধরে গান করেন না কেন?
প্রশ্নটা আমরাও তাসরিফকে করেছিলাম। জবাবে এই গায়ক বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই আমাদের অ্যালবাম করার ইচ্ছা ছিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পরে হঠাৎ দেখলাম, আমার নাকের মাংস বেড়ে গেছে। চিকিৎসক বললেন, হাড় বেড়ে গেছে। এটা সার্জারি করতে হবে। যে কারণে স্টেজ শো করতে পারলেও দেড় বছর রেকর্ডিং করতে পারিনি। এটা কাউকে বলিনি। ভক্তরা জানেন না। আগামী ৬ জুন সিঙ্গাপুরে যাব। সেখানে ১১ তারিখে কনসার্ট আছে। ফিরেই নাকের সার্জারি করাব। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর আমাদের অ্যালবাম আসবে।’
এর আগে গত মার্চে তাসরিফ জানিয়েছিলেন তিনি ফেসিয়াল প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত। এ রোগের কারণে তাঁর গাল, ঠোঁটের কিছু অংশ কাজ করছিল না। চিকিৎসার পরে বর্তমানে তিনি পুরো সুস্থ।
গানের পাশাপাশি তাসরিফ নানাভাবে ভক্তদের পাশে থাকেন। কারও ইচ্ছাপূরণ করেন। কখনো ছুটে যান দুর্যোগে। এর আগে সিলেটের বন্যার সময় সরাসরি ভক্তদের নিয়ে সিলেটবাসীর পাশে থেকে আলোচনায় আসেন তাসরিফ। সেই ঘটনা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘বাইশের বন্যা’।