‘আমার পাল্লায় পড়েছেন, গান শুনতেই হবে’
হেমন্তের মিষ্টি বিকেল গড়িয়ে শিশিরঝরা সন্ধ্যায় সুর-লহরি আর কথার মায়াজাল ছড়িয়ে ঢাকার দর্শকের হৃদয়ে অন্য রকম অনুভূতি জাগালেন কবীর সুমন। নব্বইয়ের দশকে বাংলা গানের খোলনলচে বদলের মুখ্য চরিত্র বলা হয় তাঁকে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে অবিরাম সুর বেঁধেছেন সুমন, হলভর্তি দর্শককে নিয়ে পরিভ্রমণ করেছেন সুমন-রাজ্যে। ঘণ্টা চারেকের আয়োজনে তিনি কখনো শোনালেন ব্যক্তিগত প্রেমের গল্প; কখনো তুলে আনলেন বিপ্লব-কাহিনি। গানের ফাঁকে ফাঁকে কথার পিঠে কথা চড়িয়ে দর্শকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পেতেছিলেন তিনি।
এক গান শেষ হওয়ার পরপরই তুমুল করতালির সঙ্গে দর্শকেরা বলেছেন, ‘এই গানটা শুনতে চাই’—সুমনও সানন্দে সেই গানটাই ধরেছেন। ঠিক যেন ‘অনুরোধের আসর’।
গানের আসরে খয়েরি রঙের ফতুয়ার সঙ্গে সাদা ধবধবে ধুতিতে মঞ্চে এসেছিলেন তিয়াত্তর পেরোনো কথা-সুরসাধক সুমন, যাঁর জাদুকরি কণ্ঠ যেন এখনো আটকে আছে সেই সাঁইত্রিশে।
কণ্ঠ এখনো চোখা আর তিরতিরে থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য ঢাকার আগের দুই অনুষ্ঠানে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেননি সুমন। তবে শেষ দিনে দর্শকদের অনেকটা চমকে দিয়ে কি-বোর্ড বাজিয়েছেন। মঞ্চে আর কেউ নেই, কণ্ঠে সুমন, কথায় সুমন, সুরে সুমন আর কি-বোর্ডেও সুমন। বহুদিন পর সরাসরি ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ সুমনকে পেলেন দর্শকেরা।
কবীর সুমনকে নিয়ে ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ‘তোমাকে চাই-এর ৩০ বছর উদ্যাপন’ শীর্ষক গানের আয়োজন করেছে পিপহোল। ১৩ বছর পর এবার ঢাকায় গাইতে এসেছিলেন সুমন। গতকাল শেষ হয়েছে এ আয়োজন।
গতকালের আয়োজনের গোড়ার দিকে ‘পাকস্থলীতে ইসলাম নেই নেইকো হিন্দুয়ানি, তাতে যাহা জল তাহাই পানি’ ও ‘খোদার কসম জান’ পরিবেশন করে ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া’য় এসে কমা টানলেন সুমন। গান শোনানোর আগে শোনালেন গান-গল্প, ‘বড় ঠেকায় পড়ে, প্রেমে পড়ে গানটি তৈরি করেছি। আমি একজনকে ভালোবাসি, কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। তখন লিখেছি। আমার বয়স আজ ৭৩ চলছে। আমি এখনো প্রেমে পড়ি।’
এরপর শুরু করলেন ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া’—মুহূর্তেই হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতো দর্শকের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয় গানটি। এরপর সুমন প্রশ্ন ছোড়েন, কী গাইব? দর্শকদের মধ্য থেকে উত্তর আসে, ‘চেনা দুঃখ সুর’। তা–ই সই।
‘চেনা দুঃখ’ যাপন করে এবার ধরলেন ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’, সুমনের সঙ্গে মিলনায়তনের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’। দর্শকদের সরব প্রতিক্রিয়া মুগ্ধ করেছে সুমনকে, তার খানিকটা প্রকাশও করলেন গানের শেষে।
বাংলাদেশের কবি, বন্ধু শহীদ কাদরীর আলোচিত কবিতা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ পরিবেশনের আগে সুমন বললেন, ‘শহীদ কাদরীর কবিতার কয়েকটি শব্দ বদলেছি। তাঁর কবিতাটা বড় ছিল। ওটা একটু ছোট করে দিয়েছি।’
এরপর গাইলেন ‘আমি চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে, আমি চাই মহুল ফুটবে শৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে’—তাঁর চোখেমুখে প্রতিবাদের আভা ফুটে উঠেছিল
এক ফাঁকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার প্রশংসা করেন সুমন। সঙ্গে কিছু জমানো আক্ষেপও তুলে আনেন। বলেন, ‘আমি কতটা মুসলমান, তাই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আলোচনা হয়; আমি নকশাল কি না, তাই নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু আমার গান নিয়ে আলোচনা হয় না।’
এরপর বাংলাদেশের গীতিকার এনামুল কবিরের কথায় ‘যাচ্ছে জীবন’ পরিবেশন করেন সুমন। ধীর লয়ের গানটি মিলনায়তনে শীতলতা ছড়িয়ে দেয়, হলজুড়ে পিনপতন নীরবতার মধ্যে সুমন মুচকি হেসে বলে ওঠেন, ‘আমার পাল্লায় পড়েছেন, গান শুনতেই হবে।’ ধরলেন, ‘তুমি আসবেই জানি’। গানের ফাঁকে শোনালেন সেই গান লেখার গল্পও, ‘বন্ধুর বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এলেন, তিনি কবিতা লেখেন। তিনি একটি কবিতা লিখে এনেছিলেন, কবিতার নাম ছিল, “তুমি আসবে না জানি তাই”। আমার মনে হলো, সে আসবে না, সেটা কী করে জানলেন? উনি (শিক্ষিকা) বললেন, আমি জানি। সেদিন বাসায় ফিরে লিখেছিলাম, “তুমি আসবেই জানি”।’
মাঝে মিনিট পনেরোর বিরতির পর ‘তুমি ছিলে হাফিজের প্রথম প্রেমিকা’, ‘আমি যাকে ভালোবাসি’ পরিবেশন করে কলকাতার ‘গড়িয়া হাটের মোড়ে’ এসে থামলেন সুমন। ‘গড়িয়াহাটার মোড়, মিনি মিনি বাস বাস’—এভাবে বহুবচনের ব্যবহারের কথা আর কে ভেবেছে! আয়োজনের শেষ গান হিসেবে পরিবেশন করেন তাঁর তুমুল জনপ্রিয় গান ‘তোমাকে চাই’। সুমন বলে গেলেন, তিনি ঢাকায় আবার আসবেন, গান শোনাবেন—যদি শরীর সায় দেয়।