শূন্য থেকে তারকাখ্যাতি, নিঃস্ব হয়ে বিদায়
‘কিশোর এক্সপ্রেস’, আকবর–চালিত বাহন রিকশার নাম। এই রিকশাই ছিল একসময় তাঁর রুটি–রুজির একমাত্র সম্বল। যশোর শহরে কিশোর এক্সপ্রেস চালাতেন তিনি। দুই যুগ আগে শহরটিতে যাঁরা রিকশায় চড়তেন, তাঁদের অনেকে আকবরের যাত্রী ছিলেন। সাদামাটা একটা জীবন, যে জীবন কখনো ঘুণাক্ষরে ভাবেনি একদিন তারকাখ্যাতি মিলবে। কিন্তু একদিন ঠিকই মিলেছে। কিশোর কুমারের গাওয়া ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’ গানটি নতুন করে গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন আকবর। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে সেই গান প্রচারের পর রাতারাতিই বদলে যায় তাঁর জীবন। যশোরের রিকশাচালক আকবর হয়ে ওঠেন দেশের সবার কাছে গায়ক আকবর। বাড়তে থাকে আয়রোজগার। পেশাদার গানের জীবনের ১০ বছরের মাথায় এসে ধরা পড়ে জটিল সব রোগ। এরপর আবার নিঃস্ব হতে থাকেন। নিঃস্ব হতে হতে আজ বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকেও।
‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’ গানটির পর ‘ইত্যাদি’তে ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ গানটি দেশ-বিদেশের দর্শক-শ্রোতার কাছে আকবরকে আরও বেশি পরিচিত এনে দেয়। গায়ক হিসেবে দেশের সবার কাছে পরিচিতি পাওয়ার আগেও মাঝেমধ্যে স্থানীয় অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত। তেমনই একটা সুযোগ আসে ২০০৩ সালে। সে বছর যশোর এম এম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলেন আকবর। বাগেরহাটের এক ব্যক্তি সেদিন আকবরের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনিই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে চিঠি লেখেন। আকবরের প্রতিভা সম্পর্কে জানান। এরপর ‘ইত্যাদি’ কর্তৃপক্ষ আকবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওই বছর ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’ গানটি গেয়ে রাতারাতি পরিচিতি পেয়ে যান আকবর।
১৯৬৮ সালের ২৯ আগস্ট খুলনার পাইকগাছায় জন্ম নেওয়া আকবরের বেড়ে ওঠা যশোরে। ‘ইত্যাদি’তে গাইবার পর পরিচিতি বাড়লে, রিকশা চালানো ছেড়ে দিতে হয় আকবরকে। ব্যস্ত হয়ে জীবন হয়ে ওঠে মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের সামনে। এক স্টুডিও থেকে আরেক স্টুডিওতে গাইবার জন্য ছুটে বেড়াতে থাকেন। রেকর্ড হতে থাকে নতুন সব গান। স্টেজ শোতেও ডাক বাড়তে থাকে। গান শোনাতে যান দেশের বাইরেও। ১৯ বছর বছর ধরে এভাবেই গাইছিলেন। একটা সময় টের পান, শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক দফায় দেশে ও দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন আকবর। রোগ–শোকে ভুগতে থাকা আকবরের চিকিৎসায় পরিবারের জমানো সব টাকা শেষ হয়ে যায়। বিষয়টি নজরে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি আকবরের চিকিৎসায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। চিকিৎসার জন্য ২০ লাখ টাকা অনুদান দেন। সেই টাকার মুনাফা হিসেবে ৩ মাস পরপর ৪৯ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তুলতেন আকবর। ওই টাকার ১৬ হাজার ৩০০ টাকায় মেয়ের পড়াশোনা, বাসাভাড়া ও সংসার চালাতে হতো।
করোনায় দেশে লকডাউন শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় স্টেজ শো। আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে তখন আকবরের অবস্থা এমনও হয়, ঘরে চুলাই জ্বলত না। অনাহারে, অর্ধাহারে, ধারদেনা করে সংসার চালাতে হতো। এই খবর শুনে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। কিন্তু রোগ–শোকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংসার চালানোর কাজটা পেরে উঠতে পারছিল না পরিবার। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে নিঃস্ব হয়ে আজ রোববার দুপুরে চলে গেলেন তিনি।
কিশোর কুমারের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ আকবর তাঁর চালানো রিকশার নামকরণ করেন ‘কিশোর এক্সপ্রেস’। রিকশার সিটের পেছনেও কিশোরের ছবি থাকত। কিশোর কুমার ছাড়াও আকবরের মনে অন্য যেসব শিল্পী পছন্দের তালিকায় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবদুল আলীম, রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, ফরিদা পারভীন, এন্ড্রু কিশোর। রিকশাচালক থেকে গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আকবর তাঁর ছোটবেলার বন্ধু, সহরিকশাচালক, আপনজন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা কখনোই ভোলেননি। ঢাকা থেকে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতেন। মুরব্বিদের সঙ্গে সালাম-বিনিময় করে দোয়া চাইতেন। তাই তো তাঁর পরিচিতজন, পাড়া–প্রতিবেশী সবাই একবাক্যে বলতেন, আকবরের আচার-আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে ২০০৩ সালে যখন গাইবার সুযোগ পেলেন আকবর, তখন তিনি যশোরের সুজলপুরের মাঠপাড়ায় দুই পুত্র ও মাকে নিয়ে থাকতেন। আকবরের আরেকটি সংসার হয়, সেই সংসারে অথৈ নামের ১২ বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। অথৈ ও তার মা কানিজ ফাতেমাকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন আকবর। রিকশাচালক আকবর তাঁর বদলে যাওয়া জীবনের জন্য সব সময়ই নন্দিত উপস্থাপক হানিফ সংকেতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। যখনই কথা হতো, অকপটে তাঁর কথা বলতেন। আকবরের মতে, আকবরের তারকাখ্যাতির সবটুকু কৃতিত্ব হানিফ স্যারের (হানিফ সংকেত)। তিনি সুযোগ না দিলে আজকের আকবরকে কেউ চিনত না।
১০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন আকবর। পাঁচ বছর হলো তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে জন্ডিস, রক্তে প্রদাহসহ নানা রোগ। তাই আগের মতো মঞ্চে গাইতেও পারতেন না। গত জানুয়ারি থেকে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। আকবরের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শরীরে পানি জমে তাঁর ডান পা নষ্ট হয়ে যায়। গত অক্টোবরে সেই পা কেটে ফেলা হয়। পা কাটার পর বেড়ে যায় তাঁর কিডনি ও লিভারের সমস্যা। এ জন্য আকবরকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথাও ছিল। বুধবার ভিসা পেয়েছিলেনও। কিন্তু তখন আকবরকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। আজ রোববার বেলা ৩টায় ৫৪ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি।