কিছু জায়গায় মায়ের সঙ্গে দারুণ মিল ছিল শাফিনের: হামিন আহমেদ
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় ২৫ জুলাই ভোরে মারা যান ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ। সোমবার বিকেলে শিল্পীর মরদেহ ঢাকায় পৌঁছেছে। মঙ্গলবার বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে। ছোট ভাই শাফিনকে নিয়ে লিখেছেন বড় ভাই ও মাইলস ব্যান্ডের সদস্য হামিন আহমেদ
শাফিনের হঠাৎ চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পর কেমন লেগেছিল, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যেটুকু বলতে পারি, ওর মৃত্যুর খবর শুনে আমার কলিজা ছিঁড়ে গেছে মনে হয়েছে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সত্যি শুনছি তো? ভাবতে পারছি না। কীভাবে কী হয়ে গেল!
আমাদের বয়সের ব্যবধান এক বছরের। পিঠাপিঠি ছিলাম। আমার থেকে এক বছরের ছোট হলেও ছোটবেলা থেকে সবকিছু একসঙ্গেই ছিল। আমি যেখানে ছিলাম, সে ওখানে ছিল। সে যেখানে ছিল, আমি ওখানে। বন্ধু মহলও কমন ছিল। সেই সূত্রে আমি মাইলসে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে সে-ও যোগ দেয়। এরপর মাইলসের যাত্রা তো সবারই জানা। শাফিন অনন্য ছিল কারণ, সবকিছুতে খুব খুঁতখুঁতে ছিল, যেকোনো কাজ সূক্ষ্মভাবে করত। কাজ শুরুর আগে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকত। বিস্তারিত মনোযোগ যেটাকে বলে, সেটাই শাফিন। কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নয়, একদম কাজে গভীরতায় বিশ্বাসী ছিল। কোনো ফাঁকিঝুঁকি ছিল না। প্রতিটি কাজে মনোযোগ ও আন্তরিকতা ছিল দেখার মতো।
যাঁরা গান শোনেন ও বোঝেন, তাঁদের কাছে শাফিন বড় জায়গাজুড়ে। কারণ, তার গায়কি। অনেকে বলেন, আমার মায়ের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য ছিল। এটা ঠিক, কিছু জায়গায় কণ্ঠের সুর, বিশেষ কিছু জায়গায় মায়ের আদতে ছিল—এটা জন্মগতভাবে পাওয়া। তার বেজ বাজানোও দারুণ, প্রতিটি গানে যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই। বাজাতে হবে বলে বাজানো, এটা অবশ্য আমাদের কারও মধ্যে ছিল না। বেজ বাজানো গানের সঙ্গে সুন্দরভাবে মিশে যেত, যা গানের সঙ্গে বাড়তি মাত্রা যোগ করে, তা প্রতিফলিত হয়েছে গানগুলোর বাজানোয়। এ রকম আরও অনেক কারণ আছে, যেটা শাফিনের বিশেষত্ব।
উন্নত বিশ্বে যাঁরা কাজ করছেন, উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাঁরা হয়তো বিশ্বে অনেক ব্যাপকতা লাভ করছেন। শুধু সংগীতের পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলা হয়, তাহলে আমাদের উপমহাদেশ বা দ্বিতীয় বিশ্ব বা তৃতীয় বিশ্বের তাঁরাও সমানভাবে মেধাবী, প্রতিভাবান। শাফিনের ব্যাপারে যদি আসি, বাংলাদেশে প্রথম সারির যে কটা ব্যান্ড আছে, মাইলসের কথা যদি নির্দিষ্ট করে বলি, মাইলস যেকোনো বিবেচনায় ভালো ব্যান্ড, যাদের গান আমরা শুনি। গায়ক, গীতিকার ও বেজবাদক হিসেবে শাফিন পৃথিবীর যে কেউ, যে বা যাঁরা ভালো কাজ করেছেন, তাঁদের সমান—এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। আমি যদি এ-ও বলি, বাচ্চু (আইয়ুব) পৃথিবীর অন্য সেরা গিটার প্লেয়ার যেমন, সে-ও সে রকম। জেমসও সেরা—তারা যেমন, সে-ও সে রকম। আমিও আমার মতো। সবাই সবার মতো। হতে পারে বাংলাদেশ থেকে আমাদের গানগুলো এখনো পশ্চিমা দেশের মেইন স্ট্রিম মিউজিকে ঢোকেনি। তার মানে এই নয় যে আমরা কিছুটা কম আছি।
শাফিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কারও চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।বাংলাদেশে আমরা মাইলস একটা বিপ্লব সৃষ্টি করছিলাম। আমি অন্য কোনো ব্যান্ডের কথা বলছি না, নির্দিষ্ট করে মাইলসের কথা বলছি। কারণ, কথা হচ্ছে মাইলস ও শাফিনকে নিয়ে। আমরা একটা পদচিহ্ন তৈরি করেছি। অনেক ঝুঁকি ছিল।
অনেক ধরনের পথ তৈরি করতে হয়েছে। এটা শুধু গানের জন্য নয়, সবকিছুর জন্য। আমরা যত দিন কাজ করেছি—তখন তো দেখেছি, সে (শাফিন) ছিল দুর্দান্ত।
সময়মতো মহড়ায়, রেকর্ডিংয়ে আসা—এ ব্যাপারগুলো শাফিনের মধ্যে দারুণ ছিল। যেকোনো সমস্যায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা, সমাধানে সামনে থেকে কাজ করা। ব্যান্ডে শাফিনের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সময় দেওয়ার ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো ছিল। মাইলসে আমাদের সবার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়; কিন্তু যখন কাজ করেছি, সবাই এক। এমনটি ছিল বলেই আমরা ব্যান্ড হিসেবে এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি।গায়ক হিসেবে মানুষ শাফিনকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, সেটাই হচ্ছে ওর সাফল্য ও যোগ্যতার মাপকাঠি। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক যাত্রায় গায়কির ক্ষেত্রে যে জায়গা, শাফিন সেখানে একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি তো তখন দাবানলের মতো জ্বলে উঠল। কেন? গানের কম্পোজিশন বটেই, শাফিনের কণ্ঠও একটা ব্যাপার ছিল।
ওর গলায় যেভাবে ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘জাদু’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’—অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে, তা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ওর গলায় যেভাবে ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘জাদু’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’—অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে, তা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাউকে ছোট করছি না, বাস্তবতা থেকে বলছি—এখনকার কেউ যদি ১৯৯১ সালের প্রতিশ্রুতির সময়ে আরও যত গান প্রকাশিত হয়েছিল, সব একবার শোনেন, এরপর প্রতিশ্রুতি শোনেন, তাহলে পার্থক্য বুঝতে পারবেন। নির্দিষ্ট করে শাফিনের কথায় আসি, গান গাওয়ার ক্ষেত্রে ওর যে গায়কি, প্রক্ষেপণ ও গলার সুর—তা মানুষকে একদম পাগল করে দিয়েছিল।স্টুডিওতে রেকর্ডিং শেষে প্যানেলে যখন শাফিনের গান শুনতাম—বুঝতাম, ওর গায়কি কত সুন্দর। কত মাপা। গান গাওয়াটা শুধু তো সুর আর ছন্দ নয়—এর বাইরেও অনেক ব্যাপার আছে। এই ব্যাপার ওর মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রেই ছিল। কতটুকু ছাড়তে হবে, কতটুকু ধরতে হবে, কোন জায়গায় কোন অভিব্যক্তি দিতে হবে—এর চমৎকার সমন্বয় শাফিনের কণ্ঠ ও গায়কিতে। আমি বলতামও, ‘খুব ভালো গাইছিস।’ গর্বিত হতাম, অনেক বেশি। প্রত্যেক মেম্বারই গর্বিত ছিলাম।