জাকির হোসেনকে কেন মনে রাখতেই হবে
তবলা সত্যিই তাঁর কথা শুনত। যে তবলা মূলত ব্যবহৃত হতো সংগতযন্ত্র হিসেবে, জাকির হোসেনের জাদুর স্পর্শে তা পেয়েছিল ভিন্ন মাত্রা। তিনি ছিলেন এমন এক শিল্পী, যাঁর একক তবলাবাদন শুনতে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন দর্শকেরা। কেবল আজ নয়, আরও পাঁচ দশক আগে থেকেই। কেবল কি নিজে বাজিয়েছেন? দশকের পর দশক ধরে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন অনেক অনুজ শিল্পীকে। এমন প্রভাব বিস্তারকারী শিল্পীকে মনে না রেখে উপায় কী?
খুব ছোটবেলায় তিনি যে তবলাবাদক হতে চাননি এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটা হওয়া ছাড়া অন্য বিকল্পও যে ছিল না, সেটাও কি অস্বীকার করা যাবে? তাঁর বাবা প্রখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লারাখা খাঁ, যিনি জন্মের পরই সন্তানের কানে দিয়েছিলেন সংগীতের মন্ত্র, যিনি বড়ই হয়েছেন তবলার সুর শুনতে শুনতে; তিনি তবলাবাদক ছাড়া আর কীই-বা হতে পারতেন!
আজকাল ফিউশন নিয়ে কত কথা হয়। অথচ সেই সত্তর দশকের শুরুতেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের যে আশ্চর্য যুগলবন্দী যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটার প্রাণভোমরা ছিলেন জাকির হোসেন। ছয় দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক যেসব সংগীত তারকার সঙ্গে বাজিয়েছেন তিনি, সেটাকে অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। তবলা তো অনেকেই বাজান, কিন্তু জাকির হোসেন তৈরি করেছেন নিজস্ব ঘরানা। তাঁর দুই হাতের জাদুতে উঠে আসত সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গও।
জাকির হোসেন সাধারণ মানুষের কাছেও ব্যাপক পরিচিত ছিলেন, তাঁর মতো শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীর জন্য যা খুবই বিরল। এর বড় কারণ বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল। ১৯৮৮ সালে একটি চা–কোম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল করেন জাকির হোসেন, যা সে সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে।
১৯৯৪ সালে এক সাময়িকী জরিপ করেছিল। নারী পাঠকদের বিচারে সেই জরিপে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকাকে পেছনে ফেলে ভারতের সেরা আবেদনময় পুরুষ হয়েছিলেন জাকির হোসেন! বিশ্বসেরা এক তবলাবদক কিনা সেরা আবেদনময় পুরুষ! এটাও জাকির হোসেনের বহুমাত্রিক জীবনের একটা উদাহরণ।
বড় বড় সংগীত তারকারা পানাসক্তি কাটাতে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন, তবে জাকির হোসেনকে নেশা কখনো ছুঁতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ২০১১ সালে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘যে সংগীত আমি পরিবেশন করি, এগুলো তো তার চেয়ে বেশি উত্তেজক নয়। এগুলো তো আমাকে সংগীতের চেয়ে বেশি গভীর মাত্রার উপলব্ধি, উত্তেজনা বা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেনি। তাই অন্যদিকে তাকানোর কোনো তাগিদই আমার ছিল না।’
ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান, বিয়ে, রেস্তোরাঁ, করপোরেট অনুষ্ঠানে কখনো পাওয়া যায়নি তাঁকে। নাসরিন মুন্নি কবিরের লেখা জাকির হোসেন: আ লাইফ ইন মিউজিক বইতে তিনি বলেছিলেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে মানুষ সৌহার্দ্য বিনিয়ম করেন, রেস্তোরাঁয় খেতে যান; এসব জায়গা ঠিক সংগীতের জন্য উপযুক্ত নয়। তবলা নামক বাদ্যযন্ত্রটিকে যিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেই জাকির হোসেনকে তো মনে রাখতেই হবে।