সাবিনা ইয়াসমীনের শাড়ি ও চিঠি, মুন্নীর কান্না
গান বুঝতে শিখেছেন যখন থেকে, তখন থেকেই দেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের গানের সঙ্গে পরিচয়। রেডিও, টেলিভিশনের পাশাপাশি অ্যালবাম কিনে গান শোনার মাধ্যমে এই পরিচয়ের সূত্র। গান শুনতে শুনতে এই শিল্পীর প্রতি তৈরি হয় ভালো লাগাও। একটা সময় স্বপ্ন দেখেন শিল্পী হবেন। সেই স্বপ্ন থেকে মুন্নী নিজেও গানের অঙ্গনে পথচলা শুরু করেন। পেশাদার গানে এরই মধ্যে কাটিয়েছেন দুই যুগের বেশি সময়। চলার পথে অনেকবারই সাবিনা ইয়াসমীনের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। বয়সে বড় আর অভিজ্ঞতায় দূরত্ব যোজন যোজন হলেও বছর দুয়েক ধরে সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে দারুণ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলে জানালেন মুন্নী। এই সম্পর্কটা কখনো আবার বড় বোন ছোট বোনের মতোই। দেশের সংগীতের কিংবদন্তি এই শিল্পীর কাছ থেকে সম্প্রতি অমূল্য উপহার পেয়েছেন, যা রীতিমতো তাঁকে হতবাক করেছে। এটা তাঁর কাছে আশীর্বাদও।
সাবিনা ইয়াসমীনের কাছ থেকে মুন্নী উপহার হিসেবে পেয়েছেন শাড়ি, তা–ও আবার একটি দুটি নয়, ১৫টি শাড়ি। এসব শাড়ি এখনো মুন্নীর হাতে পৌঁছায়নি, কারণ তিনি এই মুহূর্তে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। বছরখানেকের বেশি সময় ধরে তিন সন্তানকে নিয়ে মুন্নী স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন। সেখানে স্টেজ শোও করছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে গত শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে কথা হয় মুন্নীর। জানালেন, উপহারের অমূল্য সব শাড়ি এখন তাঁর ঢাকার বাসায় আছে। খুব শিগগির এসব শাড়ি তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে।
এদিকে সাবিনা ইয়াসমীনের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের শাড়িগুলোর কয়েকটি স্থিরচিত্র ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
সেখানে মুন্নী লিখেছেন, ‘আমার জীবনে অসংখ্য উপহার পেয়েছি কিন্তু কিছু উপহার মনে হয় আমার পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের গল্পেও ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে, আজ পেলাম তেমনি উপহার। এক লাগেজ শাড়ি উপহার পাঠিয়েছেন কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি ভালোবেসে আমাকে কিছু শাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলেন। বললাম, আমি তাঁর ব্যবহৃত শাড়ি চাই, যেগুলো পরে তিনি গান গেয়েছেন। যেমনি কথা তেমনি তিনি পাঠালেন। শাড়িগুলো আমার কাছে কতটা আবেগের, তা কেবল গানপ্রিয় মানুষেরা বুঝবেন। এই শাড়িগুলো লেগে আছে তাঁর স্পর্শ, যিনি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রায় সব গানের শিল্পী। যাঁর গান শুনে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমীনের শাড়ি আমার পরিধানে—এ কথা ভাবতেই শিহরিত আমি। শাড়ির সঙ্গে তিনি পাঠিয়েছেন তাঁর হাতে লেখা এই চিঠি। চিঠি পড়ব কি? আবেগ আর চোখের পানি তো সবই ঘোলা করে দিচ্ছে! আপনারা সবাই দোয়া করবেন আমাদের দেশের এই কিংবদন্তির জন্য, তিনি যেন সুস্থ থাকেন।’
শাড়ি উপহারের গল্পটা মুন্নী প্রথম আলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে বললেন, ‘সাবিনা আপার কথামতো আমার ড্রাইভার তাঁর বাসায় লাগেজ নিয়ে যায়। আপা দেখে বললেন, এই ছোট লাগেজে হবে না, আরও বড় লাগেজ নিয়ে যেতে। কারণ, আমার অনেক শাড়ি। পরদিন আবার বড় লাগেজ নিয়ে গেল। আপা সব শাড়ি লাগেজে ঢুকিয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় আনার পর লাগেজ খুলে দেখা গেল, ১৫টা শাড়ি! আমি তো এখন নিউইয়র্কে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, কবে কিংবদন্তির পাঠানো শাড়িগুলো হাতে ছুঁয়ে দেখব।’
জানা গেছে, ২৭ সেপ্টেম্বর শাড়িগুলো দিনাত জাহান মুন্নীর ঢাকার বাসায় পৌঁছে গেছে।
তিনি বললেন, ‘সাবিনা আপা এমনিতে সবার সঙ্গে কম মেশেন। আমার সঙ্গে তাঁর চমৎকার বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে দুই বছর আগে, চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৫ বছরের কনসার্ট উপলক্ষে। একই অনুষ্ঠানে আমিও গেয়েছি। ঢাকা থেকে তিনি আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন। কনসার্ট ভেন্যুতে যাওয়ার আগে চাঁদপুরে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখানে আমাদের নতুন বাড়ি, পুরোনো বাড়ি ঘুরে দেখেছেন। চাঁদপুরে গিয়ে আমি আমার বাবার বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি কোথাও থাকতে পারিনি, ছিলাম সার্কিট হাউসে। কারণ, পুরোটা সময় সাবিনা আপা আমাকে তাঁর সঙ্গে রাখতে চেয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময়ে বলেছিলেন, তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসতে। আসার পথে গ্রামের চায়ের স্টলে চা–ও খেলেন। যখন আসছিলেন বলছিলেন, এখন থেকে তুমি যেখানে বেড়াতে যেতে বলবে, সেখানে যাব। এরপর আপা ট্রিটমেন্টের জন্য দেশের বাইরে গেলেন। লম্বা সময় থাকলেন। আর আমাদের সেভাবে দেখা হলো না। কদিন আগে হঠাৎ আমাকে ভিডিও কল দিলেন। সেদিন অনেক কথা হলো। জানালেন, আমাকে শাড়ি উপহার দেবেন। সেদিনই আমি বললাম, নতুন নয়, আপার ব্যবহৃত শাড়িই যেন উপহার দেয়। এরপর তো এই কাণ্ড ঘটে গেল।’
কথায় কথায় মুন্নী বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে শুধু শাড়ি উপহার হিসেবে দেখছি না। মনে হয়েছে, একজন সাবিনা ইয়াসমীন তাঁর সত্তাকে কারও হাতে বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে দিলেন। এটা আমার জন্য একটা প্রতীকী, মনে হচ্ছে প্রজন্মকে তিনি তুলে দিলেন। এটা আমার একার পাওয়া মনে করছি না। আমাদের গোটা প্রজন্মকে তাঁর গানের মতো করে হাতে এই শাড়িগুলো তুলে দিয়ে গেলেন। এটা অনেক বিরাট আশীর্বাদ। আমি বিশ্বাস করি, এর মধ্য দিয়ে তিনি আমার ও পরের প্রজন্মকে সম্মানিত করেছেন।’