গানের রয়্যালিটি কোন পথে
বাংলাদেশের গীতিকার ও সুরকারেরা রয়্যালিটি পান না বললেই চলে। স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়াই হরহামেশা বাণিজ্যিকভাবে গান ব্যবহার করা হয়। এতে অনেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামালেও গানের স্রষ্টারা কিছুই পান না।
কনসার্টে, রেস্তোরাঁয়, রেডিও কিংবা টেলিভিশনে গান বাজলেও নিয়মিত প্রাপ্য রয়্যালিটি বুঝে পান ভারতের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ভারতজুড়ে রয়্যালিটি সংগ্রহ করে গানের স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দ্য ইন্ডিয়া পারফর্মিং রাইট সোসাইটি লিমিটেড (আইপিআরএস)।
আইপিআরএস একটি কালেক্টিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশন (সিএমও)। ১৯৬৯ সাল থেকে গীতিকার, সুরকারদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করছে ভারতীয় সংস্থাটি। আইপিআরএসের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ভারতীয় গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও কবি জাভেদ আখতার।
বাংলাদেশের গীতিকার ও সুরকারেরা রয়্যালিটি পান না বললেই চলে; দুয়েক জায়গা থেকে পেলেও বেশির ভাগ সময়ই স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়াই হরহামেশা বাণিজ্যিকভাবে গান ব্যবহার করা হয়। এতে অনেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামালেও গানের স্রষ্টারা কিছুই পান না।
বাংলাদেশ এখনো না পারলেও পাশের দেশ ভারতের গীতিকার, সুরকারেরা দশকের পর দশক ধরে রয়্যালিটি পাচ্ছেন। কপিরাইট অফিসের সহযোগিতায় ভারতে সাড়ে পাঁচ দশক ধরে কাজ করছে আইপিআরএস। কপিরাইট আইন অনুসারে কোনো গানের সুরকার ও গীতিকারকে স্বত্বাধিকারী হিসেবে ধরা হয়।
১৯৭০ সালে সিসাকের সদস্য হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে ভারতের আইপিআরএস। সিসাকের সদস্য হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরের পাশাপাশি বাইরে থেকেও রয়্যালিটি সংগ্রহ করতে পারে আইপিআরএস।
কীভাবে রয়্যালিটি তোলে আইপিআরএস
১৯২৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে গীতিকার ও সুরকারসহ সৃজনশীল ব্যক্তিদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অথরস অ্যান্ড কম্পোজারস’ (সিসাক)। এটি এটি আন্তর্জাতিক কনফেডারেশন। এতে যুক্ত রয়েছেন বিশ্বের ১১৬ দেশের ২২৫ সিএমও ও ২৫ লাখের স্বত্বাধিকারী।
১৯৭০ সালে সিসাকের সদস্য হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে ভারতের আইপিআরএস। সিসাকের সদস্য হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরের পাশাপাশি বাইরে থেকেও রয়্যালিটি সংগ্রহ করতে পারে আইপিআরএস।
রয়্যালিটি পেতে গানের স্বত্বাধিকারীদের কী করতে হয়—গানের স্বত্বাধিকারীদের আইপিআরএসের সদস্য হতে হয়। এরপর তাঁদের গান আইপিআরএসের তথ্যভান্ডারে তোলা হয়। গীতিকার, সুরকারদের কে কতটুকু রয়্যালিটি পাবেন—তা তথ্যভান্ডারে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে সহজেই বের করা যায়।
আইপিআরএসের অপারেশন ম্যানেজার সৌরিশ সরকার গত বুধবার প্রথম আলোকে জানান, তথ্যভান্ডারে থাকা কোনো গান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হলে সেখান থেকে প্রাপ্য রয়্যালিটি তুলে স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে আইপিআরএস। রেডিও, টেলিভিশন, রেস্তোরাঁ কিংবা কনসার্টে কার গান কতবার পরিবেশন করা হচ্ছে—তা উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও লোকবল রয়েছে আইপিআরএসের। কলকাতা, মুম্বাইসহ ভারতের বড় বড় শহরে সংস্থাটির কার্যালয় রয়েছে।
আইপিআরএসের তথ্যভান্ডারে থাকা কোনো গান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হলে সেখান থেকে প্রাপ্য রয়্যালিটি তুলে স্বত্বাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে আইপিআরএস।সৌরিশ সরকার, অপারেশন ম্যানেজার, আইপিআরএস
‘ভারতজুড়ে কোথায় তাঁর গান বাজছে—একজন গীতিকার, সুরকারের পক্ষে তা ট্র্যাক করা সম্ভব নয়। আইপিআরএসের সদস্য গীতিকার, সুরকারদের পক্ষে আমরা কাজটা করে দিই।’ বলেন সৌরিশ সরকার।
এর বাইরে লাইসেন্স ফি থেকেও মোটা অঙ্কের রয়্যালিটি সংগ্রহ করে ভারতীয় সংস্থাটি। কারও গান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি পেতে আইপিআরএসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্সের বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের জন্য গানটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। সেই ফি থেকে প্রাপ্য রয়্যালিটি গীতিকার, সুরকারদের বুঝিয়ে দেয় আইপিআরএস।
ভারতের বাইরে থেকে রয়্যালিটি মেলে কীভাবে? বাইরের দেশ থেকে রয়্যালিটি তুলতে সিসাকের মতো কনফেডারেশন সদস্য হওয়া আবশ্যক। সিসাকের সদস্য হিসেবে বাইরে থেকেও রয়্যালিটি আনতে ও বাইরে রয়্যালিটি পাঠাতে পারে আইপিআরএস। কোল্ডপ্লের কোনো গান কলকাতায় বাজলে সিসাকের মাধ্যমে কলকাতা থেকে লন্ডনে রয়্যালটি পাঠানো যায়, লন্ডন থেকে ভারতেও রয়্যালিটি আসে।
সিসাকের সদস্যদেশ ও সিএমওর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ‘সিসনেট’ নামে একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকভাবে রয়্যালিটি সংগ্রহ ও বণ্টনের কাজ করে থাকে সিসাক। ভারতে সিসাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে আইপিআরএস।
সিসাকের সদস্যদেশ ও সিএমওর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ‘সিসনেট’ নামে একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকভাবে রয়্যালিটি সংগ্রহ ও বণ্টনের কাজ করে থাকে সিসাক। ভারতে সিসাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে আইপিআরএস।
বাংলাদেশে কাজ করছে বিএলসিপিএস
গানের স্বত্বাধিকারীদের প্রাপ্য রয়্যালিটি সংগ্রহে ভারতের আইপিআরএসের মতোই কাজ করছে বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি (বিএলসিপিএস)। বাংলাদেশের গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের রয়্যালিটিসহ অন্যান্য স্বার্থ সংরক্ষণের কাজ করছে বিএলসিপিএস।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর ২০১৪ সালে দেশের প্রথম ও একমাত্র কালেক্টিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশন (সিএমও) হিসেবে সরকারি অনুমোদন পেয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের সঙ্গে কাজ করছে বিএলসিপিএস।
ইতিমধ্যে ২০০ জন সংগীতপ্রণেতা বিএলসিপিএসের সদস্য হয়েছেন। প্রায় ২০ হাজারের ওপর গানের তথ্যভান্ডারও করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই সিসাকের সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে বিএলসিপিএস।হামিন আহমেদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিএলসিপিএস
বিএলসিপিএসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হামিন আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, ‘ইতিমধ্যে ২০০ জন সংগীতপ্রণেতা বিএলসিপিএসের সদস্য হয়েছেন। প্রায় ২০ হাজারের ওপর গানের তথ্যভান্ডারও করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই সিসাকের সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে বিএলসিপিএস।’
ভারতে সাড়ে পাঁচ দশক ধরে রয়্যালিটি নিয়ে চর্চা হলেও দেশে এই ধারণা অনেকটা নতুন। ফলে গীতিকার, সুরকার, শিল্পীসহ সংগীতের অংশীজনদের সচেতনতা বাড়াতে একটি কনফারেন্স আয়োজন করে বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি। গত মঙ্গলবার ঢাকার গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এই কনফারেন্সে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন সিসাকের উপদেষ্টা সাতোশি ওয়াতানাবে। শেখ সাদী খানের সভাপতিত্বে হামিন আহমেদ, মাকসুদুল হক, শেখ মনিরুল আলম টিপুসহ শতাধিক অংশীজন উপস্থিত ছিলেন।
সিসাকের সদস্যপদ পেলে বাংলাদেশে সিসাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে বিএলসিপিএস। ভারতের আইপিআরএসের মতো ঢাকার বিএলসিপিএসও দেশে ও দেশের বাইরে থেকেও গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের প্রাপ্য রয়্যালিটি সংগ্রহ করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীরা আপাতত সীমিত পরিসর রয়্যালিটি পাচ্ছেন। সিসাকের অনুমোদনের পর বিএলসিপিএস পুরোদমে কাজ শুরু করলে রেডিও, টিভি, কনসার্টসহ আরও নানা ক্ষেত্র থেকে রয়্যালিটি বুঝে পাবেন।