নিউইয়র্কের কলেজ ড্রপআউট তরুণ যেভাবে টাইমস স্কয়ার বিলবোর্ডে
দুই বছর আগে মুজার ‘নয়া দামান’ গান নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। এরপর তাঁর ‘বেণি খুলে’ ও ‘ঝুমকা’ গান দুটি জায়গা করে নিয়েছে মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম স্ফটিফাইয়ের তালিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বেড়ে ওঠা এই তরুণ সবার কাছে মুজা নামে পরিচিত হলেও তাঁর পারিবারিক নাম মুজাহিদ আবদুল্লাহ। সম্প্রতি ঢাকায় আসেন তিনি। বনানীর একটি স্টুডিওতে মুখোমুখি হন প্রথম আলোর।
নিউইয়র্ক, টরন্টো ও লন্ডনের নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে স্পটিফাই তাদের বিলবোর্ডে টাঙিয়েছে বাংলাদেশি তরুণ মুজার ছবি। ক্যাপশনে লিখেছে, একমাত্র স্ফটিফাইতেই শুনুন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা সব মিউজিক। নিউইয়র্ক টাইমস স্কয়ারে টাঙানো স্পটিফাই বিলবোর্ডে ছেলের টাঙানো ছবিটি দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ধারণ করেন মুজার মা–বাবা, যা ফেসবুকে প্রকাশের পর আলোচিত হয়। দুই যুগের বেশি সময় ধরে নিউইয়র্কে থাকা মুজার মা–বাবা বছরের পর বছর এই পথে যাওয়া–আসা করেছেন। এমন দৃশ্য তাঁদের জীবনে আসবে, কোনো দিন ভাবেননি। ছেলেকে নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ছিল—ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু ছেলে বেছে নিয়েছেন গান। এই গানই তাঁকে ফাইয়ের বিলবোর্ডে জায়গা করে দিয়েছে।
বাংলা গানের শ্রোতারা মুজাকে চিনেছে পাঁচ বছর ধরে। ‘বন্ধুরে’ দিয়ে আলোচনার শুরু। এরপর ‘আসি বলে গেল বন্ধু’, ‘বুকের ভেতরে’, ‘স্বপ্ন তো দেখেছি’, ‘তোমাকে’সহ আরও গান প্রকাশিত হয়। তবে ‘নয়া দামান’–এরপর তাঁর মা-বাবাও বুঝে যান, ছেলের সংগীত প্রতিভার কথা। মুজার সঙ্গে এই গান গেয়েছেন সিলেটের তোশিবা। বাংলা গানের সঙ্গে আধুনিক সংগীতের মিশ্রণে জনপ্রিয়তা পান মুজা। সহজ কথা, সুর আর মেলোডিকে প্রাধান্য দিয়েই শ্রোতাদের মন জয় করেছেন বলে মনে করেন তিনি।
মুজার ‘ঝুমকা’ গানে কদিন আগে নেচেছেন বলিউডের কোরিওগ্রাফার রেমো ডি সুজা, নিজের ইনস্টাগ্রামে তা পোস্টও করেছেন, যা চোখে পড়েছে মুজারও। বললেন, ‘গান তৈরির সময় হিট হবে কি হবে না, এমনটা কোনো দিন ভাবি না। তবে সব সময় একটা বিশ্বাস থাকে। কিন্তু দর্শকেরা গানটি কীভাবে গ্রহণ করবেন, সহজে বোঝা যায় না। আমার মাথায় থাকে শুধু, আমার ভালো লাগছে কি না। নিজের মধ্যে ভালো লাগছে মানে আমার মতো মানসিকতার যাঁরা আছেন, তাঁরা পছন্দ করবেন—এটা মনে করি।’
সিলেটের ওসমানী নগরের বালাগঞ্জে জন্ম নেওয়া মুজা চার কি পাঁচ বছর বয়সে মা আর ছোট বোনসহ নিউইয়র্ক চলে যান। বাবা আগে থেকেই সেখানে থাকতেন। ভর্তি হন কুইন্স বরো কমিউনিটি কলেজে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে লাগোর্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে ক্লাস শুরু করেন। কিন্তু গানের কারণে কলেজের গণ্ডি পার হতে পারেননি। অকপটে তিনি বললেন, ‘আই অ্যাম এ কলেজ ড্রপআউট।’ নিউইয়র্কের এই কলেজ ড্রপআউট তরুণের ছবি এখন টাইমস স্কয়ার বিলবোর্ডে।
মুজার বাবা নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালাতেন, মা প্রি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। মুজার ভাষায়, তাঁরা গরিব। মা–বাবা দুজনে অনেক কষ্ট করতেন। তাঁদের কষ্ট মুজাকেও খুব কষ্ট দিত। ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন, কবে মা–বাবাকে সহযোগিতা করতে পারবেন। মুজা বললেন, ‘আব্বু–আম্মু প্রতিদিন কাজ করত। একসঙ্গে যে খাব, আড্ডা দিব এসবের সুযোগ সেভাবে ছিল না। সবার মতো করে ব্যস্ত সবাই। বাবা রাতেও ট্যাক্সি জব করতেন। মা দিনে কাজ করতেন। দিনে ছোট বোন আর আমি স্কুলে থাকতাম। এসব আমাকে ভীষণ আঘাত করত। ছোটবেলা থেকে তাই ভাবতাম, কীভাবে হেল্প করতে পারব। ১৬ বছর বয়স থেকে কাজ করতাম। প্রথম কাজ ছিল একটা মিউজিক স্টুডিওতে। তখন স্প্যানিশ মার্কেটের জন্য জিঙ্গেল করতাম। এরপর অফিস জবও করেছি।’
মা–বাবা দুজনেই চাইতেন মুজা পড়াশোনায় ভালো কিছু করুক। কিন্তু তাঁর সেটা খুব একটা ভালো লাগত না। তাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্টুডিওতে চলে যেতেন। মুজা বললেন, ‘সব সময় আম্মু–আব্বু চাইতেন, প্রতি সাবজেক্টে এ–প্লাস থাকতে হবে। এ-পেলেও সন্তুষ্ট থাকতেন না। মনটা সব সময় এ-প্লাসের পেছনে থাকলেও পাওয়া হতো না। এত সব হতাশা ও চাপের মধ্যে একমাত্র সংগীতই আমাকে মুক্তি দিত। মনে হতো হতাশার কথাটা গানে বলতে পারব। পিয়ানো বাজিয়ে নিজেকে বোঝাতে পারব—ওটাই আমার থেরাপি। গানের প্রেমে পড়লাম। মিডল স্কুলে থাকতে গানই করব সিদ্ধান্ত নিলাম।’
‘বন্ধুরে’ মুজার প্রথম বাংলা গান। তখন সবাই বলত, ‘ওই যে মুজা, “বন্ধুরে” গানটি করেছে।’ এরপর শুরু করোনাকাল। কোভিডের মধ্যে ‘নয়া দামান’ গানটি করেন। সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাঁর গান নতুন এক সাউন্ডের সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করে।
‘নয়া দামান’ প্রসঙ্গে বললেন, ‘করোনার সময় নিউইয়র্কে ইকবাল নামের এক কাজিনের বাসায় ছিলাম। টিকটক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ দেখি তোশিবাকে। অনেকে আমাকে ওর নাম আর গানটা ট্যাগও করেছিল। এরপর তার পেজে যাই। গান শুনলাম। ভাবলাম, গলাটা তো অনেক সুন্দর। সিলেটি ভাষায় ফোক গান করা যাবে। এরপর মেসেজ দিলাম। বললাম, চলো, আমরা একটা গান করি। সে–ও বলল, চলেন করি। জানতে চাইলাম, কী গান করা যায়? সিলেটের মানুষ চিনবে–জানবে, এ রকম কিছু করতে হবে। তারপর বলল, “নয় দামান”। বললাম, তুমি কণ্ঠ দিয়ে আমাকে পাঠাও। এরপর আমি প্রোডাকশন, মিক্সিং, মাস্টারিং সব করছি। মাত্র এক দিনে শেষ করি গানটা।’
‘বন্ধুরে’ গানটি তরুণদের মধ্যে ছড়ালেও ‘নয়া দামান’ সবার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয় বলেও জানালেন মুজা। এরপর মৌলিক গান আমার ‘হৃদয় বলে চেনা চেনা’ দিয়ে প্রমাণ করলেন, শুধু কাভার গানে নয়, নতুন গানেও তিনি পরদর্শী।
স্কুলপড়ুয়া মুজাহিদ আবদুল্লাহ ওরফে মুজা ফুটবল খেলতেন। ফুটবলে ভালো কিছু করার সুযোগও এসেছিল। কিন্তু ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেবেন না মা–বাবা, তাই আর এগোতে পারেননি তিনি। সেই গল্পটা বললেন এভাবে, ‘নিউইয়র্কের বাসায় একটা এজেন্সি আসছিল। আমাকে নিয়ে ইতালি যাবে। বয়স তখন ১৩ কি ১৪। আম্মু বলেন, “আমার একমাত্র ছেলেকে একা ইতালি পাঠাব না।” তখন বুঝে গেছি, ফুটবলে ক্যারিয়ার হবে না। মিউজিক করতে হবে।’
কথায় কথায় মুজা বললেন, ফুটবল তিনি মুক্তির উপায় মনে করে খেলতেন। ‘আমাদের সবার মাথায় একটা ব্যাপার থাকে, এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হব? মেসি, রোনালদো এরা সবাই গরিব ছিল। ওরাও ভাবত, আমরা কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হব। এটা আমার মনেও ছিল।’
গান করে এখন স্বাবলম্বী মুজা। মা–বাবার দুঃখকষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছেন। সেই প্রসঙ্গও উঠে এল আলোচনায়। স্টুডিওতে বসে মুজা বললেন, ‘সেদিন আব্বু বলছিল, একটা নতুন গাড়ি কিনবে। আমি বলেছি, আমিই কিনে দেব। আম্মু একটা বাড়ি কেনার কথা বলছিল, আমি বলেছি, আমিই হেল্প করব। এত দিন পর্যন্ত আমরা ভাড়া বাসায় ছিলাম। কিছুদিন হয় নিজেদের বাড়িতে আছি।’
রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা মুজা সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। স্কুলপড়ুয়া তরুণ মুজার মনে হাবিব ওয়াহিদের সংগীত বেশ প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর মতে, ‘আমি ছোটবেলা থেকে হাবিব ওয়াহিদের অনেক বড় ফ্যান। যখন পিকনিকে যেতাম আব্বু “কৃষ্ণ” গানটা বাজাতেন। ছোট চাচা বাজাত “দিন গেল”। ওই সময়ে আমি খুব হতাশায় ছিলাম। গানটা আমাকে অনেক হেল্প করত। আমার যন্ত্রণা মুক্তি দিয়েছে। এটা অনেক প্রেরণা। ফুয়াদ ভাইয়ের গানও শুনতাম। এর বাইরে লিংকিন পার্ক বেশি শুনতাম।’
বাংলা গান নিয়ে স্বপ্ন দেখেন মুজা। তাঁর বিশ্বাস, একদিন কে পপ, বলিউড কিংবা অ্যাপ্রোবিট যেভাবে বাজছে, বাংলা গানও বাজবে। মুজা বললেন, ‘বাংলা গান শুনতে কাউকে বাঙালি হতে হবে না। আফ্রিকান, ফরাসি হয়েও সবাই বাংলা গান শুনবেন। আমাদের যে পরিমাণ মানুষ আছে, শুধু ভালো গান দিতে হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটা হতে পারে।’