বাড়ি পাননি ‘দিলারাম’ শিল্পী হামিদা বানু
ঠিকানাহীন হামিদা বানুকে ৯ মাস আগে সুনামগঞ্জ সদরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি বাড়ি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। তবে এখনো বাড়ি পাননি তিনি; আদৌ পাবেন কি না—তা নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তিনি।
লোকসংগীতশিল্পী হামিদা বানুর মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এক বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন; মেয়েকে নিয়ে সেই বাড়িতেই সাময়িক আশ্রয় পেয়েছেন।
ঠিকানাহীন হামিদা বানুকে ৯ মাস আগে সুনামগঞ্জ সদরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি বাড়ি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। তবে এখনো বাড়ি পাননি তিনি; আদৌ পাবেন কি না—তা নিয়েও অনিশ্চয়তায় দিন গুজরান করছেন ৪৮ বছর বয়সী হামিদা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোক স্টুডিও বাংলায় হাসন রাজার ‘দিলারাম’ গেয়ে রাতারাতি পরিচিতি পান সুনামগঞ্জের বনগাঁওয়ের এই লোকসংগীতশিল্পী।
এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর হামিদা বানুকে নিয়ে প্রথম আলোর বিনোদন পাতায় ‘গানই জেলমুক্ত করেছিল তাঁকে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হামিদা বানু বলেছিলেন, একটা বাড়ি পেলে দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি নজরে এলে হামিদা বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে একটি বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী। জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে হামিদাকে একটি হারমোনিয়াম দেওয়া হয়েছিল।
দেড় মাসের ব্যবধানে সুনামগঞ্জ থেকে দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীকে ময়মনসিংহে বদলি করেছে সরকার। তাঁর বদলির পর বাড়ি বরাদ্দ আটকে আছে। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে এসেছেন মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী।
বুধবার প্রথম আলোকে হামিদা বানু জানান, তিন দফায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ২০ দিন আগেও ঘুরে এসেছেন। গত ৯ মাসে বাড়ির আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাননি তিনি।
আক্ষেপের সুরে এই লোকসংগীতশিল্পী বললেন, ‘তাঁরা বলেছিলেন, ঘর দেবেন। কিন্তু ঘর তো দিলেন না। ২০ দিন আগেও ডিসি অফিসে গিয়েছিলাম। বলেছেন, পরে আইসেন। উনারা আমাকে ঘুরাইতেছেন। আমি তো আশায় আছি।’
সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমরা কাগজপত্র দিয়েছিলাম। কোথায় বাড়ি দেব, সেটা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাঁরা রাজি হয়েছিলেন, তবে আমরা যেখানে বাড়ি দিতে চাইছিলাম, সেখানে যাবেন কি না—সেটা ঠিক করতে পারছিলেন না।’
এর মধ্যেই দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীকে বদলি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে হামিদা বানু বলেন, তাঁকে কোথায় বাড়ি দেওয়া হবে—সেটা জেলা প্রশাসন জানাবে বলেছিল, তবে পরে আর জানায়নি। তাঁর একটা বাড়ি প্রয়োজন, যেখানেই হোক না কেন, সেখানেই থাকবেন।
সুনামগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বুধবার প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা হামিদা বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বিষয়টি তাঁরা দেখবেন।
কে এই হামিদা বানু
মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুনামগঞ্জের নারায়ণতলায় হামিদার বিয়ে হয়। হামিদার সংসারে অনাহূত অতিথি ছিল ‘অভাব’। ভাতের কষ্টে জর্জর হামিদার সংসার, জীবিকার তাগিদে আড়াই মাসের সন্তানকে বুকে নিয়ে স্বামী শুকুরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
পাসপোর্ট ছিল না। বিএসএফ জওয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেও দিল্লি যেতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আটকা পড়েন। ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে জেল খেটেছেন হামিদা। জেলেও সংগীত চর্চা করেছেন তিনি।
জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর সুনামগঞ্জের নারায়ণতলায় শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসেন। শ্বশুরবাড়ির লোকদের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে আবারও স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন হামিদা। আবারও ভারতে পাড়ি দেন; জম্মুর কালাকোটে বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন হামিদা। প্রথম সন্তান আল আমিনের পর কালাকোটে মেয়ে সোয়ানার জন্ম হয়।
মেয়ের জন্মের পর সুনামগঞ্জে ফিরে আসেন তাঁরা। ফিরেই ভোল পাল্টান শুকুর, আরেকটা বিয়ে করেন। দুই সন্তানসহ হামিদাকে বাড়িছাড়া করা হয়। ঠিকানাহীন হামিদা সন্তানদের নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, একা লড়াই করে গেছেন। ঘাত-প্রতিঘাতে সন্তানদের আগলে রেখেছেন। মাঝে কিছুদিন সুরমা নদীতে শ্রমিকের কাজ করেছেন হামিদা, বালুভর্তি বস্তা ট্রলারে ফেলতেন। অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যেও সংগীত চর্চা করে গেছেন হামিদা, সংগীতের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন তিনি।
মেলায়, ওরস, মাহফিলে গান করতেন তিনি। ঘুরতে ঘুরতে বছর পাঁচেক আগে হাসন রাজা মিউজিয়ামের কর্মচারী হিসেবে কাজ পান তিনি। মাঝে মিউজিয়াম বন্ধ থাকায় মিউজিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাসন রাজার প্রপৌত্র ও গবেষক সামারীন দেওয়ানের বড়পাড়ার বাড়িতে কাজ নেন তিনি। ৯ বছর বয়সী মেয়ে সোয়ানাকে নিয়ে সেই বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছেন তিনি।
তবে মাসখানেক পর বড়পাড়ার বাড়ি দিচ্ছেন সামারীন দেওয়ান। সঙ্গে শেষ আশ্রয়ও হারাতে হবে হামিদা বানুকে। মাসখানেক পর তিনি কোথায় যাবেন? তা জানা নেই তাঁর।