আপনার কাছে জীবনের অর্থ কী?
প্রবর রিপন: মহাবিশ্ব প্রতিমুহূর্তে সৃষ্টিশীল। আর এই পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের অস্তিত্ব অনন্য, সেই অস্তিত্বকে সৃষ্টিশীল হতে হবে। পৃথিবীকে এমন কিছু দিতে হবে, যেটা পৃথিবীতে আগে ছিল না। আমার কাছে এটাই জীবন। জীবনের পূর্বনির্ধারিত কোনো অর্থ নেই। জীবন একটা সাদা ক্যানভাসের মতো। এই ক্যানভাসে আমি কী আঁকব, সেটাই আমার জীবন আর সেটাই আমার জীবনের অর্থ। মানে অর্থহীন পৃথিবীতে আমিই জীবনের অর্থ তৈরি করছি।
জীবনের বিপরীতে আপনার গানে বারবার মৃত্যু ফিরে এসেছে। আপনি গানে বলছেন, ‘আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি।’ আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি কীভাবে?
প্রবর রিপন: মানুষকে টিকে থাকতে প্রতিমুহূর্তে পরিশ্রম করতে হয়। একটা শ্রেণির স্বর্গের প্রলোভনে বাকি সবার জীবন নরকের মতো হয়ে উঠেছে। তাদের আরাম, বিলাসিতা, আধিপত্যের জন্য একটা শ্রেণির জীবনের হাপিত্যেশ অবস্থা, নারকীয় অবস্থা। কৃষক ফসল ফলাচ্ছেন, শ্রমিক কারখানায় কাজ করছেন আর এসব মিলিয়েই দাঁড়িয়ে আছে অর্থনীতি। সেই অর্থনীতির অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে মানুষ মারার জন্য, অস্ত্র বানানোর জন্য। আগে মানুষ শিকারের জন্য অস্ত্র বানিয়েছে, বন্য প্রাণীর থেকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র বানিয়েছে। এখন মানুষ মারার জন্য অস্ত্র বানানো হয়।মানুষের পরিশ্রমের অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে মানুষ মারার জন্য। তাই আপনি যে কারখানায়ই কাজ করেন না কেন, সেটা আসলে মৃত্যু উৎপাদন কারখানা। এখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যু উৎপাদন করা হচ্ছে।
মানবপ্রগতির নামে আমরা যা বলছি, তা সুনিশ্চিত হচ্ছে অজস্র অপমৃত্যুর বিনিময়ে। বলা যেতে পারে, মানুষেরই ঝরা রক্তে মসৃণ হচ্ছে প্রগতির পথ ও তার গতি। এমনকি মানুষকে যেভাবে শোষণ করা হচ্ছে, সেটাও মৃত্যুভয়কে পুঁজি করে, মানে তাঁদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে দমন করে রাখা হচ্ছে। তাই বলা যায়, এটা এক আদিগন্ত মৃত্যু উৎপাদন কারখানা, যেখানে মালিকপক্ষ সরাসরি মৃত্যুযজ্ঞে অংশগ্রহণ করছে না। করুণ ব্যাপার হলো, মালিকেরা শ্রমিকদের দিয়ে হত্যা করাচ্ছেন, আর শ্রমিক যাঁকে হত্যা করছেন, তিনিও হয়তো তাঁরই আপনজন বা সহকর্মী। মানে আমাদের সর্বস্ব লুট করে ক্ষুধার সুযোগ নিয়ে এক সুচতুর ফাঁদে ফেলে নিজেদের একে অপরকে হত্যা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, সেটা হয়তো প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে।
‘মেটাফোরিক’ গানটা নিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি কেউ কেউ দাবি করছেন যে এই গান তরুণ শ্রোতাদের অবসাদের পথে ঠেলছে। এটা মানবেন?
প্রবর রিপন: একদমই না। যদিও অনেকেই এটাকে হতাশাজনক গান বলার চেষ্টা করেন। এখন তো পৃথিবীর অবস্থাই হতাশাজনক। শিল্পী আয়নার মতো, পৃথিবীকে যেমন দেখেন, সেটাই শিল্পে ফুটিয়ে তোলেন। আমিও মন খারাপের গান লিখতে চাই না। তবে এটাই পৃথিবীর বাস্তবতা, না মেনে উপায় নেই।
আমি বহু কনসার্টে দেখেছি, শ্রোতারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলছেন, ‘আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু গানটা আমাকে বাঁচিয়েছে। পৃথিবীর এই বাস্তবতা মেনে নিতে না পেরে নিজেকেই সব দোষ দিচ্ছিলাম। পরে দেখলাম, পৃথিবীই আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। পৃথিবীটা মৃত্যু উৎপাদনের ফাঁদ। নিজেকে মেরে ফেলে কী হবে; বরং প্রতিরোধ করতে হবে, নিজেকে বাঁচাতে হবে। আমাকে সংগ্রাম করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ ফলে তাঁরা নিজেকেও মারছেন না আবার অন্যকে মেরে ফেলতেও আর আগ্রহী নন। আর্ট মূলত রূপকাশ্রয়ী বা মেটাফোরিক ভাষা, তাকে ওপরের অর্থ দিয়ে বুঝলে হবে না, তার রূপকের আড়ালের সত্যের দিকে মন খোলা রেখে তাকাতে হবে। আর যাঁরা সেটা পারছেন, তাঁরাই এই গানকে গ্রহণ করছেন, একে হতাশার গান না ভেবে বরং হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার পথ হিসেবে দেখছেন। কেননা সত্য জানলেই কেবল মানুষ তাঁর নিজেকে চিনতে পারেন আর সে অনুযায়ী নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যারা নতুন ধরনের গানকে বা শিল্পকে গ্রহণ করতে পারে না, তারাই মূলত এ ধরনের কথা বলে। এটা দিয়ে তাদের হৃদয়ের দৈন্যকে তারা আড়াল করতে চায়।
চিকিৎসক যখন বলেন, আপনার হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুসের অবস্থা খারাপ। তখন কি আপনি বলবেন ডাক্তার আমাকে হতাশ করে দিলেন? ডাক্তার আপনাকে হতাশ করেননি, তিনি আপনার রোগটা নির্ণয় করে আপনাকে তা দ্রুত ঠিক করতে বলছেন। আমার গানও তেমন। বলা যেতে পারে, শিল্পী এখানে সেই ডাক্তারের মতো কাজ করছেন, পৃথিবীর রোগটা কী তা ধরে তা সারানোর জন্য বলছেন সবাইকে। গানে আমি বলছি, তুমি মৃত্যু উৎপাদন করছ, তুমি মানুষকে পিষতে পিষতে এগিয়ে যাচ্ছ, তোমার সকল পরিশ্রমের যোগফল হচ্ছে এই দিন দিন ক্রমাগত বিশাল আকার ধারণ করা মৃত্যু উৎপাদন কারখানা। শিল্পী হিসেবে মানবসভ্যতার ক্ষতগুলোতে দেখিয়ে দিচ্ছি। এখন এসব ক্ষত ঠিক করার সময় এসেছে।
দুনিয়াজুড়েই মূলত অধিকাংশই নারী–পুরুষের প্রণয় ও বিরহকাতরতা নিয়ে গান হয়। এটা সর্বজনীন অনুভূতি, এটা থাকবে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, এটা সর্বজনীন অনুভূতি। এটাকে অস্বীকার করছি না। প্রেমিক–প্রেমিকা প্রেম করবে, একসঙ্গে গান গাইবে, কিন্তু সেটার জন্য পৃথিবীটাকে তো তৈরি করে রাখতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি থেকে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় তো আর একসঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রণয়ের গান গাওয়া সম্ভব না, বরং আপনি তখন শুনবেন দৌড়ে পালানোর সময়ের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ের মর্মান্তিক নিশ্বাস।
পৃথিবীকে প্রেমের যোগ্য স্থান করে গড়ে তোলা হোক আর সেটা প্রেমেরই স্বার্থে আর প্রেমের জন্য তো আগে স্বাধীন হতে হবে, না হলে তা হবে জেলখানার কয়েদিদের প্রেম, যে প্রেম কেউ নজরদারি করছে, যেখানে প্রেমিক–প্রেমিকা তাদের প্রেমের পথে স্বাধীন নয়। আর পরাধীনের প্রেম তো প্রেম না, তা এক মর্মান্তিক, করুণ পরিণতি, যা মৃত্যুর মতো শীতল, মৃতের চোখের মতো হিম, করুণ এক প্রাণহীনতা।
‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ কবে, কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছেন?
প্রবর রিপন: ২০০৩ সালের দিকে গানটা লিখেছি। তখন ইরাকে আক্রমণ করেছিল আমেরিকা। পরে জানা গেছে, আসলে ইরাকে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না। আমেরিকার ওখানে ঢোকার একটা পাঁয়তারা ছিল। একইভাবে আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে এখন প্যালেস্টাইনে এমনটা চলছে। এমন পরিস্থিতিতে একজন শিল্পী হিসেবে আমার কী করার আছে? আমি গান লিখতে পারি, তখনই আমি গানটা লিখেছিলাম।
গানটা লেখার সময় আমি কল্পনা করেছিলাম, এই মুহূর্তে একটা মানুষ গুলি খেয়ে মরুভূমির ওপর পড়ে গেল। গলগল করে তার রক্ত মরুভূমিতে মিশে যাচ্ছে। লোকটা শেষবারের মতো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘এই হলো তোমাদের পৃথিবী? এই তোমরা আমাকে উপহার দিলে, এই মৃত্যু?’ সেই মানুষের দীর্ঘশ্বাস ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ গানে লেখার চেষ্টা করেছি। সে মৃত্যুর সময় পৃথিবীকে যেভাবে দেখেছিল, আমি সেটা গানে লেখার চেষ্টা করেছিলাম। ওই যে মৃত মানুষটি যার শেষ কথা সে পৃথিবীর মানুষকে বলে যেতে পারেনি, আমি তার হয়ে পৃথিবীকে সেই কথা গানের ভেতর দিয়ে শোনাতে চেয়েছিলাম।
আটপৌরে কথার বাইরে আপনি অস্ত্র, যুদ্ধের মতো ভারী বিষয় নিয়ে গান করেন। এ ধরনের বাংলা গান শুনতে সাধারণ শ্রোতারা খুব একটা উন্মুখও ছিলেন না। ‘আমি, তুমি, প্রেম’–এর সহজ পথ ছেড়ে কঠিন পথে কেন হাঁটলেন?
প্রবর রিপন: সহজ পথে হাঁটলে আমি হয়তো অনেক আগেই স্বীকৃতি পেতাম। এই সময়ের কবিতার ভাষা আজ থেকে এক শ বছর আগের মতো হলে সেটা নিশ্চয় এই সময়ের কবিতা হয় না। গানের ভাষাও তেমন। বাংলা গান যে দাঁড়িয়ে আছে, তার জন্য তিনজনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি—লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। এঁদের দুজন কবিতার লোক আর লালনকেও আমার মনে হয় কবি, তবে সেটা লিখিত ফর্মে না; বরং হাওয়ায় ভাসিয়ে গাওয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত কবিতা। তো এমন কবিদের হাতেই বাংলা গান এমন পদ্মের মতো বিকশিত হয়েছে, যাঁদের গানের ভাষা তাঁদের সমকালীন কবিতার ভাষার মতো। আমার কাছে মনে হয় গানের কথাও কবিতা, কিন্তু তার গঠনে এমন কিছু থাকে, যেন সুরে ভেসে উঠতে সুবিধা হয় । তাই বলা যায়, কবিতার সমকালীন ভাষার সঙ্গে গানের অগ্রযাত্রাও সমানতালেই আগাবে কিন্তু এখানে হলো তার বিপরীত, গানের ভাষা এখনো পুরোনো সময়ের কবিতার ভাষাই রয়ে গেছে।
এরপর এসেছে সিনেমার গান। সিনেমার গান স্বাধীন নয়, গল্পের প্রয়োজনে তৈরি গান। বেশির ভাগই প্রেমের গান; নারী–পুরুষের প্রণয়ের গান। আমি যখন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি, সেটাও প্রেমের গানই, কিন্তু সেই প্রেমের গান তথাকথিত নারী-পুরুষের প্রণয়ের গান না, তা মানবপ্রেমের গান মানে তা তথাকথিত ‘লাভ সং’ নয়। তো সেই গানের ভেতর প্রেমের সেই মাধুর্য নেই, তার ভেতর আছে রক্ত, গুলি, শিকল, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের শব্দ, দমবন্ধ গরাদের দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, নৈরাশ্য, ক্ষোভ, কান্না, চিৎকার। যা এই সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক, যা এই সময়ের সর্বজনীন শব্দের নৈরাজ্য।
আমি ২০ বছর ধরে গাই। বলা যেতে পারে উত্তরাধুনিক এই সময়ের গত ‘বিষ’বছরের গান, (হা হা) ‘বিষ’ শব্দটা কি প্রাসঙ্গিক, ‘জেনেশুনে ‘বিষ’ করেছি পান, প্রাণেরও আসা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।’ (হা হা) । অনেক সমঝদার লোক বলেন, তুমি গান ভালো করো; তোমার গায়কিতে তোমার হৃদয়ের সংবেদন টের পাওয়া যায়। তবে এখানকার মানুষ এ ধরনের লিরিক শোনে না। লিরিকটা একটু পরিবর্তন করো। আমি বলেছি, মানুষ কী শোনে, সেটা বলার জন্য আসিনি। লালন ফকিরেরও অনেক গান জনপ্রিয় হলেও বহু গান আবার অনেকে শোনেন না। এটা ভেবে সে তো আর সেই গানগুলো না লিখে থেমে যায়নি। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি’ অথবা ‘ও সে ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর/ ক্ষণেক ভাসে নীরে’ গানগুলোর রূপক কিন্তু আধুনিক কবিতার মতোই পরাবাস্তব। যে পরাবাস্তবতা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারে না। ‘মিলন হবে কত দিনে’—এই গান শুনে ভেবে নেয় নারী-পুরুষের প্রণয়ের গান, কিন্তু তার দেহতাত্ত্বিক ভাষা অনেকেই বুঝতে পারে না, তবু ভালোবাসে, ভুল ভেবেই ভালোবাসে। শিল্পীর কাজ তাঁর নিজের অবচেতনকে প্রকাশ করা, কে বুঝবে না বুঝবে সেটা তার ব্যাপার। এ জন্য তিনি তো আর তাঁর নিজের অবচেতনকে বদলে ফেলতে পারেন না, তা হলে তিনি অন্য কেউ হয়ে ওঠেন, আর অন্য কেউ হয়ে ওঠার চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে? বাজারের বা এন্টারটেইনমেন্টের প্রয়োজনে যা তৈরি হয়, সেটা আলাদা কথা, তার সঙ্গে আর্টের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মুখশ্রী কারও পছন্দ হচ্ছে না বলে আমি তো আর মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াতে পারি না।
আমি কবিতার লোক, আগে থেকেই কবিতা লিখতাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, কবিতা শিক্ষিত মানুষের জন্য; কবিতা সবাই বোঝে না। যিনি পড়তে পারেন না, তিনি আমার কথাগুলোকে জীবনেও জানবেন না? তখন গিটার হাতে গাওয়া শুরু করলাম। সেই থেকেই গানে এলাম। আমার জিদ ছিল, আধুনিক কবিতার ভাষা যেখানে এসেছে, সেটাকে গানে তুলে আনব। এমনটা বব ডিলান, লিওনার্দ কোহেন, মহীনের ঘোড়াগুলি, জিম মরিসন, কবীর সুমনসহ আরও অনেকের গানেও পাবেন। এটা নতুন না, তবে প্রচলিত না। আমার গায়কির দক্ষতাটাকে শক্ত করার চেষ্টা করেছি। হৃদয়কে প্রস্তুত করেছি, সে যেন গানের শব্দগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে গাইতে পারে, যাতে মানুষ গায়কি ও সুরে আকৃষ্ট হন। এরপর যেন আমার কথা বোঝার চেষ্টা করেন, এই জিনিসটা হয়ে গেছে। আমার গানের প্রতি ভালোবাসাই হয়তো অনেকের হৃদয়ের ভালোবাসাকে কুড়াতে পেরেছে, হাওয়া যেমন উড়িয়ে নিতে পারে শুকনো পাতা, আর পাতা নিজেকে পাখি ভাবা শুরু করে...
আপনার গান তরুণ শ্রোতারা হুমড়ি খেয়ে শুনছেন। কেন শুনছেন? আপনার ধারণা কী?
প্রবর রিপন: কোনো গায়কের গান কখন শ্রোতাদের মধ্যে স্বীকৃত হয়? যখন দেখবেন, কোনো কথা শ্রোতাদের মনের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে আছে, তবে সেটা প্রকাশ করতে পারেননি। আরেকজন গায়ক সেটা প্রকাশ করলে সেই কথার সঙ্গে শ্রোতারা নিজের যোগসূত্র খুঁজে পান। আমি যখন বলছি, ‘আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি’, তখন তাঁরা দেখছে, পৃথিবীজুড়ে কীভাবে মানুষকে শোষণ করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে মানুষকে শিকড় থেকে বিচ্যুত করা হচ্ছে। সবকিছুর সঙ্গে শ্রোতারা মৃত্যু উৎপাদন কারখানার মিল পাচ্ছেন। মাঝখানে দেশের একটা কারখানায় আগুন লাগল। কলাপসিবল বন্ধ থাকায় ৫২ শ্রমিক পুড়ে মারা গেলেন। তখন ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ গানটা ফেসবুকে শেয়ার করেছি। ওই দিন বুঝলাম, গানগুলো কেন মানুষ কানেক্ট করছে। ওখানে অনেকে লিখেছে, ভাই আমার বাবা ওখানে পুড়ে মারা গেছে। কেউ লিখেছে, আমার বোন পুড়ে মারা গেছে। এই মৃত্যু উৎপাদন কারখানা মানুষের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতার সঙ্গে শ্রোতারা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। এটাই জীবনবাস্তবতা। সমালোচকেরা যখন বলছেন, আমার গানের ভাষা জটিল। সেই শ্রোতাদের কাছে কিন্তু সেটা আর জটিল ভাষা থাকে না, বরং তাঁদের জীবনবাস্তবতার সঙ্গে মিলে যাওয়া সহজ ভাষা মনে হচ্ছে, যেহেতু জীবনের জটিল বাস্তবতা তাঁদের কাছে জটিল সত্যকে সহজ করে তুলেছে। তাই আমার আপাতজটিল ভাষা এখন তাঁদের কাছে পানির মতো সহজ।
আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, আমার গায়কি ও স্টেজ পারফরম্যান্স। আমার গানের পরিবেশনার ভেতর আমি গানের চরিত্র হয়ে তা অভিনয় করিয়ে দেখিয়ে দিই। আমার গানের সবকিছুই যে সব শ্রোতা বুঝে ফেলছেন, তা–ও না। কিন্তু কিছু একটা আঁচ করছেন আর তাঁদের অনুভূতির সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। এটা তো শুধু লিখিত কবিতা না, এটা মিউজিক। মিউজিকে অনেক ইনস্ট্রুমেন্ট বাজে, সেসব যন্ত্রের জাদুবলের ক্ষমতা আছে, সুরের ব্যাপার আছে—সব মিলিয়েই হয়তো কিছু গানের কিছু লাইন বুঝছেন। বাকিগুলো ধীরে ধীরে বুঝছেন।
পুরোনো ঘরানার প্রডিউসাররা ভাবেন, গান যেভাবে এত দিন ধরে চলে আসছে, সেভাবেই চলবে। কিন্তু মানুষের মগজ সব সময়ই নতুন কিছু চায়। আগে যা হয়েছে, সেগুলো অনেক দিন ধরেই শুনেছে, সেগুলোতে তার মন তৃপ্ত হয় না আর, নতুন কিছু চায়। আমাদের গানে হুট করে অন্য একটা বাতাস, নতুনত্ব মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। ভেবেছে, ‘এসব নিয়েও গান হয়।’ নতুন সাউন্ড, নতুন কথা, নতুন অ্যাপ্রোচ—নতুনত্বটাই মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। ২০ বছর পর হয়তো আমাদের এটা পুরোনো হয়ে যাবে। আরেকটা গায়ক বা গায়িকা নতুন কিছু দিলে ওর গানে নতুন স্রোতারা নতুনভাবে আকৃষ্ট হবে। নতুন জেনারেশন নতুন ভাষাটাকে খুঁজে নিতে চায়, তাদের সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে এমনকিছুর সঙ্গে তারা একাত্মবোধ করে। তারা আর বড় ভাই, বাবার পছন্দের গান শুনতে চায় না। বাবার সময়ের গানও শুনতে চায় না। যদি প্রকৃত আর্টের বয়স বাড়ে না, আর্টের একটা চিরন্তন ভাষা আছে, যা সব সময়ই নতুন থাকে, তবু নতুন সময়ে নতুন আর্ট সৃষ্টি হবেই। সবকিছুই যখন বদলে যাচ্ছে, আর্টের ভাষা কেন বদলাবে না!
কোভিডের সময়ে মানুষেরও ঘরে বন্দী হয়ে যাওয়াটাও একটা ব্যাপার ছিল।করোনাভাইরাস আসার ৯ দিন আগে একটা ব্যান্ডের অ্যালবাম এসেছে। অ্যালবামের গানে বলা হচ্ছে, ‘মহামারি শিশুদের প্রিয় খেলনা’, ‘পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে সব রেলপথ, জলপথ, আকাশপথ। বলো, কোন পথে তুমি যাবে’, বা ‘ঘাতক চাকা ছোটে মন্বন্ত্বরের ভোরে, অথবা “পৃথিবীর সব ভালোবাসার গল্প যদি আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়, কোনো নির্জন পরিত্যক্ত গুহা কি আমাকে ডেকে নেবে না? আমার নাম অসুখ’। এসব শুনে শ্রোতারা মনে করছেন, এখন যা যা ঘটছে, এসব তো এই গানে বলা হয়েছে, গায়ক আগে থেকেই অনুভব করেছেন। তবে এত কথার পরেও আমি আসলে বলতে পারি না তাঁরা কেন এটাকে গ্রহণ করেছেন, এটা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। আমার এসবই গাওয়ার ছিল আমি গেয়েছি, যাঁদের ভালো লাগার ভালো লেগেছে, অনেকের আবার ভালো লাগেনি।
সোনার বাংলা সার্কাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘এপিটাফ’। এই গানটা কবে লিখলেন? এই গানের মধ্যে আপনি কতটা আছেন?
প্রবর রিপন: গানটা ২০০৪ সালে লিখেছি। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম, সবারই সমাধির গায়ে লেখার জন্য গান আছে। সমাধিলিপি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের, ‘আমি যাব চলে’, জেমস ভাইয়ের, ‘যেদিন বন্ধু চলে যাব’। প্রায় প্রত্যেক শিল্পীর একটা এপিটাফ থাকে। আমার সবচেয়ে প্রিয় এপিটাফ লিখেছেন কবি জন কিটস। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে যে শুয়ে আছে, তারা নাম লেখা ছিল জলে।’ জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি বন্ধুকে মজা করতে করতে বললাম, আমিও এমন একটা গান করব, যা লেখা থাকবে আমার সমাধিতে, তখনই ‘এপিটাফ’ গানটা লিখলাম। রাস্তাঘাটে প্রায় প্রতিদিন গাইতাম, তবে রেকর্ড করা হয়নি। অবশেষে ২০২০ সালে সোনার বাংলা সার্কাসের ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ অ্যালবামে এই গান প্রকাশের পর গানটির জন্য অনেক ভালোবাসা পেয়েছি।
সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের সাইকেডেলিক থিয়েট্রিক্যাল ব্যাপার আছে; প্রথাগত কনসার্টের বাইরে ভিন্ন ঢঙে গান পরিবেশন করা হয়। এই তাড়না কীভাবে পেলেন?
প্রবর রিপন: ব্যান্ডের নাম ‘সোনার বাংলা সার্কাস’, ব্যান্ডের নামের সঙ্গে সার্কাসের ব্যাপারটা আছে। আমি বলি, আমি গান গাই না, গানের চরিত্রে অভিনয় করি। যেখানে কাঁদার দরকার সেখানে কাঁদি। এটা পারফরম্যান্স, এটা অনেকটা গীতিনাট্যের মতো। ওই আবহটা তৈরি হলে গানটাকে মানুষ অনুভব করতে পারবে। এখান থেকেই থিয়েট্রিক্যাল ব্যাপারটা এসেছে। আমি যখন গান গাই, আমি প্রবর রিপন থাকি না, হয়ে উঠি যে গানটা গাচ্ছি, তার অভিনেতা। প্রতিটি শব্দ, সুর, অনুভূতিকে আমি অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করি। যেমন ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ গানের সময় স্টেজে যে শুয়ে পড়া হয়, এটার কারণ আমি তখন যে মানুষটিকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার চরিত্রে অভিনয় করছি, যেন গানটি মানুষ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেখতেও পারে। আর আপনারা নিশ্চয় জানেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকে না, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আবার একইভাবে মানব হায়েনাদের আসল ক্রূর চেহারা প্রকাশ করার জন্য হায়েনার মতো হাসি। এটাকে আপনি প্রথাগত গান পরিবেশনার চেয়ে বলতে পারেন, এটা সাংগীতিক মঞ্চনাটক। যে নাটকের ভেতর দিয়ে গানকে শুধু শ্রুতিমান নয়, দৃশ্যমানও করা হয় ।
আপনি তো নাটকেও অভিনয় করেছেন, ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’ টেলিফিল্মে আপনার একটি দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নাটকটি কবে করেছিলেন?
প্রবর রিপন: আমি গানের অভিনেতা, গানের চরিত্রে অভিনয় করি। অভিনেতা হওয়ার কোনো চিন্তা ছিল না। আমার হয়তো সিনেমা নির্মাণের ইচ্ছা ছিল। বাজেট দরকার, প্রযোজক দরকার। আশপাশের পরিচালকদের জীবনের হতাশা দেখে মনে হয়েছিল, আপাতত করব না। হয়তো ভবিষ্যতে সামর্থ্য হলে নিজের প্রযোজনায় সিনেমা করতে পারি। তবে সেটা নিশ্চিত না। ২০০৭ থেকেই আমার আশপাশের বন্ধুরা অভিনয়ের কথা বলেছিল। আমি বলেছিলাম, অভিনয়ের জন্য আমার জন্ম হয়নি। তখন ‘মনোসরণি’ ব্যান্ডে ছিলাম।
২০১১ সালের ঘটনা, শাহবাগে আমার গান শুনে আমার মোবাইল নম্বর নিয়েছিলেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাই। রাতে বাসায় গিয়ে ফোন দিলেন, ‘আমি একটা চিত্রনাট্যের কথা অনেক দিন ধরে ভাবছি। তবে এর মূল চরিত্রের জন্য কাউকে খুঁজে পাইনি। তোমাকে দেখে, তোমার গান গাওয়া শুনে মনে হলো, এই চরিত্রের জন্য তুমি পারফেক্ট। আমি আজ চিত্রনাট্যটা কমপ্লিট করলাম, তুমি পড়ে দেখতে পারো।’ আমি বললাম, ‘আমাকে দিয়ে অভিনয় হবে না। পৃথিবীতে আমার প্রথম পরিচয় কবি, দ্বিতীয় পরিচয় গায়ক।’
অন্যদিকে গিয়ে আসল পথ থেকে সরে যেতে চাই না। অভিনয়ে যেহেতু টেলিভিশনে মুখ দেখা যায়, তাই দ্রুত খ্যাতি বেড়ে যায়। সবাই দ্রুত চিনে ফেলে আর উপার্জনও ভালো। আর অভিনয় করে যদি খ্যাতি বেড়ে যায় আর আমার গান যদি মানুষ গ্রহণ না করে, তখন হয়তো মনে হতে পারে গান বাদ দিয়ে শুধু অভিনয়ই করি। উজ্জ্বল ভাই বললেন, চিত্রনাট্যটা একবার অন্তত পড়ো। পড়ে দেখলাম, প্রথাগত টেলিভিশন নাটক বা টেলিফিল্মের চেয়ে একেবারেই আলাদা, যা আসলে সিনেমার জন্য উপযুক্ত চিত্রনাট্য। তখন মনোসরণী ব্যান্ডের অ্যালবাম প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। অ্যালবামের তিনটি গান টেলিফিল্মে থাকবে। গানের প্রমোশনের লোভেই অভিনয়ে এসেছিলাম। এতে নিজের মতো করে অভিনয় করেছি। তবে সংলাপ ইম্প্রোভাইজ করিনি, অনেকে ভাবেন, এটা আমার কথা, আসলে চিত্রনাট্যে যা ছিল, আমি শুধু তাই বলেছি, একটা শব্দও ইম্প্রোভাইজেশন করে বলিনি। তাই এই টেলিফিল্মের যে এত এত ডায়ালগ এত জনপ্রিয়, এর কোনো কৃতিত্ব আমার নয়, এর পুরোটা কৃতিত্ব চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ভাইয়ের।
আমাদের এখানে তখন অতি অভিনয়ের প্রবণতা ছিল। এখনকার ওটিটি, সিনেমায় জিনিসটা অবশ্য অনেকে কমে এসেছে। ঠিক এমন সময়ে একজন নতুন মানুষকে এত নির্লিপ্তভাবে পর্দায় যে দেখা গেছে, এটা মানুষকে মুগ্ধ করেছে। এটার কারণে মানুষ কানেক্ট করেছে, মনে হয়েছে আমাদের চারপাশের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কোনো ভবঘুরে যেন কথা বলছে। তখন এই টেলিফিল্ম মোটামুটি জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে খুব বেশি না।
মাঝখানে এই ২০২০ সালে কোভিডের মধ্যে এর একটা ছোট্ট ক্লিপ ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। এরপর তা অনেক মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে খুব আকৃষ্ট করে। আর এরপর ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’ যেন পুনর্জন্ম পায়, অনেক জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু এর সুবিধার দিক যেমন আছে, তেমন অসুবিধার দিকও আছে। সুবিধার দিক হলো এটা দেখে অনেকে আমার প্রতি আগ্রহী হয়েছেন, আমাকে খুঁজে বের করে দেখেছেন আমি মূলত কবি ও গায়ক। আর তাঁরা তখন আমার কবিতা পড়ে বা শুনে অথবা গান শুনে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
আর অসুবিধার দিক হলো অনেকে সেই টেলিফিল্মের যে চরিত্রে আমি অভিনয় করেছিলাম, আমাকে সেই ‘মুদ্রা’ ভেবে নেয়, প্রবর রিপন ভাবতে পারে না। আবার যাঁদের ওই টেলিফিল্মের ডায়ালগ পছন্দ নয়, তাঁরা আমাকেই সে ডায়ালগের লেখক ভেবে মজা নেন। কারণ, বন্দীকে বন্দী বললে বন্দীরা রেগে যেতে পারেন, কেননা কেউ তাঁদের বন্দিত্বকে ফাঁস করে দিয়েছেন, যে বিষয়গুলো সেই টেলিফিল্মে ছিল। এরপর সামান্য কয়েকটা কাজ করেছিলাম। পরে মনে হলো এই জায়গাটা আমার জন্য না। ফলে আর করিনি। অনেক দিন পর সম্প্রতি ‘ডকুমেন্টারি অব ডেথ’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, যার কাজ এখনো চলছে। তবে অভিনয়ে নিয়মিত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
সোনার বাংলা সার্কাসের পরবর্তী অ্যালবাম ‘মহাশ্মশান’–এ কী থাকবে?
প্রবর রিপন: এ বছরের মধ্যেই অ্যালবামটা আসবে। এটা ডাবল অ্যালবাম—১৬টি গান থাকবে। সব গানের রেকর্ড শেষের দিকে। এরপর মিক্সিং, মাস্টারিং, ভিডিওয়ের কাজ শেষ হলে প্রকাশ করব। আমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’–এর মিউজিকে পশ্চিমের ধারা ছিল। সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমারা কীভাবে দুনিয়াটাকে শোষণ করেছে, ওই অ্যালবামে সেটা ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষ্টি–কালচারকে ধ্বংস করে তারা তাদের মতো করে আদর্শ নির্মাণ করেছে, সেই আগ্রাসন নিয়েই ছিল আগের অ্যালবাম। এটা মূলত তাদের সেই হায়েনা স্বভাবকে প্রকাশের গান নিয়ে ছিল।
‘মহাশ্মশান’ অ্যালবামে আমাদের এই অঞ্চলের কথা। কীভাবে আমরা আমাদের নিজেদের দোষে এত দিন শোষিত হলাম এবং এখনো পরোক্ষভাবে তা হয়ে যাচ্ছি আর কীভাবে আমরা আমাদের ছাই থেকে আবার উঠে দাঁড়াতে পারি। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা অনেক সমৃদ্ধ, উর্বর ভূমিতে যা হয় আরকি। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে নিজেরাই মূল্য দিতে পারিনি, বরং নিজেদের নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগি ঔপনিবেশিক চাতুর্যের প্রভাবে। এখানকার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে আধুনিক পাশ্চাত্যের দর্শন সমৃদ্ধ হয়েছে, এখানকার ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে পাশ্চাত্য ধনী হয়েছে, আবার তারাই আমাকে করুণা পাঠাচ্ছে চ্যারিটির নামে। আমাদের সব প্রতিভা ওখানে গিয়ে তাদের হয়ে কাজ করে দিচ্ছে, আর আমরা ভুগছি মেধাশূন্যতায়। উপনিবেশ প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও পরোক্ষভাবে রয়ে গেছে, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আইন, নৈতিকতাবোধ দিয়ে তারা আমাদের রাজনীতিসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের অনেক কিছুর ওপরই পশ্চিমারা দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমাদের বলছে আমরা ভিখারি! ‘মহাশ্মশান’ সেই তথাকথিত ভিখারিদের প্রতিরোধের অ্যালবাম। যেন চিতায় পুড়তে থাকা শবরা উঠে দাঁড়াচ্ছে আর বলছে, ‘আমি যেহেতু বিশ্বাস করি তুমি আমাকে মারতে পারবে না, তাই আমি মরছি না। দেখুন বিটলসের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যান্ডও রবিশঙ্করের শিষ্যত্ব নিয়েছে। আমরা আমাদের গৌরবের কথা ভুলে গেছি। নিজেদের গৌরব ভুলে মহাশ্মশানের চিতায় ছাই হয়ে বাতাসে উড়ছি, সেই বাতাস পাশ্চাত্য যাওয়ার চেষ্টা করছে, হওয়ার চেষ্টা করছে পাশ্চাত্যের আদলে এক কলের পুতুল; যাকে পাশ্চাত্যও পূর্ণভাবে গ্রহণ করছে না, আবার নিজের এই দেশকেও ভাবতে পারছে না তার নিজের জায়গা। ফলে সে শূন্য মাঝামাঝি ভেসে আছে আর তার নিচে আগুনের করাল মুখে হাঁ করে গিলে নেওয়ার জন্য তাকিয়ে আছে মহাশ্মশান—এসব নিয়েই আমাদের পরবর্তী ‘মহাশ্মশান’ অ্যালবাম।
অ্যালবামে নতুনত্ব থাকবে। যেহেতু আমাদের ব্যান্ডের নাম সোনার বাংলা সার্কাস, তাই আমরা চেয়েছি বাংলা লোকসংস্কৃতির যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যবহার করতে। এটা আবার ঠিক কনফিউজিং পাশ্চাত্যের সঙ্গে ফিউশনও না। আমরা বাংলা রক সাউন্ড খোঁজার চেষ্টা করেছি। যেন আমাদের সাউন্ড পৃথিবীর আর কোনো ব্যান্ডের মতো না শোনায়, কেউ যেন না বলে এটা পশ্চিমা অমুক ব্যান্ডের মতো হয়েছে। আমরা এই অ্যালবামের একদম নিজেদের মতো সাউন্ড খুঁজেছি, জানি না কতটুকু পেরেছি, এটা শ্রোতারাই বলতে পারবেন। আমাদের একধরনের প্রবণতা আছে, পাশ্চাত্যের কোনো ব্যান্ডের মতো আমাদের কারও সাউন্ড হলে আমরা খুশি হয়ে যাই। এক শিল্পী কখনোই আরেক শিল্পীর মতো নন। সবাই লেনদেন করে, নিশ্বাস লেনদেনের মতো। কিন্তু কেউ কারও মতো হবে না; আমি আমার মতো হয়ে উঠব, সবাইকে ভেতরে নিয়ে আমার মতো হয়ে উঠব।
বাংলার রক সাউন্ড শুনে পাশ্চাত্য বলবে, ওরা তো আমাদের নকল করছে না। আমাদের সাউন্ড আমেরিকা, ইংল্যান্ডে নেই। আফ্রিকান, লাতিন ব্যান্ড, এমনকি ভারত ও পাকিস্তানে অনেক ব্যান্ড আছে; ওদের গানে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। তাঁদের ভাষা, অ্যাপ্রোচ ওয়েস্টার্নের মতো না। যদিও রক সংগীতে যে গিটার, কি–বোর্ড, ড্রামস, বেজ গিটার—এসব যন্ত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় যন্ত্রও থাকছে, থাকছে স্থানীয় সুরের প্রভাব। যার ফলে তা হয়ে উঠছে এক নির্দিষ্ট এলাকার রক সংগীত, শুধু পশ্চিমা রক সংগীতের অনুকরণ নয়, আর এভাবে তা হয়ে উঠতে পারছে পৃথিবীর গান, পরিশেষে মহাবিশ্বের গান। প্রতিটি গান তৈরি হয়ে ওঠে সেই ভাষার উচ্চারণের ওপর। বাংলা ভাষার উচ্চারণ বলে বাংলা গান এমন, আবার লাতিন ভাষার উচ্চারণ অন্য রকম বলে তা লাতিন গান। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা গান মানেই তা যে খুব আধুনিক তা নয়, বরং তা আধুনিকতার মতিভ্রম, কলোনিয়াল হ্যাংওভার, নিজেকে নিজের মতো মেনে নিতে না পারার হীনম্মন্যতা। যেমন ইংরেজি ভাষার কোনো গান লাতিন বা হিন্দি উচ্চারণে গাইলে তা হাস্যকর শোনাবে, তার শ্রুতি খুবই কিম্ভূত শোনাবে।
এই অ্যালবামে ‘বদ অভ্যাস’ গানটা থাকবে?
প্রবর রিপন: হ্যাঁ। আমাদের সবারই কিছু না কিছু বদভ্যাস আছে। তবে এসব বড় কোনো বদভ্যাস না। যতটা না বড় বদভ্যাস পৃথিবীর বিভিন্ন সিস্টেমের আছে। যেমন যুদ্ধ, অন্যকে শোষণ করা, নিয়ন্ত্রণ করা, মেরে ফেলা, অস্ত্র উৎপাদন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ, দ্রব্যমূল্য ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেওয়া (কেননা মানুষের ব্যবহৃত দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষের জীবনের দাম কমে যায়), অন্যের জায়গা দখল করে নেওয়া, বন কেটে উজাড় করা, নদী মেরে ফেলা, সমুদ্র বিষাক্ত করে তোলা, জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট করা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনেক প্রাণীকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দেওয়া, মন নিয়ন্ত্রণ করা। এই সময়ে এসেও বর্ণবাদীর করালগ্রাস, মানুষকে ছোট করা, শ্রেণিবিভাজন করে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করা, যা মূলত নিজের হীনম্মন্যতার লক্ষণ। দ্বিমত হলে তাকে বিপন্ন করা, সংখ্যালঘুকে নিয়ন্ত্রণ, পাহাড় কাটা আরও কত কত ভয়ংকর বদভ্যাস। যুদ্ধ করছি, মানুষকে বিষণ্নতায় ডুবাচ্ছি, বাধ্য করছি সফলতার মানদণ্ড তৈরি করে কাউকে ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান করে তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে—এসব আরও ক্ষমার অযোগ্য অনেক বড় বদভ্যাস। কিন্তু আমরা সেসবকে বদভ্যাস না বলে ব্যক্তিমানুষের ছোটখাটো বদভ্যাসের দিকে বেশি আক্রমণ করছি। ব্যক্তি মানুষের বদভ্যাস সারানোর প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন পৃথিবীর বড় বদভ্যাসগুলো সারানো। গানটা দিয়ে ওটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি। খুব বড় করে লেখার দরকার ছিল, সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ—যুদ্ধ পৃথিবীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, মানুষ পৃথিবীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অথচ সেসব না করে ছোট ছোট বদভ্যাস নিয়েও মানুষের বেশি মাথাব্যথা।
আপনি রক গানে তারক খ্যাতি পেয়েছেন। বলা হয়, তারকা খ্যাতির আড়ালে শিল্পীরা ব্যক্তিগত জীবন হারিয়ে ফেলেন। খ্যাতি আপনার নির্জনতায় কতটা ব্যাঘাত ঘটায়?
প্রবর রিপন: এখন আমাকে যে পরিমাণ ভালোবাসেন, সেই পরিমাণ মানুষ আগে ভালোবাসতেন না। আবার এখন আমাকে যে পরিমাণ মানুষ অপছন্দ করেন, আগে সেই পরিমাণ মানুষও অপছন্দ করতেন না। আমি আসলে তারকা খ্যাতিতে বিশ্বাসী নয়। ভালো লাগে কিন্তু হয়তো মাঝেমধ্যে একটু ক্লান্তি লাগে। আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন মানুষ আপনার গান শুনবে, আপনার কাজের জন্য চিনবে। আর এখন যেহেতু মোবাইল ফোনের যুগ তাই মানুষ ছবি তুলতে চাইবে। ফলে আমি হুট করে আমি কেন স্টারডম দেখাব? আমি খুব বেশি বিরক্ত হই না, তবে নির্জনতা তো একটু নষ্ট হয়–ই। তবে এটা ঠিক আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের দ্বারা আমি নিয়ন্ত্রিত হই না। আমি আমার মতোই থাকি, নিজে যা ভাবি তাই লিখি এবং গাই, শ্রোতাদের চাহিদা আমাকে আমি যা নই তা বানিয়ে ফেলে না। এখন হয়তো সব জায়গা অকপটে সব কথা বলতে পারি না। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রলের যুগ, ট্রলের ভয়ে হয়তো অনেকেই ভবিষ্যতে শিল্পীজীবন বেছে নিতে চাইবেন না! এত হ্যারাস কে হতে চায়, তারা হয়তো ভাববে তার চেয়ে গোপন একটা জীবন কাটানোই ভালো। মাঝেমধ্যে ভাবি, খেলোয়াড়েরা এগুলো সামলান কীভাবে! ভালোবাসা যখন পান উজাড় করে পান, আবার যখন হ্যারেজড হন, ইচ্ছেমতো হন! কিন্তু এটা ঠিক, শিল্পী হতে যে জন্মেছে, সে শিল্পী হবেই, তাকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না, যতই সে নিগ্রহের শিকার হোক না কেন।
আরেকটা জিনিস আমার ভালো লাগে। যেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের ভেতর কবিতার মৃত্যু ঘটে গেছে। সেখানে আমি যখন স্টেজে গান করি, তখন অনেক শ্রোতা ‘কবিতা’, ‘কবিতা’ বলে চিৎকার করে আমার মুখে কবিতা শুনতে চান। এটা একধরনের প্রাপ্তি, হাজার হাজার লোক ভরা রক কনসার্টে মানুষ কবিতা শুনতে চাচ্ছে, এটা কি বিস্ময়কর নয়? সবকিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই রয়েছে। আমি প্রায়ই বলি, বিখ্যাত হতে চাও হও, কিন্তু শিখে এসো কীভাবে একাকিত্বকে মোকাবিলা করতে হয়। পরিচিত পেলে একাকিত্ব বেড়ে যাবে। আশপাশের মানুষ দূরে সরে যায়। আবার অনেক দূরের লোক কাছে আসে। এর ভেতর দিয়েই কাজ করে যেতে হবে। সুপার লেভেলের স্টারডম তো আমার নেই, আর আমি তেমন কোনো জনপ্রিয় লোকও নই, কিছু মানুষ আমার গান, কবিতাকে ভালোবাসে। তবে সেই জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে কী হবে আমি জানি না, তা নিয়েও ভাবিও না, এসব ভাবনা আমার কাজের ভাবনার সময়কে নষ্ট করবে। নিজের বিপুল অবচেতনকে প্রকাশ্যে আনার জন্য জীবনের আয়ু খুব ছোট। এই যে সামান্য কিছু মানুষ আমাকে ভালোবাসছে, এই তো কত। একজন আগন্তুক অপ্রথাগত শিল্পীর জন্য এটাই তো অনেক!
আপনি একাকিত্বের কথা বলছেন। একাকিত্ব, অবসাদ, বিষণ্নতাকে আপনি কীভাবে মোকাবিলা করেন?
প্রবর রিপন: বেদনাই জীবনবোধকে প্রকট করে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর মানুষ হলেও আপনাকে শূন্য হাতে এখান থেকে হারিয়ে যেতে হবে মৃত্যুর ওপারে। কেন? কেন আমি চাইলেও আমার এই প্রিয় পৃথিবীতে আর এমন মানুষরূপে থাকতে পারব না? এটাই তো বেদনা। আমি আরেকজনের সঙ্গে প্রেমে মিলিত হতে চাইছি, সে তো আরেকটা অস্তিত্ব, সে তাঁর মতো। মিলনের সুতীব্র ইচ্ছে থাকলেও যেহেতু আমাদের জন্ম, জীবন, মৃত্যু আলাদা—তাই আমাদের নিয়তিও আলাদা, মৃত্যু আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাবেই। মনে হচ্ছে এই আমরা দুই মিলে এক হয়ে যাচ্ছি ঠিক, সেই মুহূর্তে মৃত্যুর বিরহ এসে আমাদের আবার বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, এটাই তো মনোজাগতিক বেদনার জায়গা।
আর বাকি বেদনা হলো একদল প্রতাপশালী মানব–হায়েনারা সব মধু খাচ্ছে, বাকি মানুষ খাচ্ছে তাদের ফেলে দেওয়া বিষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ গুটিকয় মানুষের কাছে বন্দী অর্থনীতির শিকলে। তারা আবার প্রকৃতি ও বন উজাড় করছে, পৃথিবীকে ধ্বংস করছে তাদের লালসার পারমাণবিক বোমাতে। আর একজন শিল্পী সব দেখতে পারছেন, বুঝতে পারছেন, অনুধাবন করে বিপুল এই শক্তির বিরুদ্ধে কিছু না করতে পেরে বেদনায় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছেন। তাঁর কিছু না করতে পারার ব্যর্থতাবোধে তাঁর একাকিত্ব আর অসহায়ত্ব আরও প্রকট হয়ে উঠছে। পৃথিবীর সব একা, নিঃসঙ্গ, অসহায় মানুষের যন্ত্রণা তাঁর ওপর ভর করছে, তিনি আরও একা হয়ে পড়ছেন, যেহেতু মরা মাছগুলো সব একসঙ্গে ভেসে যাচ্ছে স্রোতের অনুকূলে, সেটা ভেবে স্রোতের বিপরীতে যেতে গিয়ে তিনি তাঁর একাকিত্বকে আরও প্রকটভাবে চিনতে পারছেন। একজন শিল্পী ঠিক শহরের তীরে থাকা নদীর মতো। ভালোবেসে সে শহরটাকে ঘিরে ধরে রেখেছে আর শহর তাঁকে বিষাক্ত করে দিচ্ছে তার সব বিষে আর বর্জ্যে। বুড়িগঙ্গা নদীকে দেখেন, অথচ নদীই কিন্তু শহরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই বিষের বেদনার সঙ্গে শিল্পী মানে নদীর ব্যক্তিগত বেদনাও আবার আছে। আর এই থেকে মুক্তি নেই, আনন্দ স্বল্পস্থায়ী বলেই যে তা আনন্দ, বেদনা দীর্ঘস্থায়ী বলেই যে তা বেদনা। এ থেকে মুক্তি নেই, আর জীবন চলে এই চক্র মেনেই।
আপনাকে তাড়িত করেন কারা, আপনার মধ্যে কার প্রভাব আছে?
প্রবর রিপন: আমার পূর্বতন অজস্র অজস্র অজস্র শিল্পীর দ্বারাই আমি প্রভাবিত। আমার বাবার সারল্য ও মায়ের মানুষের জন্য কিছু করার প্রবণতাটা আমার মধ্যে আছে। তবে সেটা মায়ের মতো চ্যারিটি নয়, লেখার ভেতর মানুষের দুরবস্থার কথা বলে, অন্যের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠার ভয়ে সত্য লুকিয়ে যাওয়া নয়। আমার লেখায় আমি অপ্রিয় সত্যকে তুলে আনতে ভালোবাসি, তা যতই মানুষকে বিব্রত করুক না কেনো। ওই যে বলছিলাম, হার্টের ডাক্তারের কথা তার মতো, যে আপনার ভালোর জন্যই আপনার রোগের কথা জানিয়ে দেবেনই। আমি শৈশবে গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে কোনো কিছুতে পেরে উঠতাম না। না খেলাধুলা, না সাঁতার, না গাছে ওঠা বা দৌড়। আমার তো কিছু একটা করতে হবে, যা ওরা কেউ পারে না। আমি রেডিও, ক্যাসেটে, টেলিভিশনে যা গান শুনতাম, তাই হুবহু গাইতাম। সেটা হোক সাগর সেন, মুজিব পরদেশী, মাইকেল জ্যাকসন, আবদুল আলীম, ভূপেন হাজারিকা, কবীর সুমন, এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, জেমস ভাই, আইয়ুব বাচ্চু ভাই, শাফিন আহমেদ ভাই, মাকসুদ হক ভাই, কিশোর কুমার, আজম খান, শচীন দেববর্মন, মান্না দে, নচিকেতা, ওয়ারফেজের সঞ্জয় ভাই, আর্কের হাসান ভাই, সুবীর নন্দী ইত্যাদি তখন যা যা শুনেছি। আমি সব গান হুবহু গাওয়ার চেষ্টা করতাম।
কলেজজীবনে ঢাকা আসার পর বব ডিলান, জিম মরিসন, লিওনার্দ কোহেন, রবার্ট প্লান্ট, জেনিস জপলিন, ন্যাট কিং কোল, জিমি হেন্ড্রিকস, সিড ব্যারেট, জন লেনন, জন লি হুকার, বাডি গাই, বিবি কিং, মাডি ওয়াটার্স, লু রিড, লাইটনিং হপকিন্স, পিঙ্ক ফ্লয়েড, রজার ওয়াটার্স, এলভিস প্রিসলি, ফ্রেডি মার্কারি, হাওলিন ওলফ, আন্দ্রে বোচেল্লি, এলিয়া ফিটজেরাল্ড, মহীনের ঘোড়াগুলি, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, ডন ম্যাকলিন, উডি গাথরি, পল রবসন, পিট সিগার, জেমস ব্রাউন, পল সায়মন, রব ফকির, পবন দাস বাউল ইত্যাদি যা যা শুনেছি, সব নিজের ভেতর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। অতীতের দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়ানো সারি সারি সব শিল্পীই আমাকে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো একক শিল্পী নন, অতীতের সব নদী আমার নদীতে এসে তাদের স্রোত রেখে গেছে, যাকে বলে কালেকটিভ আনকনসাস, এমনকি একদিন কুষ্টিয়া থেকে ট্রেনে চড়ে পাংশা যাওয়ার পথে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষে করা সেই অন্ধ গায়কটিও।
সোনার বাংলা সার্কাসের একক কনসার্ট ‘হায়েনা এক্সপ্রেস এক্সপেরিয়েন্স’ প্রশংসা কুড়িয়েছে; পরের কনসার্ট কোথায়?
প্রবর রিপন: বাংলাদেশে যে ধরনের কনসার্টে সেখানে আটটা–দশটা ব্যান্ড নিয়ে কনসার্ট হয়। একটি ব্যান্ড পাঁচ–ছয়টার বেশি গান গাইতে পারে না। কোনো ব্যান্ডের একটা গান অনেক জনপ্রিয় হতে পারে, আবার কোনো গান কম জনপ্রিয়। তবে গায়কের কাছে সব গান সমান। দেখা যায়, অনেক গান কখনোই স্টেজে গাইতে পারেন না গায়ক।
বাইরে দেখা যায়, ব্যান্ডগুলো একক কনসার্ট করে, নিজেরা লভ্যাংশ নেয়। এটা বাংলাদেশে ছিল না, আমরা একক কনসার্ট শুরু করেছি। ভেন্যু না পাওয়ায় খুলনা ছাড়া সব বিভাগীয় শহরে ‘হায়েনা এক্সপ্রেস এক্সপেরিয়েন্স’ করেছি। কোনো শোতে লোকসান হয়নি। এখন এই সলো কনসার্ট অনেক ব্যান্ড শুরু করেছে; যা খুবই ভালো লক্ষণ। আয়োজকদের ওপর নির্ভর না করে ব্যান্ডের স্বনির্ভরশীল হওয়া উচিত, কেননা সব ব্যান্ডের আছে অজস্র শ্রোতা।
আগামী দুই মাসে যশোর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, বগুড়াতে, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়াতে ‘হায়েনা এক্সপ্রেস এক্সপেরিয়েন্স’ করব। মহাশ্মশান বের হওয়ার এক মাস পর ‘মহাশ্মশান যাত্রা’ শিরোনামে আমাদের একক কনসার্ট সারা দেশের সব জেলায় করার পরিকল্পনা আছে, এমনকি কলকাতাতেও। ভারতের কলকাতা, গোয়াতে অনেকবার কনসার্ট করেছি, আবারও যাওয়ার কথা চলছে, কেননা কলকাতাতে আমাদের গান অনেকে ভালোবাসেন। আর এই জুনের শেষের দিকে মালদ্বীপে আমাদের কনসার্ট আছে। এটা ঠিক বাঙালিদের জন্য কনসার্ট না, মালদ্বীপের মানুষের জন্য কনসার্ট হবে একটি স্টেডিয়ামে, মালদ্বীপের মানুষই এটার আয়োজন করেছেন, মানে অন্য ভাষাভাষীর মানুষের জন্য বাংলা গান গাইতে যাচ্ছি, এটা একটা অভিনব অভিজ্ঞতা হবে নিশ্চয়। যদিও মালদ্বীপে যেহেতু অনেক বাংলাদেশি থাকেন, আশা করি তাঁরাও থাকবেন। মালদ্বীপের একটি বিখ্যাত পপ ব্যান্ড থাকবে, থাকবে ভারতীয় একটি গান ও নাচের দল। প্রায় সপ্তাহখানেক থাকব আমরা। আমি খুবই এক্সাইটেড—গান গাওয়ার জন্য নয়, মালদ্বীপ অনেক সুন্দর দেশ বলে আমার এত এক্সাইটমেন্ট, সমুদ্র আমার খুব প্রিয়। আর মহাশ্মশান বের হওয়ার পর এই বছরের শেষে আমেরিকা যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে। আর দেশে তো প্রতি মাসে গড়ে ১০–১২টির মতো কনসার্ট করছিই।
আপনি তো নিয়মিত লেখালেখিও করেন। সামনে আপনার কী বই আসছে?
প্রবর রিপন: এ পর্যন্ত আমার মোট পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কবিতার বই ‘নৈঃশব্দের মৃত্যু’, ‘আমার নাম অসুখ’ এবং ‘গোধূলী ক্যাবারে’। আর একটি কাব্যনাটক ‘লবণখোর’ আর একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘রক্তহ্রদ’। আর এখন আমার প্রথম উপন্যাস লেখার কাজ চলছে, অনেক দূর লেখা হয়ে গেছে নাম ‘ক্যারাভান মর্গ’ যদি লিখে শেষ করতে পারি, তবে আগামী বইমেলায় প্রকাশ করব সম্ভবত।
সাক্ষাৎকারের শেষ ভাগে এসেছি। আপনার অনুরাগীদের জন্য কোনো বার্তা আছে?
প্রবর রিপন: কোনো কিছুর জন্য এত গর্ব বা অহংকার করার কিছু নেই। ‘এটাই সবচেয়ে ভালো, এটা সবার শোনা উচিত; এটা যে শোনে না, সে শ্রোতা হিসেবে খারাপ, এসব না বলাই ভালো। গান কখনো কাউকে জোর করে পছন্দ করানো যায় না। শিল্পীরা কেউ কারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন। শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যুদ্ধের কিছু নেই। আর্ট কোনো প্রতিযোগিতা নয়, এটা খেলাধুলা নয়। আর্টে সবাই অনন্য, সবাই তার নিজের মতো। তাই নিজেকে অনুসরণ করা ভালো। নিজের ভেতর যে অসীম মহাশূন্য আছে, সেদিকে মনোনিবেশ করা উচিত, যেন তার প্রতিটি নক্ষত্র জ্বলে থাকতে পারে, জ্বলে উঠতে পারে। অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেকে অনুসরণ করা ভালো।
আর নিজেকে ভালোবাসো, যেন ঘৃণা তোমাদের হৃদয় দেখে লজ্জায় পালিয়ে যায়। নিজেকে তো সে-ই ভালোবাসতে পেরেছে, যে অন্যকে ভালোবাসতে জানে, অন্যের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারে। আর মহাশ্মশান বের হতে দেরি হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি, কিন্তু নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ১৬টি গান সব অপেক্ষার দুঃখ ভুলিয়ে দেব। আর শোনো আমি তোমাদের ভালোবাসি, নিজেকে ভালোবাসার জন্য আমার এ ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই, কেননা তোমরা যে আছ আমার ভেতরে আর আমিও আছি তোমাদের হৃদয়ে। ভালোবাসা নিয়ো, ভালোবেসে যেয়ো!