‘নজরুলের গান আমাদের প্রতিবাদের ভাষা’
আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম প্রয়াণদিবস। দিনটি উপলক্ষে তিন নজরুলসংগীতশিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা, তানভীর আলম সজীব ও প্রিয়াঙ্কা গোপ–এর সঙ্গে কথা হয়। দিনটিতে তাঁদের ব্যস্ততা, বর্তমান সময়ে নজরুল সংগীতচর্চাসহ নানা প্রসঙ্গে তাঁদের ভাবনার কথা শুনেছেন মনজুর কাদের
এবার ১০ দিন আগে থেকেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণদিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন ফাতেমা তুজ জোহরা। দশকের পর দশক ধরে নজরুলসংগীত চর্চা চালিয়ে যাওয়া এই শিল্পী আজও দুটি অনুষ্ঠানে গাইবেন। গতকাল বিকেলে তিনি বললেন, ‘এবার যে ব্যস্ততা, আশা করিনি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বন্যা—এ নিয়ে দুই মাস ধরে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন স্থবির। তবে ফাতেমা তুজ জোহরা তাঁর মতো করেই ব্যস্ত ছিলেন। আন্দোলনের এ সময়টায় নজরুলের গান আবারও আন্দোলনকারীদের উদ্দীপ্ত করতে দেখা গেছে। প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এ বিষয়টাও নজরে এসেছে তাঁর।
ফাতেমা তুজ জোহরা বললেন, ‘নজরুল আসলে এমন একজন কবি, যিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মনে জায়গা করে নেন। নজরুলের গানের কথা ও সুর সব শ্রেণির মানুষের মনের কথা হয়ে ধরা দেয়। আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসায় সব জায়গায় নজরুলের গান ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি সব জায়গায় জড়িয়ে আছেন। নজরুলের গান বরাবরই ইতিহাসের পাতায় নতুন করে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যখনই অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নে কেউ কথা বলতে পারে না, তখনই নজরুলের গানগুলো সামনে চলে আসে। নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায় তাঁর গানগুলো গাওয়া হচ্ছে। নজরুল সব সময় আধুনিক, চলমানতা, যা সেটাই তিনি। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দাবিদাওয়ার পক্ষেই সব সময় কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁকে বাদ দিয়ে কিছুই চিন্তা করা যায় না।’
জুলাইয়ের শেষ দিকে সংগীতবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারতে যান তানভীর আলম সজীব। কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় পাঠাগারে তিন দিনব্যাপী ইন্ডি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সংগীত বিভাগের কিউরেটর ছিলেন তিনি। এরপর গানের আরও কিছু কাজ ছিল। গতকাল ঢাকায় ফেরার পথে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। আগামীকাল বুধবার চ্যানেল আইয়ে গান গাইবেন। একই দিনে আরেকটি চ্যানেলে গাইবেন বলেও জানালেন।
দেশের বাইরে থাকলে ছাত্র–জনতার আন্দোলন ও বন্যার সব খবরাখবর ওখান থেকে পেয়েছেন তিনি। আন্দোলনে নজরুলের গান যে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়েছে, তা–ও নজরে এসেছে। সজীব বললেন, ‘নজরুল তাঁর জায়গায় চিরকাল থাকবেন। তিনি একজন কালজয়ী একজন ব্যক্তিত্ব। শুধু এ সময় নয়, নজরুলের গান সব সময়ই প্রাসঙ্গিক।
আমি তাঁর একজন অনুসারী মাত্র, তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা শতভাগ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ও নজরুলসংগীতশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ বন্যার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ছুটির দিন ছাড়া নিয়মিত তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। নজরুল প্রয়াণদিবসে আগামীকাল দেশ টিভি ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে গানের অনুষ্ঠানে অতিথি। ফাতেমা তুজ জোহরা ও সজীবের মতো প্রিয়াঙ্কারও চোখ এড়ায়নি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নজরুলসংগীতের প্রাণের সঞ্চার করার বিষয়টি।
প্রিয়াঙ্কা গোপ বললেন, ‘যেকোনো বিষয়ে নজরুলের গান, কবিতা ছাড়া আমরা ভাবতে পারি না। নজরুলের গান, কবিতাই আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে আছে, সেটা রাজপথ হোক কিংবা অন্য কোথাও। এটা খুবই প্রাসঙ্গিক, নজরুলের কথা ও সুর তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে দারুণভাবে উঠে আসছে। কারণ, তারুণ্যের কবি নজরুল। এই প্রয়াণদিবসে কবিকে শ্রদ্ধা জানানোর একটা বড় জায়গা হচ্ছে, আবার কবি তরুণদের কণ্ঠে ও মনে স্থান করে নিয়েছেন। এটাই আমার কাছে আনন্দের।’
নজরুলসংগীতের চর্চা এখন আগের চেয়ে বেড়েছে মনে করছেন ফাতেমা তুজ জোহরা। তিনি বললেন, ‘আমরা আগে নজরুলসংগীতের স্টেজ শো করতাম, দর্শকের সামনে হাজির হতাম। এখনকার শিল্পীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। দর্শকের চাহিদা বা যারা আয়োজক, তারা দর্শকের জন্য আধুনিক গান যেভাবে উপস্থাপন করে, নজরুলের গান সেভাবে মোটেও হয় না। তখন আমরা মাঠে–ময়দানে, মেলায় তখন নজরুলসংগীত গাইতাম। এখন সেই মঞ্চ নেই। সে কারণে নজরুলের গান এখন কম হয়, এমনটা ভাবছি আমরা। রাষ্ট্র এবং পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে হবে। শিল্পীরাও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।’
দেশে নজরুলসংগীতের চর্চা ভালোই হচ্ছে মনে করছেন সজীব। তিনি বলেন, ‘নজরুলসংগীত নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নজরুলগীতির ধারক ও বাহক কিন্তু কেউ নয়। যাঁরাই শিল্পী, তাঁরা নজরুলের গানের ধারক ও বাহক। এখানে কেউ কাউকে কর্তৃত্ব করতে আসেনি কিন্তু। গানবাজনায় কর্তৃত্ব করাটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। গানবাজনা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, উপলব্ধির বিষয়। তাই আমি বলতে চাই, নজরুলসংগীতকে অন্যভাবেও উপস্থাপন করা যায়, মনকে প্রসারিত করে একবার শুনে দেখুন না প্লিজ। সেভাবে করতে দেওয়ার সুযোগটা যেভাবে হওয়া দরকার, হচ্ছে না।’
আক্ষেপের কথা বলতে গেলে সবাইকে দোষারোপ করতে হয়, তা চান না প্রিয়াঙ্কা গোপ। যাঁরা নজরুলকে ভালোবাসেন, তাঁরা নজরুলের চর্চা এভাবেই চালিয়ে যান, এটাই চান তিনি। প্রিয়াঙ্কা বললেন, ‘নজরুল কখনোই পেছনের সারির মানুষ ছিলেন না, তিনি মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস সব সময় করেছেন। নজরুলকে ভালোবেসে অনেকে চর্চা করছেন—কিন্তু এসব কাজের প্রচার হয় কম। গণমাধ্যম যদি আরও বেশি বেশি প্রচারণ করে তবেই সাধারণ মানুষও বুঝবে, আমরা নজরুল নিয়ে কাজ করছি। আদতে অনেকেই গান শিখছে, কবিতা করছে। এটা ফলাও করে করে প্রচার হয় না। এসব করলেই বোঝা যাবে, বাংলাদেশে কতটা চর্চা হচ্ছে।’