স্মৃতিমেদুর ছেলেবেলার খোঁজে

গাইছেন অঞ্জন দত্ত, গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা অ্যারেনায়। ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ থেকে ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’—তাঁর গান বৃষ্টিপ্রিয় বাঙালিকে স্মৃতিকাতর করেছে বারবার। সেই অঞ্জন গাইবেন ঢাকায়, আশ্চর্যজনকভাবে গত শনিবার দিনটাও শুরু হয়েছিল বৃষ্টি দিয়েই। তবু চাওয়া ছিল বৃষ্টিবিহীন সন্ধ্যা। কারণ, প্রিয় গায়কের গান যেন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়। সন্ধ্যায় বৃষ্টি আসেনি, অঞ্জন এসেছিলেন। গান আর কথার জাদুতে উপহার দিয়েছেন মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যা। সঙ্গে আহমেদ হাসান সানি আর কাকতালের দারুণ পারফরম্যান্স তো ছিলই।

কনসার্টে আসা দর্শকের ভিড়। প্রথম আলো

শনিবার সন্ধ্যায় ‘অঞ্জন দত্ত মেট্রোপলিস ভলিউম-২.০’ নামে কনসার্টটি হয় পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে-সংলগ্ন ৩০০ ফিটের ঢাকা অ্যারেনায়। অঞ্জনকে নিয়ে এই কনসার্টের আয়োজন করে যৌথভাবে অ্যাসেন, জির্কুনিয়ামি ও আর্কলাইট ইভেন্টস। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন সূচনা।

আরও পড়ুন

মাঠে কনসার্ট, খোলা জায়গা, প্রচুর গাছপালা আর খোলা হাওয়া উসকে দিচ্ছিল ছেলেবেলার স্মৃতি। হালে রাজধানীর বেশির ভাগ কনসার্টে তরুণদেরই দেখা মেলে বেশি। তবে এদিন বয়োজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। অঞ্জনের গান শুনে বড় হওয়া সেই প্রজন্ম যে এসেছে ফেলে আসা স্মৃতিমেদুর ছেলেবেলার খোঁজে, মালুম করতে অসুবিধা হয় না।

সন্ধ্যা সাতটায় কনসার্টের শুরুটা হয় স্থানীয় দুই শিল্পী নূর আর সৌরভের গান দিয়ে। ঠিক ৭টা ২১ মিনিটে মঞ্চে ওঠেন হালের জনপ্রিয় শিল্পী আহমেদ হাসান সানি। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর রোদচশমা, সানিকে দেখেই ‘দিওয়ানা’ ভক্তরা। গায়ক শুরুটা করেন অবশ্য দুঃখের আবহে। কারণ, এদিন সকালেই জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অড সিগনেচার ব্যান্ডের লিড ভোকাল তানভীর আহাসান পিয়াল।

আহমেদ হাসান সানি। ছবি: প্রথম আলো

পিয়ালকে উৎসর্গ করে সানি যখন ‘আমারে চাও’ গাইছেন, দর্শকদের কেউ কেউ হয়তো আকাশে সদ্য প্রয়াত গায়ককেই খুঁজছেন। এরপর একে একে ‘আমরা হয়তো’, ‘আমি আর আসব না বলে’সহ নিজের শ্রোতৃপ্রিয় গান শোনান তিনি। শেষটা করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লাস্ট ডিফেন্ডারস অব মনোগামী’ সিনেমার ‘মানুষ কেন এ রকম’ দিয়ে। আলোচিত গানটি এদিনই প্রথম লাইভে পরিবেশন করেন তিনি।

সানির গানে খুঁজে পাওয়া যায় শহরের গল্প। জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুয়ীজ মাহফুজ, বব ডিলানরা ফিরে ফিরে আসেন বারবার। সন্ধ্যার মৃদু বাতাস যেন গানের আবেদন আরও বাড়িয়ে দেয়। গানের সঙ্গে রাকিবের এসরাজ যোগ করে ভিন্ন মাত্রা।

আরও পড়ুন

রাত ৮টা ৫০ মিনিট। তুমুল করতালির মধ্যে মঞ্চে আসেন অঞ্জন দত্ত। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গায়ক প্রথমেই দেন একটি দুঃসংবাদ। তিনি অসুস্থ, চিকিৎসকের বারণ উপেক্ষা করেই এসেছেন ঢাকায়! পিঠের ব্যথায় কাবু এই গায়ক বসেই গান করবেন, এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নেন বারবার। তবে তিনি যখন পরিচিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘এই পোড়া শহরে’, দর্শক তখন গানে ডুবে গেছেন; অঞ্জন দাঁড়িয়ে না বসে গাইছেন, তা নিয়ে আর কে মাথা ঘামায়! তিন দশক ধরে গাইছেন, এই ৭১ বছর বয়সেও যেভাবে মঞ্চে নিজের ‘দাপট’ ধরে রেখেছেন, তাকে সমীহ না করে উপায় কী!

অঞ্জন দত্ত। আয়োজকদের সৌজন্যে

‘এই পোড়া শহরে’ গানটি শুক্রবার মুক্তি পাওয়া মৃণাল সেনকে নিয়ে অঞ্জনের নতুন সিনেমা ‘চালচিত্র এখন’-এর। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ের কল্যাণে সিনেমাটি দেখা যাচ্ছে দুই বাংলাতেই। এর পরিচালক অঞ্জন, সিনেমায় মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি। অঞ্জন স্মরণ করেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া তাঁর গুরু মৃণালকে। তবে এদিনের সন্ধ্যায় তিনি কেবলই গায়ক। সেই অঞ্জন, যিনি অকপটে বলে দেন, তিনি গান শেখেননি; গান নিয়ে বেশি কিছু ভাবেননি। অথচ সেই গানের কারণেই তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন।

মাঝে খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে অঞ্জন একে একে গেয়ে শোনান ‘ম্যারি অ্যান’, ‘বেলা বোস’, ‘খাদের ধারের রেলিংটা’, ‘রঞ্জনা’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’। গানের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক গল্পও করছিলেন; বলছিলেন, তাঁর গানের ভক্তদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি। তাঁর ভাষ্যে, ‘৫০ থেকে ৬০ ভাগ।’ এক ফাঁকে কথা বলেন অঞ্জনের পুত্র গায়ক ও সংগীত পরিচালক নীল দত্ত।

নীল দত্ত। আয়োজকদের সৌজন্যে

মঞ্চে গিটারে ছিলেন নীল, বাবার সঙ্গে গলাও মেলান তিনি। মাঝে শোনান ১৯৯৯ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে আসার স্মৃতি। প্রয়াত গায়ক আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে তিনি যখন ‘তুমি কেন বোঝো না’ ধরেন, শ্রোতাদের মধ্যে নিজের অজান্তেই চলে আসে মন খারাপের ভাব। এরপর বাবা-ছেলে মিলে যখন ‘চ্যাপটা গোলাপ’ ধরেন, তখন আবার চাঙা ভাব ফিরে আসে, কারও হয়তো মনে পড়ে পুরোনো প্রেমের কথাও।

অঞ্জনের গান ছাড়াও দর্শক-শ্রোতাদের নজর কাড়ে অমিত দত্তর গিটার। আয়োজকদের সৌজন্যে

এদিন অঞ্জনের গান ছাড়াও দর্শক-শ্রোতাদের নজর কাড়ে অমিত দত্তর গিটার। কলকাতার এই প্রখ্যাত গিটারবাদক এদিন অনেকটা সময় শ্রোতাদের কেবল জাদুবন্দী করে রেখেছিলেন নিজের গিটারের সুরে।

মঞ্চের সামনে চলে এসে গায়কের ছবি তোলার চেষ্টা—সাম্প্রতিক সময়ের কনসার্টগুলোর সাধারণ প্রবণতা। বিষয়টি নিয়ে এদিন বিরক্তি প্রকাশ করেন অঞ্জনও। তবে প্রিয় গায়কের কথায় এদিন দ্রুতই মঞ্চের সামনের জায়গাটা ফাঁক হয়ে যায়। অঞ্জন তখন ‘মালা’ গাওয়ার জন্য প্রস্তুত। দিনটা ছিল ১১ মে, তাই গানটি শোনার জন্য অনেক আগে থেকেই দর্শকসারি থেকে ‘মালা’, ‘মালা’ অনুরোধ আসছিল। একপর্যায়ে অঞ্জন রসিকতা করে বলেন, ‘শুনেছি, আমরা তো কেউ কালা নই।’ ‘তোমার জঙ্গলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি/ তোমার পিসি চন্দ্রের ঝুমকো কানের দুল,/ আজ বারোই মে তাই সকাল থেকে/ জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল।’ অঞ্জন যখন ‘মালা’ গাইছেন, তখন গানে বুঁদ অনেকেই হয়তো মনে করছেন নিজেদের ‘মালা’কে। তবে ‘মালা’কে নিয়ে আসল চমকের তখনো বাকি, অঞ্জনের গানের শেষের দিকে মঞ্চে আনা হয় বড় কেক। কেক কেটে ‘মালা’র আগাম জন্মদিন উদ্‌যাপন করেন অঞ্জন স্বয়ং।

গাইছে কাকতাল। প্রথম আলো

রাত ১১টার দিকে মঞ্চে ওঠে হালের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘কাকতাল’। শুরুতেই বাঁশির পরিবেশনা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। ‘লাশকাটা ঘরে’, ‘ঘরছাড়া (আজিমপুর কলোনি)’ গাইতে গাইতে ব্যান্ডটি শোনায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কীভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়! সে আরেক গল্প।

রাত সাড়ে ১১টার কিছু পর, ঘরে ফেরা মানুষেরা তখন ব্যস্ত গুনগুন করতে করতে। অঞ্জনের ‘ঘরে ফেরা হয়নি আমার’ কি গাইছিলেন তাঁরা? গান আর সুরের জাদু মিলিয়ে যে ‘ঘর’ তৈরি হয়, সেখান থেকে নিজের ঘরে ফেরা যায়?