গানে গানে যুদ্ধহীন পৃথিবী চেয়েছিলেন তিনি
১৯৭১ সালে বিশ্বব্যাপী হানাহানির মধ্যে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল জন লেননের ‘ইমাজিন’ গানটি। রক অ্যান্ড রোলসের সেই ঝাঁকানাকা যুগে আড়ম্বরহীন সাদাসিধে এ গানই কথার জোরে কাঁপিয়ে দিল পুরো বিশ্বকে। আজ জন লেননের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে থাকল এই আয়োজন।
লিভারপুলে জন্ম। জাহাজঘাটের ছেলেটি জীবনকে ছুড়ে দিল গানে। ষাটের দশকে সংগীতজগৎকে মাতিয়ে তোলা চার তরুণ তুর্কির একজন লেনন। বিটলস হিসেবে আমরা যাঁদের চিনি। প্রায় এক দশক ধরে আশ্চর্য সব গান করার পর একসময় ভেঙে গেল বিটলস, শুরু হলো লেননের একলা পথচলা। সঙ্গী স্ত্রী ইয়োকো ওনো। সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। ১৯৭১ সাল। যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত বিশ্ব। গানে শান্তির পায়রা ওড়ালেন লেনন। জন্ম নিল ‘ইমাজিন’।
এই গানে আসলে কী চেয়েছেন লেনন? চেয়েছেন এমন এক পৃথিবী, যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, নেই ক্ষুধা বা দারিদ্র্য, নেই মানুষে মানুষে বিভেদ। এমনকি নেই কোনো ধর্ম, স্বর্গ বা নরক। এক আকাশের নিচে সব। নেই কোনো সীমান্তরেখা। ৫০ বছর আগে লেখা সেই গানের প্রাসঙ্গিকতা কি আজকের দুনিয়ায় কোনো অংশে কম? আমরা কি পেয়েছি লেননের কাঙ্ক্ষিত সাম্যের পৃথিবী?
সত্তর দশকের শুরুর দিকে গানটি লিখেছিলেন লেনন। সেটি ছিল লেননের ক্যারিয়ারের অদ্ভুত এক সময়। বিটলস ভাঙছে। স্ত্রীর জন্মদিনে উপহার হিসেবে একটি সাদা পিয়ানো নিয়ে এলেন লেনন। সেই পিয়ানোতেই তৈরি হলো ‘ইমাজিন’–এর সুর। তাঁর স্ত্রী ইয়োকো ওনোও শিল্পী। গানের কথা ও ধারণায় ওনোর কাছে প্রচণ্ড ঋণী লেনন। কিংবা বলা যায়, তখন দুজনের যৌথ চিন্তার ফসল যেন এই গান। গান লেখার সেই সময়কে এভাবে স্মরণ করেন লেনন, ‘এই গান মূলত ইয়োকোর গ্রেপফ্রুটের অনুপ্রেরণায় লেখা। বইটির মধ্যে অনেকগুলো জায়গায়ই এটা বলা ছিল, “ইমাজিন দিস, ইমাজিন দ্যাট”।’
ইয়োকো ওনোর ভাষায়, ‘জন ও আমি দুজনই শিল্পী। ও প্রতীচী, আমি প্রাচ্য। আমরা একসঙ্গে থেকেছি। আমরা পরস্পরের অনুপ্রেরণা। আর “ইমাজিন” গান জানিয়ে দেয়, আমরা একসঙ্গে কী ভাবছি।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। ভিয়েতনামে তখনো যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে মত্ত। আর লেনন তখন বিশ্বকে একটা ভিন্ন চোখে দেখার স্বপ্ন বুনছেন। ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থ ও খ্যাতিকে পাশ কাটিয়ে শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। তবে এটাই তাঁর প্রথম শান্তির সন্ধান নয়। ষাটের দশকের শেষ থেকেই মানবতার পথ খুঁজছিলেন লেনন। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র–ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে লিখলেন ‘গিভ পিস আ চান্স’ (শান্তিকে দাও একটা সুযোগ)। সেই ধারাবাহিকতারই পরিণতি যেন একাত্তরের ‘ইমাজিন’।
বলে রাখা ভালো, সেই সময়ের জীবনযাপন যে তাঁর গানে প্রতিভাত হতো, তার বড় উদাহরণ ‘বেড–ইন ফর পিস’। এই কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন ধরনের প্রতিবাদ শুরু করেন লেনন-ওনো, যেখানে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের অন্তরঙ্গ সব খুঁটিনাটি খোলামেলাভাবে দেখতে সবাইকে নিজেদের শোবার ঘরে আমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁরা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে এটাও ছিল তাঁদের এক অভিনব প্রতিবাদ। শান্তির পথে দুজনের এমন সব চিন্তার ফসলই কি জন্ম দিয়েছিল ‘ইমাজিন’?
পরের ৫০ বছর এই গান শুধু আমজনতাকেই প্রভাবিত করেনি, বিখ্যাত সব শিল্পীর কণ্ঠেও বারবার ধ্বনিত হয়েছে। ‘কাম ফ্রম দ্য শ্যাডোজ’ অ্যালবামে গানটি গেয়েছিলেন জোয়ান বায়েজ। ২০০৫ সালে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে ম্যাডোনা গেয়েছিলেন এই গান। এভাবে বিশ্ব যখনই শান্তির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, হাতিয়ার হয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় ‘ইমাজিন’। দিন দিন হয়ে ওঠে শান্তির প্রতীক। দেশে দেশে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সমান্তরালে মানুষ গ্রহণ করেছে এই গান।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের একটি কথা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে আপনি শুনে থাকবেন, জাতীয় সংগীতের সঙ্গে প্রায় সমানতালে গাওয়া হয় “ইমাজিন”।’
১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর নিজেরই এক ভক্ত মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের গুলিতে মারা যান জন লেনন।