নাইটক্লাব থেকে শুরু, অপ্রচলিত নারী কণ্ঠস্বর তাঁর অনন্য পরিচয়
পোশাক-স্টাইল-গান গাওয়ার ভঙ্গি—সবকিছুইতে চমক। অপ্রচলিত নারী কণ্ঠস্বর তাঁর অনন্য পরিচয়। ষাট থেকে আশির দশকের সময় ঊষা উত্থুপের গলাতেই ভারতের শ্রোতারা শুনেছিলেন পপ, চলচ্চিত্রের গান থেকে শুরু করে জ্যাজও। বলিউডে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফল। সব আসরে তাঁর একটি গান থাকেই থাকে, কলকাতা কলকাতা ডোন্ট ওরি কলকাতা...।
আজ ৭ নভেম্বর মঙ্গলবার ঊষা উত্থুপের জন্মদিন। ৭৬ বছরে পা দিলেন শিল্পী। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একজন প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও তাঁর জনপ্রিয়তা শীর্ষস্থানে। বয়স যে তাঁর কাছে ‘শুধুই একটা সংখ্যা’, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজও স্টেজ শো থেকে প্লেব্যাক—কোথাও ব্যস্ততা কমেনি তাঁর। অনেক ভাষায় গান গেয়েছেন শিল্পী। বলা হয়, ভারতের প্রথম নারী পপশিল্পী। ৫০ বছর ধরে দেশে-বিদেশে গানের জগতে রাজ করছেন। গেয়েছেন বহু বলিউড ছবিতে। ২০১১ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন গায়িকা। তাঁর কণ্ঠে ‘হরি ওম হরি’, ‘রাম্বা হো’, ‘জিতে হ্যায় শান সে’র মতো অজস্র হিট গান শ্রোতারা দশকের পর দশক ধরে উপভোগ করে গেছেন। ভারতের একাধিক আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও গান গেয়েছেন ঊষা। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। ‘সাত খুন মাফ’, দক্ষিণি ছবি ‘মাম্মুতি’ উল্লেখযোগ্য।
ছোটবেলা থেকে টমবয় টাইপ ছিলেন। পেয়ারাগাছে চড়তেন এবং ঘুড়ির জন্য ‘মাঞ্জা’
দিতেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এসব গল্প নিজেই করেছেন তিনি। শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মুম্বাইতে (তখন বোম্বে) এবং আমি ক্লেয়ার রোডের বাইকুল্লার কনভেন্ট অব জেসাস অ্যান্ড মেরি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করি। আমি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তর্গত এবং বাইকুল্লার ক্লেয়ার রোডে থাকতাম। আমার বাবা পুলিশ বাহিনীতে ছিলেন এবং আমরা বিশাল ব্রিটিশ প্যাভিলিয়নে থাকতাম। আমরা খুব সাধারণ মানুষ ছিলাম।
আমি ছয় সন্তানের পরিবার থেকে এসেছি। পরিবারে আমি ৫ নম্বরে। আমরা খুব মিতব্যয়ী জীবনযাপন করতাম, বাবার স্বল্প বেতনের চাকরি। আমি মনে করি, যখন একটি শিশু এমন পরিস্থিতিতে বড় হয়, তখন সে জিনিসের মূল্য বুঝতে পারে। আমার মনে আছে, রাইকার নামে আমাদের একজন চমৎকার মারাঠি শিক্ষক ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে মারাঠি ভাষায় কথা বলেছি এবং অনেক মারাঠি গান গেয়েছি।
একাডেমিকভাবে আমি সব ভাষায় খুব ভালো ছিলাম। কারণ, স্কুলে পাঠদানের মাধ্যম ছিল ইংরেজি, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, তৃতীয় ভাষা মারাঠি, চতুর্থ ভাষা ছিল ফরাসি এবং বাড়িতে আমরা তামিল বলতাম। কিন্তু আমি মনে করি, আমার মারাঠি ভালো।
আমি ভাষা, ইতিহাস এবং ভূগোলেও খুব ভালো ছিলাম, কিন্তু আমি গণিতে খুব খারাপ ছিলাম। আমি বিজ্ঞানেও খারাপ ছিলাম। কিন্তু সেই দিনগুলোতে, আমি স্কুলে ৮২ শতাংশ স্কোর অর্জন করেছি, এটি সত্যিই বড় কিছু। তা ছাড়া আমার শৈশব কেটেছে রেডিও শুনে।’
তবে প্রথম জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন, ভুল করেছেন, হোঁচট খেয়েছেন, কেঁদেছেন। সবকিছু জয় করে জীবনে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নানা সময়ে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, খুব ছোট বয়স থেকেই আয়ের চেষ্টা করতে হয়েছিল তাঁকে। সংগীতজীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে ঊষা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দিল্লিতে একটা নাইটক্লাবে দেব আনন্দ গান শুনতে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে এই দেখা হওয়াটা আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। খুবই রোমাঞ্চিত ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি তাঁর ছবি ‘হরে রাম, হরে কৃষ্ণ’তে কাজ করব কি না। এরপর আমি রাহুল দেববর্মন, বাপ্পি লাহিড়ীর মতো সংগীত পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছি।’ এর আগে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদকের কাছে ‘দ্য কুইন অব ইন্ডিয়ান পপ’ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি ব্যক্তিগত নানা ঘটনা তুলে ধরেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক সাক্ষাৎকারে ঊষা বলেন, ‘গানের শিক্ষক ভেবেছিলেন, আমি মোটেই গায়িকা হতে পারব না। সংগীতে অতটা দখলই নেই আমার। এমনকি আমাকে বিশেষ ক্লাসগুলোতে থাকতে দিতেন না। বিশ্বাস করুন, বছরখানেক বাদে এক অনুষ্ঠানে আমি যখন গাইছিলাম, তখন আমার শিক্ষক বসেছিলেন দর্শকের আসনে।
মঞ্চ থেকে নেমে যখন মুখোমুখি হয়েছিলাম, দুজনের চোখেই তখন পানি ঝরছিল। তবে আমার মন খারাপ হয়নি কখনো। কিংবা গানের ক্লাসে না ঢুকতে পারার বেদনা আমাকে টেনে নিচে নামিয়ে দেয়নি। বরং আরও ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভেতরে জেদ কাজ করেছে।’ ঊষা আরও বলেন, ‘আমি ভালো না খারাপ গায়িকা, সেটা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি যে আমি শতভাগ মৌলিক শিল্পী।’ তাঁকে নিয়ে ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক হয়েছিল। সেসব থেকে সব সময় দূরেই থেকেছেন তিনি। এসব প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভেবেই কী অদ্ভুত লাগত যে আমার মতো সাধারণ একজন মেয়ে যে কিনা একেবারে মাটির মানুষ, ঘরোয়া প্রকৃতির, নাইটক্লাব সিঙ্গারের ভাবমূর্তির সঙ্গে একেবারে কোনো রকম মিলই ছিল না, সেই আমাকেও কিনা নিষিদ্ধ করার জন্য রাজনৈতিক ময়দানের লোক উঠেপড়ে লেগেছিল।’
মুম্বাইয়ে ঊষা উত্থুপের বেড়ে ওঠা হলেও কলকাতাই তাঁর বড় প্রিয় শহর। তাঁকে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, কপালে ‘ক’ লেখা বড় একটি গোল টিপ। শোনা যায়, কলকাতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই কলকাতার আদ্যক্ষর লেখা টিপ পরেন তিনি।