আমাকে যেন ভুলে না যাও...
২০১৮ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করে নিজেকে ভক্ত-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন বরেণ্য শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে বসে নিজের তোলা ছবিটি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও…তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ ছবিটি পোস্ট করার পরই ফেসবুক বন্ধু ও ভক্তরা তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান। আগের দিন ১ জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। ঠিক ২১ দিনের মাথায় হঠাৎ করেই গান, প্রিয়জন আর গৌরবময় একটা জীবন ফেলে তিনি চলে গেলেন অজানায়।
এই জানুয়ারি মাসে তাঁর জাগতিক ভ্রমণ শুরু ও শেষ। বিগত কয়েকটা দিন সংগীতাঙ্গনের অনেকেই স্মরণ করেছেন প্রিয় এই মানুষকে। অনেকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সর্বশেষ পোস্ট করা ছবিটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আপনাকে ভুলিনি, স্যার।’
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ওয়াফিজ আহমেদ ও মাতার নাম ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট উচ্চবিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং শিক্ষাজীবনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুলে থাকা অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় তিনি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর বুলবুল ও তাঁর বন্ধুরা মিলে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন। তাঁদের ঘাঁটি ছিল ঢাকার জিঞ্জিরায়। জুলাইয়ে বুলবুল ও তাঁর বন্ধু সরোয়ার মিলে নিউমার্কেটের ১ নম্বর প্রবেশমুখের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লরিতে গ্রেনেড হামলা করেন। আগস্টে ভারতের আগরতলায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বুলবুল। ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে একটি গেরিলা দল গঠন করেন।
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। তখন আমার বয়স সাড়ে ১৪ বছর। আগরতলায় আমরা প্রশিক্ষণ নিই। মনে পড়ে, আমরা চারজন একসঙ্গে রেকি করতাম—মানিক, মাহবুব, খোকা আর আমি। কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কে পাকিস্তানি হানাদাররা কতগুলো দুর্গ করেছে, সেগুলো দেখে আসতাম। একসময় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম, ওরা আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিয়মিত গান করেন। প্রথমে শুধু দেশের গানই করতেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন গিটারবাদক ছিলাম। যুদ্ধের দিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই রোমহর্ষক দিনগুলোর স্মৃতি, হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। যাঁদের হারিয়েছি, অনুভব করলাম, তাঁদের জন্য কিছু করা দরকার। সেই থেকে টানা আট বছর আমি শুধু দেশের গান করেছি। অন্য গান করিনি।’
১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রের গীত রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। সেই চলচ্চিত্রের তাঁর লেখা ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকব’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
বুলবুল স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, জেমস, খান আসিফুর রহমান আগুন, কনকচাঁপা, মনির খানসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীকে নিয়ে কাজ করেছেন। সংগীত প্রতিভা অন্বেষণে বাংলাদেশের রিয়েলিটি অনুষ্ঠান ‘ক্লোজআপ ওয়ান’–এর তিন মৌসুমে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই বরেণ্য শিল্পী।
তিন শতাধিক সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেছেন। দুবার বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথমটি ‘প্রেমের তাজমহল’ এবং দ্বিতীয়টি ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য।
বুলবুলের সুর করা প্রায় সব কটি দেশের গানের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। এর মধ্যে প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী থমকে দাঁড়াল’, ‘এই দেশটা আমার স্বপ্নে বোনা নকশিকাঁথার মাঠ’, ‘যুদ্ধ এখনো থামেনি তাই তো তোমার ছেলে আসেনি’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখো গো মালি’ (এ গানের শিল্পী রুনা লায়লা)। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘আমার বাজান গেল কই বাজার থিকা আনতে গিয়া চিড়া মুড়ি দই’, ‘একদিন ঘুম ভেঙে দেখি তুমি নাই’, ‘ওকে আর করল না তো কেউ বিয়ে’। তাঁর সুর করা আরও গানের মধ্যে আছে মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, এস এম হেদায়েতের লেখা ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’ এবং তাঁর নিজের লেখা ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘ওগো বীর মুক্তিযোদ্ধা লও লও মুক্তির ফুল’, ‘আয় আয় আয়রে মা আয়রে আমার কোলে’ ইত্যাদি।
২০১৮ সালের ১৬ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অসুস্থতার খবর দেন বুলবুল। সেদিন তিনি লিখেছেন, ‘একটি ঘরে ছয় বছর গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অসুস্থ। আমার হার্টে আটটা ব্লক ধরা পড়েছে। এরই মাঝে কাউকে না জানিয়ে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে সিসিইউতে চার দিন ছিলাম। আগামী ১০ দিনের মধ্যে হার্টের বাইপাস সার্জারি করানোর জন্য প্রস্তুত আছি।’ চিকিৎসা চলছিল। পরে অবশ্য বাইপাস নয়, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হৃদ্যন্ত্রে দুটি স্টেন্ট পরানো হয়। তারপর সবকিছু ব্যর্থ করে ৬৩ বছর বয়সে ঢাকার আফতাবনগরে তাঁর নিজ বাসায় হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হঠাৎ চলে যাওয়ায় আক্ষেপ চিরদিন থেকে যাবে অনুরাগীদের মাঝে। কিন্তু তাঁর সুর দেওয়া বহু গান টিকে থাকবে অনেক দিন। সেগুলোর মধ্য থেকে যাবে অকালে চলে যাওয়া বরেণ্য এই গানস্রষ্টার নাম।