গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহের যেসব ভিডিও প্রশংসা কুড়াচ্ছে
হাতে সদাইপাতি নিয়ে বাজার থেকে ফিরছিলেন এক প্রৌঢ়। পথিমধ্যে একদল তরুণের সুরে নিজেকে জুড়ে নিলেন। লালনের ‘জাত গেল জাত গেল বলে’ গানে প্রাণ মেলানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন মাগুরার মেয়ে নাফিসা নাওয়ার নিঝুম। তিনি লিখেছেন, ‘পথে নামলে বোঝা যাচ্ছে, আমরা লালনের মাটিতেই থাকি।...একজন অপরিচিত মানুষ যোগ দিলেন।’
মাগুরার তরুণদের সঙ্গে বাজারফেরত সেই প্রৌঢ়ের গান পরিবেশনার ভিডিওটি প্রশংসা কুড়িয়েছে। ২১ ঘণ্টার ব্যবধানে ৩৪ লাখেরও বেশিবার ভিডিওটি দেখা হয়েছে। সাবলীল পরিবেশনার গানের ভিডিওটি অনেকের হৃদয় ছুঁয়েছে। ভিডিওটি দেখে সায়ন নামের এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘অজান্তেই চোখের কোনায় পানি চলে এলো।’
ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের ১১ জেলার বন্যার্তদের জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ত্রাণ তহবিল সংগ্রহ করছেন তরুণেরা। ত্রাণ সংগ্রহে ঢাকায় কনসার্টও হয়েছে; ঢাকার বাইরে মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় গান গেয়ে ত্রাণ সংগ্রহের খবর মিলছে।
গত শুক্রবার থেকে মাগুরার মোড়ে মোড়ে ত্রাণ সংগ্রহ করছেন জনা পঁচিশেক স্থানীয় তরুণ। তাঁদের বেশির ভাগ গান করেন, কেউ কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগের পেছনের গল্প শোনালেন মাগুরার তরুণ শায়েখ উদ্দিন সোহান। আজ রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এই ক্রান্তিকালে কীভাবে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো যায়, তা নিয়ে কয়েকজন মিলে আলাপ করছিলাম। আমরা গান করি। গানটাই তো আমাদের সম্বল। সেই গান নিয়ে কিছু করতে পারি কি না, সে ভাবনায় থেকেই এ উদ্যোগ নিয়েছি।’
গানকে সম্বল করে ত্রাণ তহবিল সংগ্রহে রাস্তায় নেমেছেন তরুণেরা; কারও হাতে গিটার, কারও কণ্ঠে গান। ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহ করছেন। ত্রাণ দিতে ছোট্ট এই শহরের দোকানি, রিকশাচালক, অটোচালকসহ সাধারণ মানুষ সামর্থমতো এগিয়ে এসেছেন। এখন পর্যন্ত ১২ হাজার টাকা জমা পড়েছে তহবিলে।
গতকাল শনিবার দুপুরে শহরের পুলিশ লাইনস বাজারে সংগীতপ্রমী সেই প্রৌঢ়ের দেখা পেয়েছেন তাঁরা। মাগুরার সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী নাফিসা নাওয়ার নিঝুম প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের গাইতে দেখে তিনি এগিয়ে আসেন। তখন তাঁরা ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গেয়েছেন; গান শেষে তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে ‘জাত গেল জাত গেল বলে’ গানটা ধরলে অর্ধেক পথ থেকে ফিরে আসেন। গান গেয়ে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন তিনি।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি ধারণ করেছেন জয় কুণ্ডু। শায়েখ উদ্দিন সোহান বলছেন, ভিডিওর সেই ব্যক্তি হয়তো মাগুরারই বাসিন্দা হবেন। তবে তাঁর নাম কিংবা ঠিকানা জানেন না; জানার চেষ্টা করছেন।
শুক্র ও শনিবার দুই দিন শহরের চৌরঙ্গী মোড়, পুলিশ লাইনস বাজার, ঢাকা রোডসহ শহরের মোড়ে মোড়ে ঘুরেছেন তাঁরা।
উদ্যোগী এই তরুণদের মধ্যে শায়েখ উদ্দিন সোহান, নাফিসা নাওয়ার নিঝুম, পার্থ প্রতীম বিশ্বাস, মাহাথির মোহাম্মদ, অদ্বিতীয়া আইচ তুলি, অমর্ত্য চক্রবর্তী, অরণ্য সাহা, উৎসব সাহা, প্রিন্স, পিয়াল, জারিন তাসনিম পুষ্প, তন্বী তনুলতা, প্রিয়ম সাহা, অভ্রদেব লস্কর, অন্তর বিশ্বাসসহ আরও অনেকে রয়েছেন।
আরেক সংগীতপ্রেমীর দেখা
এর আগে শুক্রবার আরেক সংগীতপ্রেমীর দেখা পেয়েছিলেন মাগুরার স্বেচ্ছাসেবী তরুণেরা। সে ভিডিওটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে এক ব্যক্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ গাইছেন। পাশে গিটারে সঙ্গ দিচ্ছেন তরুণেরা।
ভিডিওটি নিয়ে শায়েখ উদ্দিন সোহান বলছিলেন, পারনান্দুয়ালী নতুন ব্রিজের দিকে যাওয়ার পথে বৃষ্টির ছাঁটে আটকা পড়েছিলেন তাঁরা। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে; এর মধ্যে তিনি এগিয়ে এসে গানটা ধরেন। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। তবে দারুণ গাইতে পারেন।
ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করার পর মাগুরার অনেকেই লিখেছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে সেই অনুরাগীকে তাঁরা চেনেন; তাঁর নাম জগন্নাথ। তিনি মাগুরা শহরেই থাকেন।
ভিডিওটি দেখে শ্রাবণী মৈত্রী নামের একজন লিখেছেন, ‘এই লোকটা মাঝে মাঝে শিল্পকলায় যাইতেন। একবার আমার গানের শেষে গানের খুব সূক্ষ্ম একটা ভুল সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও তার কানে লেগেছিল। পরে সেটা বলেছিলেন, তবে বাইরে বেরিয়ে সবার আড়ালে। তখনই লোকটার সম্বন্ধে ধারণা হয়। সৃষ্টিকর্তা কোন মানুষকে কীভাবে সৃষ্টি করেন, একমাত্র তিনিই বলতে পারেন।’
ত্রাণ তহবিল সংগ্রহে নেমে সাধারণ মানুষের এমন একাত্মতা অনুপ্রাণিত করছে তরুণদের। আজ রোববারও ত্রাণ তহবিল সংগ্রহ করবেন মাগুরার তরুণেরা।