যেন সুরের চামচ মুখে জন্মেছিলেন শাফিন

হাতে বেজ গিটার, কণ্ঠে তুলেছেন ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘আজ জন্মদিন তোমার’। গান-গিটারে বাংলাদেশের রক সংগীত ইতিহাসে আলাদা অধ্যায় রচনা করে চিরবিদায় নিলেন ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ

শাফিন আহমেদফাইল ছবি

‘ওনার কণ্ঠটা একদমই আলাদা। অত্যন্ত সুরে গান করেন। একই সঙ্গে বেজ বাজিয়ে গান করা ভীষণ কঠিন কাজ। এটিই তাঁকে আলাদা করেছে, ’ শাফিন আহমদকে নিয়ে বললেন গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ।

প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘আজ জন্মদিন তোমার’, ‘কী করে সব ভুলে যাই’সহ ১০ টির মতো গান গেয়েছেন শাফিন। মাইলসের বাইরে শাফিনের বেশির ভাগ জনপ্রিয় একক গানের কথা ও সুর করেছেন তিনি।

চার দশকের ক্যারিয়ারে ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরে এলে না’, ‘হ্যালো ঢাকা’সহ বহু হিট গান উপহার দিয়েছেন শাফিন। যুক্তরাষ্ট্রে কনসার্ট করতে গিয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ সময় গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মারা গেছেন ৬৩ বছর বয়সী এই তারকা। তাঁর মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

শাফিন আহমেদ
ফাইল ছবি

জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের প্রধান কণ্ঠস্বর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন শাফিন। ব্যান্ডটির বেশির ভাগ গানই কণ্ঠে তুলেছেন। মাইলসের বাইরে একক গানেও সাফল্য পেয়েছেন।

রক সংগীতের গবেষক মিলু আমান বলছিলেন, বাংলাদেশে তো বটেই, দুনিয়াজুড়েই একই সঙ্গে বেজিস্ট ও ভোকালিস্টের সংখ্যা হাতে গোনা। মিলুর ভাষ্যে, ‘একই সঙ্গে বেজ বাজানো ও গান গাওয়া কঠিন বিষয়। সেটা উনি (শাফিন) স্বচ্ছন্দে করে গেছেন। গান যেমন তাল ধরে চলে, বেজ গিটারও তা–ই।’

বাইরে পিঙ্ক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্স, ইংরেজ ব্যান্ড দ্য পুলিশের স্টিং, কানাডিয়ান রক ব্যান্ড রাশের গেডি লিকে বেজ গিটার হাতে গাইতে দেখা গেছে। দেশে বেজিস্ট ও ভোকালিস্ট হিসেবে ওন্ড ব্যান্ডের রাতুলের নাম আসে।

কনসার্টে রীতিমতো ঝড় তুলতেন রক তারকা শাফিন। গান আর গিটারের তালে শ্রোতাদের হৃদয়ে উন্মাদনা ছড়িয়েছেন। প্রাণশক্তিই তাঁকে সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা করেছে বলে মনে করেন আরেক ব্যান্ড তারকা মাকসুদ হক। প্রায় কাছাকাছি সময়ে বেড়ে উঠেছে মাইলস ও ফিডব্যাক।

ফিডব্যাকের সাবেক সদস্য মাকসুদুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওর প্রাণশক্তি সাংঘাতিক; অবাক করার মতো। মঞ্চে পরিবেশনায় সেটার ছাপ দেখা যায়। ব্যান্ড সংগীতে ওকে কিংবদন্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’

মাকসুদুল হকের ভাষ্যে, ‘শাফিন আহমেদ ভীষণ আত্মবিশ্বাসী একজন শিল্পী। অনেকের দু–একটা গান হিট হওয়ার পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ও নিয়মিত হিট গান উপহার দিয়েছে।’

শাফিন আহমেদ
সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় মাইলসের কনসার্টে শ্রোতাদের ঢল নামত। কলকাতার শিল্পীরাও শাফিন আহমেদকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কলকাতায় গায়ক অনুপম রায় বলেছেন, মাইলসে শাফিনের গান শুনেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। ব্যান্ডটির ভক্ত তিনি। কলকাতার ক্যাকটাস ব্যান্ডের সিধুসহ আরও অনেকেই শাফিনের গানের প্রতি ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন।

যেন সুরের চামচ মুখে জন্মেছিলেন

কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সন্তান শাফিন। যেন সুরের চামচ মুখে জন্মেছিলেন তিনি। জন্ম কলকাতায়; শৈশব কেটেছে অ্যান্থনিবাগান লেনে। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত আর তবলা, মায়ের কাছে নজরুলসংগীত শিখেছেন। ৯ বছর বয়সে নজরুলের শিশুতোষ গান ‘প্রজাপতি প্রজাপতি’ রেকর্ড করেছেন শাফিন।

হামিন আহমেদ, ফিরোজা বেগম ও শাফিন আহমেদ
ছবি: হামিন আহমেদের সৌজন্যে

স্বাধীনতার আগে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় থিতু হয়েছেন। কৈশোরে বিটলসসহ পশ্চিমের বহু অ্যালবাম হাতের নাগালে পেয়েছেন। ইংরেজি গানে মুগ্ধতা জমে; বাড়িতে ড্রামস ও গিটার বাজাতেন। মা–বাবা নাখোশ হননি; বরং আশকারাই দিয়েছেন।

মাইলস ও শাফিন

সত্তরের দশকের শেষভাগে ধানমন্ডি–২৭-এর একটি রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত ইংরেজি গান চর্চা করতেন শাফিন। ১৯৭৭ সালে একটি ব্যান্ডও করেছিলেন, তবে সেটা খুব একটা এগোয়নি।

এর মধ্যে ফরিদ রশিদ লন্ডন থেকে ফিরে ‘মাইলস’ করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭৯ সালে মাইলস গঠনের পর ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইংরেজি গান কাভার করত ব্যান্ডটি। সপ্তাহে ছয় দিনই শো করতেন শাফিনরা।

১৯৮২ সালে ইংরেজি ভাষায় বের হয়েছিল ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘মাইলস’। দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘আ স্টেপ ফাদার’ও ছিল ইংরেজি।

মাইলস ব্যান্ডের সঙ্গে শাফিন
ফাইল ছবি

তখন আরও কয়েকটি ব্যান্ড ইংরেজি গান কাভার করত। ধীরে ধীরে তারা বাংলা গান করতে শুরু করে। অনেকটা প্রত্যাশার চাপের মুখে মাইলসও বাংলা গান শুরু করে। ১৯৯১ সালে ব্যান্ডের প্রথম বাংলা অ্যালবাম প্রতিশ্রুতি প্রকাশিত হয়। অ্যালবামের ‘চাঁদ তারা সূর্য’সহ কয়েকটি গান শ্রোতাদের মধ্যে আলোড়ন তোলে।

এরপর ‘প্রত্যয়’, ‘প্রয়াস’, ‘প্রতিচ্ছবি’র পথ পেরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছে মাইলস। বেশ কয়েকবার মাইলস ছাড়েন শাফিন। সর্বশেষ ভয়েস অব মাইলস নামে ব্যান্ড গড়েন। তবে মাইলসের সমার্থক হিসেবে শ্রোতাদের হৃদয়ে শাফিনের নামটা গেঁথে থাকবে।

স্টাইলিশ রক তারকা

পশ্চিমা সংগীতের অনুরাগী ছিলেন। অনুসরণ করেছেন পশ্চিমের রক তারকাদের স্টাইল। ঢাকায় স্টাইলিশ রক তারকাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় শাফিনকে। হ্যাট আর রোদচশমা ছিল শাফিনের প্রিয় অনুষঙ্গ। তাঁর সংগ্রহে বহু হ্যাট ছিল।

শাফিন আহমেদ
ছবি: ফেসবুক

খেলেছেন ক্রিকেটও

পারিবারিকভাবেই ক্রিকেটের পোকা ছিলেন তিনি। বাবা কমল দাশগুপ্তর সঙ্গে পরিবারের সবাই মিলে রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনতেন। ২০১৬ সালে প্রথম আলোয় তিনি লিখেছিলেন, ‘কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে খেলা চলছে, আমরা তিন ভাই (মোহাম্মদ তাহসীন, হামিন আহমেদ, আমি) ও বাবা একসঙ্গে ধারাবিবরণী শুনতাম। তখন তো টেলিভিশন ছিল না। রেডিওর সিগন্যাল পাওয়ার জন্য শীতের সকালে ছাদে গিয়ে রেডিওর অ্যানটেনা বড় করে সেটাতে তার দিয়ে বেঁধে ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার ধারাবিবরণী শুনতাম। ওই সময়টা বাবার সঙ্গে খুব দারুণ কাটত।’

বড় ভাই হামিন আহমেদ একসময় পেশাদার ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটের সঙ্গে শাফিনেরও যোগ ছিল। তিনিও ক্লাব পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছেন। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতেন, অফ স্পিনার ছিলেন শাফিন। তাঁর প্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম।

শাফিন আহমেদ নাম লিখিয়েছিলেন রাজনীতিতেও। তবে সংগীতের মতো রাজনীতির ক্যারিয়ারে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি।