‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত’...আজ আবার শুনি সেই গানের গল্প
‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই...’। গতকাল সোমবার রাত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আবার শোনা যাচ্ছে এ গান। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন রাজপথ ও অলিগলি থেকে আসছে গানের বিষাদে মোড়া সুর। সকাল থেকে ফেসবুকে অসংখ্য মানুষের স্ট্যাটাসে দেখা যাচ্ছে গানের লাইন, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই।’ গানটি শুনলে, গানের কথা পড়লে মনটা কেঁদে ওঠে, হাহাকার করে।
বছরের বিভিন্ন সময় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও মৃত্যুদিনে অলিগলি-রাজপথ কিংবা মানুষের বাড়িতে গানটি বেজে ওঠে বারবার। টেলিভিশন চ্যানেলে বারবার প্রচারিত হয় গানের ভিডিও, বেতারে শোনা যায় গানটি। যেন গানটা জাতীয় শোক দিবসের থিম সং!
গানটির গীতিকার হাসান মতিউর রহমান ও দুই গায়ক মলয় কুমার গাঙ্গুলী ও সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে আলাপকালে তিনজনই জানিয়েছিলেন, তাঁদের সংগীতজীবনের স্মরণীয় সংযোজন এই গান।
এই গানের সুবাদে বছরের পর বছর অসংখ্য মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন তাঁরা। সাবিনা ইয়াসমীন জানান, যতবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবারই গানটির প্রশংসা করেছেন তিনি। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী এ প্রতিবেদকের কাছে গানটির সৃষ্টির গল্প করেছিলেন। আজ শোক দিবসে আবারও শুনি সেই গল্প, বিষাদে মোড়া একটি সফল গানের গল্প।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গীতিকার হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘গানটি লেখা হয় ১৯৯০ সালে। আমি তখন থাকতাম ঢাকার সিপাহীবাগে। ভাড়া বাসায়। মলয় কুমার গাঙ্গুলী আমাকে ফোনে বিষয়টি বিস্তারিত জানালেন। ওই রাতেই লিখতে বসি। কিন্তু অনেক ভেবেও শুরু করতে পারছিলাম না। সারা রাত কেটে গেল। চোখে ঝিমুনি। ভোরের দিকে একটা সূত্র পেলাম। মনে হলো, বঙ্গবন্ধু তো একজন মহান মানুষ, জনগণের বন্ধু। তিনি কখনো মরতে পারেন না। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। এসব ভাবতে ভাবতে লিখে ফেললাম “যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই/ যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই!” এতে কল্পনায় বঙ্গবন্ধুকে যেমন বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে, তেমনি জেল থেকে তাঁকে মুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। লিখতে লিখতে আবেগে ঘন ঘন শিহরিত হচ্ছিলাম।
শেষ প্যারায় লিখলাম, “কে আছে বাঙালি তাঁর সমতুল্য/ ইতিহাস একদিন দেবে তাঁর মূল্য/ সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে যায় কি রাখা কখনো তা।” এরপর পুরো গান শেষ করি।’ এক বসাতেই সেদিন গানটি লিখে ফেলেছিলেন হাসান মতিউর রহমান। সকাল ১০টায় মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মলয় কুমার গাঙ্গুলীর বাসায় নিয়ে যান গানটি। হাসান মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁকে লেখাটা দিই। বেশ কয়েকবার পড়ে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়লেন সুর করতে।’
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলী স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘এক বসায় ১৫ মিনিটে গানটি সুর করে ফেলেছিলাম। গানের সুর করতে করতে আমার স্ত্রী, গীতিকার হাসান মতিউর—আমাদের তিনজনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরেছে। পরে আমি ফ্রান্সে একটি অনুষ্ঠানে গানটি গাই। এক বছর পর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে একটি কলেজের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সামনে এ গান গাই। তিনিও কেঁদে ফেলেন। এরপর অনেকবার তাঁকে এ গান শুনিয়েছি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর মলয় কুমার গাঙ্গুলীর মধ্যে একধরনের তীব্র যন্ত্রণা কাজ করত। তিনি জানান, সেই যন্ত্রণারই বহিঃপ্রকাশ এ গান। তিনি বলেন, ‘এ গান আমি সুর করেছি এবং আমি নিজে গেয়েছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমার এ গান প্রতিবাদের ভাষারূপে প্রতিধ্বনিত হবে।’
১৯৯০ সালে গানটি মলয় কুমার গাঙ্গুলী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইলেও রেকর্ডিং হয়েছে ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছিল তখন। ওই সময় এ গানের সঙ্গে আরও কিছু গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ ‘জনতার নৌকা’ নামে একটি অ্যালবাম বের করে হাসান মতিউর রহমানের নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চেনা সুর।
১৯৯৭ সালে গানটি সাবিনা ইয়াসমীনকে দিয়ে আবার গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেবার গানটির সংগীত পরিচালনা করেন ফরিদ আহমেদ। গানটি নিয়ে সাবিনা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ গান আমার হৃদয়ের খুব কাছের। এটি গাইতে পেরে আমি গর্ববোধ করি। এখনো মনে আছে, প্রচুর সাড়া পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ গান শুনে প্রশংসা করেছিলেন। “যদি রাত পোহালে শোনা যেত” আমার সংগীতজীবনের সেরা একটি অর্জন হয়ে আছে।’
সেই গান
যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।
যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো, করেনি কো কখনো মাথা নত।
এনে দিল হায়েনার ছোবল থেকে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
কে আছে বাঙালি তার সমতুল্য, ইতিহাস একদিন দেবে তার মূল্য।
সত্যকে মিথ্যার আড়াল করে, যায় কি রাখা কখনো তা।
(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)