শেফালী ঘোষ তাই পুরোনো হন না...
একটি বৃহত্তর জনপদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি শেফালী ঘোষের কণ্ঠে উঠে এসেছে। তাঁর সব গান জীবন থেকে নিংড়ে আনা। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রকৃতি, নদী, পাহাড়, পশুপাখি—সবকিছুর সঙ্গে নাড়ির স্পন্দনের মতো তাঁর গানের সুর মিশে আছে। শেফালী ঘোষ তাই পুরোনো হন না। চিরায়ত প্রকৃতির মতো তাঁর গান সব সময় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। উৎসব, পার্বণ, মেলা—তাঁর গান ছাড়া জমে না চট্টগ্রামে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বের অনেক অঞ্চলে তরুণ শিল্পীর কণ্ঠে এখনো শোনা যায় শেফালীর মঞ্চকাঁপানো গানগুলো। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁকে হারিয়েছি আমরা। মৃত্যুর ১৬ বছর পরও বেঁচে আছেন তিনি তরুণ শিল্পীদের সাধনায়, মানুষের মনেপ্রাণে।
গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে নজরুলসংগীত দিয়ে শেফালীর শিল্পীজীবন শুরু হলেও তিনি সারা দেশে এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গানের শিল্পী হিসেবে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন শীর্ষ এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে কোনো পালাগান, অনুষ্ঠান আর শেফালী ছাড়া জমত না।
গ্রামগঞ্জে, পাড়ায় ছেলে-বুড়ো-যুবক—সবার মুখে শেফালীর গান। তাঁর জন্য গান লিখলেন উপমহাদেশখ্যাত রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, কবিয়াল এয়াকুব আলী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিৎ দাশ, মোহাম্মদ নাসির, মোহনলাল দাশের মতো বড় বড় গীতিকার ও সংগীতজ্ঞ।
তাঁদের লেখা সেই সব গান শেফালীর জাদুকরি কণ্ঠে এসে মানুষের হৃদয় কেড়ে নিল, আর লোকের মুখে ফিরতে ফিরতে একধরনের লোকগানের মর্যাদায় অমর হয়ে গেল।
শেফালী ঘোষের কিছু কিছু অর্জন আছে, যা বাংলাদেশের অনেক বড় শিল্পীর ভাগ্যেও জোটেনি। ১৯৭৯ সালে তিনি রয়েল লন্ডন আলবার্ট হলে গান গেয়েছিলেন। তাঁর আগে বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র রুনা লায়লাই এই সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের পৃথিবীখ্যাত মিলফা লিমিটেড তাঁর ১০টি গান নিয়ে লং প্লে বের করে। গান গেয়েছেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ওমান, কাতার, জর্ডান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বহু দেশে। বাংলাদেশের বহু সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে রামপুরা টেলিভিশন ভবন উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তিনি গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন।
১৯৯১-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলে মানুষের হাহাকার। ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের পর তখনো হতবিহ্বল মানুষ ও প্রকৃতি। ঠিক সেই সময় তিনি গাইলেন এক অসাধারণ উদ্দীপক গান।
গর্কি তুয়ান-বইন্যা-খরা মোহামারি ঘুন্নিঝড়
ভাসায় মারে, ধ্বংস গরে, মাইনসে তো আর বই ন লর
অক্কল হামর ধান্দা চলে আবার নয়া সিষ্টি অর
(গোর্কি, তুফান, বন্যা, খরা, মহামারি, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ভাসিয়ে মারে, ধ্বংস করে, মানুষ তবু বসে থাকছে না। সব কাজের চাকা ঘুরছেই, আবার নতুন নতুন সৃষ্টি চলছে। কথা: সৈয়দ মহিউদ্দিন)।
শেফালী ঘোষের জনপ্রিয় গানের তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেগুলো শ্রোতাকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের চেতনাকেও জাগিয়েছে। কর্ণফুলীর দুই তীরের মানুষের জীবন, তাদের ভাবনা, আচার-আচরণের নিখুঁত চিত্র উঠে এসেছে তাঁর গানে। সে কারণের আজও মানুষের হৃদয়ে সেই সব গান বেজে ওঠে। চট্টগ্রামের প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী যত দিন বইবে, তত দিন শেফালী ঘোষ বেঁচে থাকবেন। মৃত্যুর এক বছর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন একুশে পদক। কিন্তু তাঁর প্রাপ্তির শীর্ষে সব সময় থাকবে অগুনতি মানুষের ভালোবাসা।