বিয়ের পরদিন সকালে স্টুডিওতে ছুটে গিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাকে অপরিহার্য এক শিল্পী। যেকোনো ধরনের গান গাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। রোমান্টিক, মেলোডিয়াস, বিরহী, ফোক, চটুল—সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সব ফেলে ২০২০ সালের ৬ জুলাই চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। পুরোনো দিনের কথায় স্মরণ করি তাঁকে।
‘প্লেব্যাক সম্রাট’, যতবার এন্ড্রু কিশোরের নাম শুনেছি, বেশির ভাগই ক্ষেত্রে এই শব্দবন্ধ উচ্চারিত হয়েছে। তাঁকে প্লেব্যাক সম্রাট হিসেবে পরিচিত বলতে কেউ কার্পণ্য করেননি। বছরের পর বছর বাংলাদেশ, এমনকি পশ্চিমবাংলার আধুনিক ও চলচ্চিত্রজগতের কালজয়ী অনেক গান তাঁর কণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে। গল্প বা দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ—সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন। ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর সেই রাজশাহীতেই ফিরে গেলেন চিরতরে, যাওয়ার আগে যিনি রেখে গেলেন অসংখ্য গান।
একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন শুধু গানে গানে। যেন মানুষটার জন্মই হয়েছিল গানের জন্য, অসংখ্য গানের সৃষ্টি হয়েছিল যেন তারই জন্য। কী সুন্দর মানিয়ে যেত তাঁর কণ্ঠে, কী নিখুঁত গায়কি তাঁর। গায়কিতে, মায়াবী কণ্ঠে তিনি শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। গান গেয়ে দেশে নানা প্রজন্মের গায়ক জনপ্রিয় হয়েছেন।
এ কথা লিখলে ভুল হবে না, এন্ড্রু কিশোরের পেশা ও নেশা দুটিই ছিল গান। মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। এন্ড্রু কিশোর ১৯৮৭ সালে আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামের একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। তবে সেখানে বেশি সময় দেননি। গান গাওয়া ছাড়া অন্যদিকে মনোযোগ দেননি। মূলত চলচ্চিত্রের গানেই ছিল তাঁর মূল দখল। বাংলা চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প তাঁর কাছে ঋণী থাকবে। অবাক হলেও সত্য, মানুষটা বিয়ের দিনেও চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন স্টুডিওতে গিয়ে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেই এ কথা বলেছিলেন তিনি।
তখন সবে এন্ড্রু কিশোর উঠতি তারকা। সেদিনের স্মৃতিচারণা করে এন্ড্রু কিশোর বলেন, ‘বিয়ের দিন যে গান করব, এমন পরিকল্পনায় ছিল না; হয়ে গেছে। সেদিন আমি নিজেই অভ্যর্থনাকারী। সব দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছে। এর কারণ, বিয়েতে যাঁরা আমন্ত্রিত, তাঁদের কাউকেই আমার মা-বাবা কিংবা একমাত্র বড় বোন চেনেন না। এ কারণে সবকিছু দেখভাল করতে করতে রাত একটা বেজে গেল। এর মধ্যে বিয়ের আসরেই সংগীত পরিচালক আলী হোসেন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে গেলেন, সকালে রেকর্ডিং মনে থাকে যেন। প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, দুষ্টামি করছেন। কারণ, উনি জানতেন আমি কতটা গানপাগল। কিন্তু রাত ফুরিয়ে সকালেই সত্যি সত্যি তিনি ফোন করে ডন স্টুডিওতে চলে আসতে বললেন। তখনো আমি বিছানায়। হুড়মুড় করে উঠে গেলাম। চোখ ডলতে ডলতে ছুটলাম।’
শুধু এটা নয়, গানের জন্য বাসা থেকে অসময়ে বেরিয়ে যাওয়া বা না থাকার ঘটনা জীবনে অনেকবার হয়েছে। ছেলের প্রথম জন্মদিনে তিনি ছিলেন আমেরিকায়। দ্বিতীয় জন্মদিনের দিন স্টুডিওতে। তাই বলে সংসারজীবনে যে মনোযোগী ছিলেন না, তা নয়। অবশ্য সংসার দেখভালের কাজটি মূলত তাঁর স্ত্রীই করতেন।
সংগঠন, রাজনীতি, সভা, সমিতি—এসবে খুব একটা দেখা যেত না তাঁকে। এন্ড্রু কিশোর নিজেই বলেছেন, ‘আমি জীবনকে সব সময় কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করি। জীবনের সুখ, শান্তি সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করি। খুব ক্ষুদ্র আকারে চিন্তা করি। বউ, বাচ্চা আর ঘরেই সীমাবদ্ধ আমার চিন্তা। আমাকে এ ব্যাপারে স্বার্থপর বলা যায়। আমি আমার মধ্যেই সুখী।’
এমনও শোনা যায় যে এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠের সঙ্গে যেন মানানসই হয়, সে বিষয় চিন্তা করে অনেক চলচ্চিত্রের নায়ক ঠিক করা হতো।
সংগীতজগতে পুরোদস্তুর পেশাদার মনোভাব নিয়ে চলতেন এন্ড্রু কিশোর। এ জগতের সঙ্গে পরিবারকে মেলাননি। আবার নিজেও গান গাওয়ার পাশাপাশি সমসাময়িক অনেকের মতো গান লেখা বা সুর করার দিকে কখনো মনোযোগ দেননি।
সেকালের রাজ্জাক, জাফর ইকবাল থেকে একালের সালমান শাহ, মান্না, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিব খান—সবার জন্যই তিনি গেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি নিজেকে এত প্রতিভাবান মনে করি না। কথা কিংবা সুরের ওপর আমার এতটা জ্ঞান আছে বলে মনে করি না। আমার জ্ঞান শুধু গায়কিতে। গাইতে পারি। তাই আমি গীতিকার কিংবা সুরকারের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। এটা পেশাদারির মধ্যেও পড়ে। আর আমি চাই, একটা অ্যালবামে সব ধরনের সুরকার বা গীতিকারের গান থাকা উচিত। তাহলে সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে পৌঁছানো যাবে।’
১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে মেইল ট্রেন ছবির 'অচিনপুরের রাজকুমারী নেই' গানে প্লেব্যাক শুরু। তবে তিনি সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তাঁর গানটি ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দেওয়া এই শিল্পী আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ‘ইত্যাদি’তে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার ‘ইত্যাদি’তে এসেছেন। সীমিত পরিসরে অডিও অ্যালবামে গান করেছেন। তবে তাঁর চলচ্চিত্রে গাওয়া গান বছরের পর বছর টিকে থাকবে এই বাংলায়। শুধু ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোরকে পাওয়া যাবে না কোনো আয়োজনে, প্রয়োজনে। দেশ–বিদেশের স্টেজে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গাইবেন না, ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস!’
(এ লেখার কিছু অংশ প্রথম আলো বিনোদনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নেওয়া)