আমার পরিচিত পৃথিবী এখন মৃত: কবীর সুমন
তিয়াত্তর বছর বয়সের ‘গানওলা’ গান গাইলেন, অজস্র গান। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও গিটার বাজালেন না। ১৩ বছর আগে যখন এসেছিলেন, তাঁর হাতে ছিল গিটার। এবার সেই গানওলার সামনে কি-বোর্ড, তিনি কি-বোর্ড বাজালেন আর তাঁর গানের সঙ্গে গিটার সংগত করলেন অন্য আরেকজন। গানওলা বললেন, ‘নিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে এখন আর গিটার বাজাতে পারি না। চেয়ার থেকে উঠতেও সমস্যা হয়। তবে গুরুদের কৃপায় এখনো কণ্ঠটা অকেজো হয়ে যায়নি।’ গানের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তর কথা হলো, গানের লেজ ধরে এল নানান গল্পও। সেসব গল্পে গানওলার গান ও জীবন মাখামাখি। ৪৩ বছর বয়সে প্রথম অ্যালবাম। মানুষের মুখে মুখে ফিরল ‘তোমাকে চাই’, ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’সহ অন্য রকম কথা ও সুরের কত কত গান!
বাংলাদেশের কবি শহীদ কাদরীর বিখ্যাত কবিতা ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ কীভাবে গান হয়ে উঠল? ‘ভয় নেই এমন দিন এনে দেব...’, সেই চেনা সুরে সবাইকে ভাসিয়ে দিয়ে গানঅলা সেই গল্পই জুড়লেন, ‘শহীদ আমার বন্ধু ছিল। ও জানত না তার গানে আমি সুর দিয়েছি। গানটাতে সুর দিয়ে একদিন ওকে শোনালাম। অবাক হয়ে চোখ কুঁচকে ও বলল, “এই কবিতাও গান করা যায় নাকি!”...আপনারা শহীদের কবিতা পড়বেন। ওর কবিতা পড়লে কবিতা পড়ার বদ অভ্যাস তৈরি হয়।’
এমন সব চমকপ্রদ গল্প করতে করতে ১৫ অক্টোবর শনিবার বিকেলে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের ছোট্ট মিলনায়তনে কবীর সুমনের কণ্ঠ যখন গমগম করছে তখনো কি তিনি জানতেন, এর কিছুক্ষণ পরই এখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এক মহা চমক! শুধু তাঁর জন্যই-বা কেন হবে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চমকটি ছিল মিলনায়তনভর্তি দর্শকদের জন্যও। প্রায় ৪০ বছর পর এখানে এসে তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর যুবক বয়সের এক বন্ধুকে।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে কবীর সুমন ততক্ষণে গেয়ে ফেলেছেন, ‘হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে/ হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে/ বন্ধু কী খবর বল/ কত দিন দেখা হয়নি।’ এর খানিক বাদেই কথায় কথায় বললেন, ‘১৯৭৬ সালে আমি জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলেতে কাজ নিলাম। ওখানে সে সময় বাংলাদেশের দুই ফারুক কাজ করতেন। একজন আবদুল্লাহ আল ফারুক, যাঁকে আমরা বলতাম এমনি ফারুক। আরেকজন হলেন শাহজাহান ফারুক। এই শাহজাহান ফারুক আমাকে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই “বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা” পড়তে দিয়েছিলেন। জানি না সেই শাহজাহান ফারুক এখন কোথায় আছেন। এখানে আছেন কি না।’
সুমনের কথাটি শেষও হয়নি, এমন সময় দর্শকসারি থেকে হঠাৎ একজন বলে উঠলেন, ‘শাহজাহান ফারুক এখানেই আছেন।’ এরপরই সুনসান মিলনায়তন খান খান হয়ে গেল সুমনের একটি জোরালো শব্দে, ‘কী! এখানে!...এই আমাকে তোল না।’
ঘটনার আকস্মিকতায় সুমনের মতো দর্শকেরাও তখন হকচকিত। এরপর সুমনকে ধরে চেয়ার থেকে তোলা হলো, দর্শক আসন থেকে মঞ্চে নিয়ে আসা হলো শাহজাহান ফারুককেও। দুই বন্ধুর চোখাচোখি হলো কুড়ি কুড়ি বছর পর। খানিক বাদেই পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন গাঢ় আবেগে। সুমনের চোখে সে সময় জল। আর দুই বন্ধুর সাক্ষাতের সেই মনোলোভা ক্ষণটির সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা—অসংখ্য দর্শক। এটি অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। এর আগেই গিটার না বাজানো সুমনের গান ও সরস কথার জাদুতে মোহিত হয়ে গেছেন সবাই।
এ সময় সুমন বাংলাদেশের আরেকজনের নামও নিলেন—প্রয়াত লেখক ফরহাদ খান। জার্মানিতে তাঁরা ছিলেন সহকর্মী। সেই স্মৃতি তর্পণ করে বললেন, ‘ঠিক যদি এইভাবে ফরহাদ খানও আমাকে জড়িয়ে ধরত, কী সুন্দর হতো জীবনটা!’ কথার ভেতরে থাকা আবেগ তাঁকে যেন বারবারই বাঁধনহারা করে তুলছিল, না হলে কেন এভাবে বলবেন তিনি, ‘আমার পরিচিত পৃথিবী এখন মৃত, আমার মা-বাবা, গুরু কালীপদ দাস, সবাই মৃত, বন্ধু-স্বজন অনেকেই মৃত।...কলকাতায় আমাকে তেমনভাবে কেউ এখন গান গাইতে ডাকে না। বিনোদনশিল্পে বুড়োদের জায়গা নেই। আপনারা আমাকে ডাকেন। আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমি আসি।’
তাঁর কথা-গানে বারবার ঘুরেফিরে এল বাংলাদেশ। গান ও কথার একপর্যায়ে বের করলেন ইনহেলার। পরে দর্শকদের খানিকটা অভয় দিতেই হয়তো বলে উঠলেন, ‘ভয় পাবেন না। আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। মরছি না এখনই। আমি এত সৌভাগ্য করে আসিনি যে এ দেশে আমার মৃত্যু হবে।’
অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ অবধি সুমনের গান আর কথায় বারবার বেজে উঠল বাংলাদেশ। ঝলকে ঝলকে এ দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন উছলে উঠছিল। একসময় সরাসরিই বললেন, ‘বাংলাদেশের কাছে তো ধারদেনার সীমা নেই আমার।’
অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে দর্শক আসন ছিল অনালোকিত, সব আলো রাখা হয়েছিল তাঁর দিকেই। কিন্তু যে গানওলা সাম্যবাদের গান গলায় তুলেছেন, এমন বৈষম্য তিনি মানবেন কেন! ‘দর্শকের দিকে আলো দেন,’ এটুকু বলেই তো তিনি থামতে পারতেন। তবে তিনি যে রসিক সুমন। তাই তাঁর কণ্ঠে শোনা গেল, ‘উঠতে পারি না, বসতে পারি না, এখন আমার চোখ খারাপ, কান খারাপ, মন ছাড়া সবই খারাপ।’
এর পরপরই গান ধরলেন সুন্দর মনের সুমন, ‘ছেড়েছ তো অনেক কিছুই পুরোনো অভ্যেস’, ‘কখনো সময় আসে জীবন মুচকি হাসে’, ‘যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ’, একের পর এক গান, গানের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক।
অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ অবধি সুমনের গান আর কথায় বারবার বেজে উঠল বাংলাদেশ। ঝলকে ঝলকে এ দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন উছলে উঠছিল। একসময় সরাসরিই বললেন, ‘বাংলাদেশের কাছে তো ধারদেনার সীমা নেই আমার।’
এই গানের খেয়ায় দাঁড়িয়ে একসময় নিজেকে নিয়ে শ্লেষাত্মক রস করতেও কসুর করেননি অধুনা বাংলা খেয়াল নিয়ে মজে যাওয়া গানওলা। ৭৩ বছর বয়সে পৌঁছে তিনি যখন বলেন, ‘আমি বড় হইনি, বুড়ো হয়েছি, যে বড় হয়, সে কি পাঁচবার বিয়ে করে। মেয়েদের কাছে ছাড়া কদাপি আমি কারও কাছে মিথ্যা বলিনি!’ তখন নিজেকে নিয়ে তাঁর এই অকপট স্বীকারোক্তি কীভাবে নেবেন দর্শকেরা? সুমনের এমন কথার তোড়ে গানের তাল ভুলে দর্শক তো তখন হেসে খুন। হেসেছেন গানওলা সুমনও। ‘হাসি-কান্নার এই দুই ডানায়’ নিজেকে মেলে দিয়ে অকপটে সরাসরি নিজেকে যেন বারবারই উন্মোচন করছিলেন তিনি। আর যে গানের ৩০ বছর পূর্তিতে এই অনুষ্ঠান, সেই ‘তোমাকে চাই’ গানটি কীভাবে লেখা হয়েছিল, বলতে বাদ রাখলেন না সে কথাও।
‘একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। নিজে প্রেমে পড়ে নিজেই পাগলা হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেয়েটা পাত্তাও দিল না। এ গানের প্রথম ছয় লাইন লেখার পর মেয়েটি হাওয়া...।’
এমন গল্পে গল্পে আসর যখন জমজমাট, সে আসর ভাঙতে আর চায় কে!
আমি বড় হইনি, বুড়ো হয়েছি, যে বড় হয়, সে কি পাঁচবার বিয়ে করে। মেয়েদের কাছে ছাড়া কদাপি আমি কারও কাছে মিথ্যা বলিনি!
‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...দারুণ অসম্ভবে তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই...’, মিলনায়তনের সবার গলায় যখন চিরপরিচিত ‘তোমাকে চাই’-এ আপ্লুত হয়ে যখন সবাই আরও নিবিড় করে চাইছেন সুমনকে, গানটি শেষ হলো তখনই। এরপর চোখের পলকে দর্শককে কুর্নিশ করে অনেকটা ঝড়ের বেগেই মঞ্চ থেকে হাওয়া হলেন সুমন। পুরো ঘটনাটির মধ্যে এমন নাটকীয়তা ছিল যে অনুষ্ঠান শেষে হয়েছে, এটি বুঝতেও কয়েক মিনিট লাগল সবার। কারণ, প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে গান আর কথার যৌথ দোলায় দুলিয়ে দুলিয়ে কবীর সুমন সবার মধ্যে এমন এক আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিলেন যে সবাই বোধ করি তাঁকে বলতে চাইছিলেন, ‘ও গানওলা, আরেকটা গান গাও/ আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই!’