আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, আসিফদের ঈদের গানে সেই দশক

আসিফ, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, জেমসকোলাজ

ঈদের কেনাকাটার যে যৎসামান্য বাজেট, তার একটা বড় অংশ গানের ক্যাসেট কেনার জন্য বরাদ্দ। এটা এখন, এই সময়ে রীতিমতো অকল্পনীয়। অথচ এটাই ছিল নব্বইয়ের দশকের বাঙালি তরুণদের ঈদের চিত্র। আগেই শুরু হয়ে যেত অপেক্ষা। দোকানে গিয়ে বলে আসতে হতো কাঙ্ক্ষিত অ্যালবামের কথা। কখনো কোনো অ্যালবাম কেনার জন্য দোকানে দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত। আজ সবই যেন রূপকথার মতো মনে হয়।
সে সময় ঈদ বলতে ঈদুল ফিতরকেই অডিও গানের সবচেয়ে বড় উৎসবের সময় হিসেবে সাব্যস্ত করে কাজ শুরু হতো। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা রাত-দিন টানা কাজ করতেন। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল ক্যাসেটের বাজার। বিশেষ করে পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী। এ ছাড়া আজিজ সুপারমার্কেটেও ছিল জমজমাট ক্যাসেটের দোকান। এলিফ্যান্ট রোডের গীতাঞ্জলী কিংবা রেইনবো ছিল ব্যাপক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ঈদ আসতেই সব দোকানে শুরু হয়ে যেত পাল্লা দিয়ে গান বাজানোর মহোৎসব।

কেমন ব্যস্ত ছিলেন সে সময়ের অ্যালবাম আয়োজকেরা? গুণী গীতিকার আহমেদ রিজভী জানালেন তাঁর দারুণ এক অভিজ্ঞতা। সে সময় মিক্সড অ্যালবামের জোয়ার। কে কার চেয়ে বেশি গান তৈরি করতে পারেন, কে কার চেয়ে তুলনামূলক ভালো গান করতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতা ছিল চরমে। আহমেদ রিজভী একটা অ্যালবামের স্মৃতিচারণা করলেন। ‘শুধু তোমারই কারণে’ শিরোনামে একটা মিক্সড অ্যালবাম করেছিলেন তিনি। সেই অ্যালবামের বিখ্যাত গান কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘তুমি যদি বলো পদ্মা মেঘনা এক দিনে দেব পাড়ি’। আরও একটি গান জনপ্রিয় হয়। হাসানের ‘আমার আল্লাহ নবীজির নাম’। গানটি নিয়ে তিনি বললেন, ‘হাসান ভাই আগাগোড়া ব্যান্ড আর্টিস্ট। তিনি যে রকম গান করেন, আল্লাহ নবীজির নাম সে রকম গান ছিল না। ফলে অনেকেই বলেছিলেন গানটি অ্যালবামের শেষের দিকে দিতে। কারণ, এই গান শ্রোতাদের পছন্দ না করার আশঙ্কা বেশি। অথচ অ্যালবাম প্রকাশের পর চিত্র বদলে গেল। গানটি সারা দেশে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে গেল। অ্যালবামটি ছিল ঈদের অ্যালবাম। ঈদের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল এই অ্যালবামের সাফল্য।’

সে সময় যাঁরা গান লিখতেন, দু-একটি কিংবা গাইতেন বিচ্ছিন্নভাবে, সবাই-ই বসে থাকতেন ঈদের একটি অ্যালবামে সুযোগ পাওয়ার জন্য। কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু তরুণ শিল্পীদের নিয়ে এক ঈদে একটি অ্যালবামের কাজ করছিলেন। নাম ‘মন জ্বলে’।

প্রিন্স মাহমুদ
প্রথম আলো

সেই অ্যালবামে গান লিখেছিলেন শফিক তুহিন। বলছিলেন, ‘বাচ্চু ভাই আমাকে সুযোগ দিলেন “মন জ্বলে” অ্যালবামে গান লেখার জন্য। এমনিতেই সামনে ঈদ, তার মধ্যে আমার হাতে যেন ঈদের আগে ঈদের চাঁদ। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার যে কী আনন্দ, কী যে আন্তরিক আর স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন তিনি, সেই এক অ্যালবামে কাজ করে আমার ক্যারিয়ার শক্ত জায়গা পেয়ে যায়।’
ঈদের সময় যাঁদের অ্যালবাম প্রকাশ পায় এবং যাঁদের অ্যালবাম বিক্রির শীর্ষে চলে যায়, সেই তালিকায় নিঃসন্দেহে প্রথম অবস্থানে ছিলেন প্রিন্স মাহমুদ। প্রতিটি অ্যালবামে প্রিন্স মাহমুদের ছবি থাকত। একটি নির্দিষ্ট ছবি। সেই ছবি দেখে শ্রোতারা অ্যালবাম কিনতেন। আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, মাকসুদ, টিপু, আশিকুজ্জামান টুলু, খালিদ, পার্থ বড়ুয়া—এসব ব্যান্ড আর্টিস্টের পাশাপাশি তিনি কাজ করেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ, খালিদ হাসান মিলুসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীকে নিয়ে। এখনো সেসব গান শ্রোতাদের প্লে লিস্টজুড়ে সমান আগ্রহে রয়ে গেছে। প্রিন্স মাহমুদের অ্যালবামও ছিল সমান জনপ্রিয়।

ডলি সায়ন্তনী
ছবি: সংগৃহীত

ঈদের বাজারে একক শিল্পীদেরও বেশ চাহিদা ছিল। শ্রোতারা অপেক্ষা করতেন, কবে মিল্টন খন্দকারের সুরে মনির খানের কিংবা প্রণব ঘোষের সুরে তপন চৌধুরী বা এস ডি রুবেলের অ্যালবাম প্রকাশ পাবে। রবি চৌধুরী, বাদশাহ বুলবুল কিংবা রুক্সি, দিলরুবা খান, ডলি সায়ন্তনী বা আঁখি আলমগীরের গানও ছিল ঈদের জমজমাট উপহার।

ঈদ অ্যালবামের যে উৎসব, তার শেষ সফল শিল্পীর নাম আসিফ আকবর। জানা যায়, ঈদের সময় আসিফ আকবরের ক্যাসেট সরবরাহের জন্য সারা দেশ থেকে ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান চলে আসত ঢাকার পাটুয়াটুলীতে। লাখ লাখ অ্যালবাম বিক্রি হতো এই সফল শিল্পীর।

আসিফ আকবর। সংগৃহীত

ঈদ আসতেই এখন সব মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য ১০টি গানও সেভাবে প্রকাশ পায় না। ঈদ মানেই যে বাংলা গানের একটা বড় দখল, তা যেন কেবলই নস্টালজিয়া, আর কিছু নয়। আজকাল সেই সময়ের শ্রোতারা ভাবেন, কবে তাঁরা কাকে ভালোবেসে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কার জন্য উপহার হিসেবে কোন অ্যালবাম কিনেছিলেন। ধুলা পড়া শেলফে নিশ্চয়ই এখনো অনেক ক্যাসেটের উল্টো পাশে কারও উদ্দেশে লেখা আছে ভালোবাসার পঙ্‌ক্তি কোনো! সময় বুঝি এ রকমই। ঈদ আসে, ঈদ যায়, বাংলা গানের সেই মহোৎসব আর সেভাবে যেন ঝলমলিয়ে ওঠে না। তবু সান্ত্বনা এই যে ঈদের স্মৃতিজুড়ে এমন রঙিন ঘটনা তো সেসব গান ঘিরেই।