শাফিন ভাইয়ের জানাজায় যেতে যেতে শুনি, জুয়েল আর নেই...
২৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় সকালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার হাসপাতালে মারা যান শাফিন আহমেদ। চার দিনের মাথায় গত সোমবার শাফিনের মরদেহ বহনকারী উড়োজাহাজ ঢাকায় পৌঁছায়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানের আজাদ মসজিদে এ শিল্পীর জানাজার প্রস্তুতি যখন চলছিল, তখনই খবর আসে সংগীতাঙ্গনের আরেক নক্ষত্র হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল আর নেই। আবারও স্তব্ধ হয়ে যান সংগীতাঙ্গনের মানুষেরা। দুই শিল্পীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার কবির বকুল। তিনি স্মরণ করেছেন সদ্য প্রয়াত দুই সংগীতশিল্পীকে।
শাফিন আহমেদের জানাজায় যাব। বাদ জোহর জানাজা। দুপুর ১২টায় কারওয়ান বাজার প্রথম আলো অফিস থেকে রওনা দিলাম গাড়িতে। ঠিক তখনই মুঠোফোন বেজে উঠল। তুষার কল করেছে, আমার সহকর্মী। ‘ভাই, শুনেছেন, জুয়েল ভাই মারা গেছেন।’ আমি বাক্রুদ্ধ হয়ে গেলাম মুহূর্তেই। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলও চলে গেলেন!
ওই মুহূর্তে যেন আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না, এমন একটা মৃত্যুর খবরের জন্য। কারণ, শাফিন ভাইয়ের শোকটাই বুকের ভেতর পাথরের মতো চেপে বসে আছে। সেটা কত দিনে কাটিয়ে উঠব, জানি না। তার ওপর জুয়েল। প্রিয় জুয়েল ভাই। তাঁর মৃত্যুর খবরটা যেন নিতেই পারছিলাম না।
আমরা সমসাময়িক হলেও দুজন দুজনকেই ভাই সম্বোধন করতাম। আমাদের সংগীতাঙ্গনে হাতে গোনা যে কজন সজ্জন মানুষ আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন জুয়েল। সেই জুয়েল ১৩ বছর যিনি ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন।
ক্লান্তি, অবসাদ আর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে আর পেরে উঠলেন না। পরাজিত হলেন মৃত্যুর কাছে। ২০১১ সালে তাঁর লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর ক্যানসার সংক্রমিত হয় ফুসফুস ও হাড়েও। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশে ও দেশের বাইরে লন্ডনের হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাসেবা নেন। নিয়মিত তাঁকে কেমোথেরাপি নিতে হয়। কিন্তু একসময় সেই কেমোতেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। গত অক্টোবর থেকে জুয়েলকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি তাঁকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গতকাল রাত থেকে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। গতকাল বেলা ১১টা ৫৩ মিনিটে চিরবিদায় নিলেন প্রিয় শিল্পী, বন্ধু জুয়েল।
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৯ সালে। রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্পে। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে সে বছর রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্প হয়েছিল। আমি এসেছিলাম চাঁদপুর থেকে। সেই প্রথম জুয়েলের দেখা পাই। জুয়েল ক্যাম্পের সমাপনী দিনে গান গাইলেন। সেদিন জুয়েল গাইলেন তপন চৌধুরীর গাওয়া বিখ্যাত সেই গান ‘আমার গল্প শুনে কারও চোখে করুণার জল যদি আসে, ভীষণ দুঃখ পাব, আমি তো রয়েছি সুখে এক বুক বেদনা নিয়ে’।
আজ আমিও জুয়েলকে নিয়ে গল্প করছি এক বুক বেদনা নিয়েই। এই জুয়েল একসময় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর একক অ্যালবামগুলো দিয়েই। তখন ফিতাবন্দী অ্যালবাম বের হতো।
জুয়েলের প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’। কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর সুরে এই অ্যালবামটি বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালে। ‘কোথায় রাখো আমাকে তুমি বলো না, দৃষ্টি না হৃদয়ে আমি জানি না’ জুয়েলের এই গানটি বেশ শ্রোতৃপ্রিয় হয়েছিল। এর পরের বছর ১৯৯৪ সালে বের হয় ‘সেদিনের এক বিকেলে’ অ্যালবামটি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জুয়েলকে। তুমুল জনপ্রিয় হয় অ্যালবামটি। এটিও আইয়ুব বাচ্চুর সুর। এই অ্যালবামের বেশ কটি গান বেশ শ্রোতৃপ্রিয় হয়। বিশেষ করে শিরোনাম গান ‘সেদিনের এক বিকেলে, তোমার চোখে জল দেখেছি, সে কথা আমি কতবার একা একা ভেবেছি, আর জানি না কেন এত কষ্ট পেয়েছো তুমি’। এ ছাড়া এই অ্যালবামের ‘চিলেকোঠায় এক দুপুরে, ওগো চন্দ্রদ্বীপের মেয়ে উল্লেখযোগ্য। ধারাবাহিকভাবে এরপর ১৯৯৫ সালে ‘আমার আছে অন্ধকার’, ১৯৯৬ সালে ‘একটা মানুষ’, ১৯৯৭ সালে ‘দেখা হবে না’, ১৯৯৮ সালে ‘বেশি কিছু নয়’, ১৯৯৯ সালে ‘বেদনা শুধু বেদনা’। একটু বিরতি দিয়ে জুয়েল ২০০৩ সালে ফেরেন ‘ফিরতি পথে’ অ্যালবাম দিয়ে। তারপর আবার লম্বা বিরতি। ২০০৯ সালে আসে ‘দরজা খোলা বাড়ি’। ২০১১ সালে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার পর আর গান করা হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে আমরা পাই ‘এমন কেন হলো’ অ্যালবামটি।
বিরহকাতর গানগুলো জুয়েলের কণ্ঠে বেশ লাগত। আমার স্ত্রী সংগীতশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী ছিল জুয়েলের গানের ভীষণ ভক্ত। মুন্নী আমাকে কথায় কথায় এক দিন বলল, জুয়েলের একটা অটোগ্রাফ এনে দিতে। আমি একদিন জুয়েলকে নিয়েই বাসায় উঠলাম। মুন্নী তো অবাক। জুয়েলে ফটোফ্রেমে রাখা মুন্নীর একটি ছবিতে জুয়েল অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন। সেই দিনটার কথা আমার ভীষণ মনে পড়ছিল।
আমার লেখা দুটো গান জুয়েল গেয়েছেন। একটি গান মোহন খানের কোনো একটি নাটকের। আমারই লেখা ও সুর করা ছিল সে গানটি। অনেক চেষ্টা করেও গানটি খুঁজে পেলাম না। আরেকটি গান ছিল একটি মিক্সড অ্যালবামের। আমার লেখা এবং প্রণব ঘোষের সুরে এই অ্যালবামটির নাম ছিল ‘নিঃসঙ্গ’। জুয়েল গেয়েছিলেন ‘স্মৃতির দুয়ার খুলে রোজ তুমি আসো এই ভাঙাচোরা হৃদয়ের ঘরে, ব্যর্থ এ মনটাকে নিয়ে যাও হাত ধরে হতাশার নীল বালুচরে, তুমি বিরহ নাকি যন্ত্রণা, বল এই পোড়া অন্তরে।
স্মৃতির দুয়ার খুলে আজ জুয়েলকে আহ্বান করি, আপনার গান দিয়েই ফিরতি পথে ফিরে আসুন বারবার চিলেকোঠার এক দুপুরে, কোনো এক বিকেলে কিংবা কুয়াশা প্রহরে।
শুরু করেছিলাম শাফিন আহমেদকে দিয়ে। কিন্তু তাঁর কথা বলতে গিয়েই কলম স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিল জুয়েলকে নিয়ে। তাই আবার ফিরে যাচ্ছি শাফিন ভাইয়ের কাছে। যাঁকে নিয়ে বলতে গেলেই সব সময় আমার মনে হয় আমাদের দেশে এই মানুষটার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। তাঁকে নিয়ে আরও চর্চা করা উচিত ছিল। হয়তো এখন হবে। কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ার পর। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় যদি হয় মাইলস।
তবে যাঁর আলোয় আলোকিত হয়েছে মাইলস, তিনি শাফিন আহমেদ। ১৯৯১ সালে যখন ‘প্রতিশ্রুতি’ অ্যালবাম দিয়ে বাংলা সংগীতে মাইলসের আগমন ঘটল, তখন যেন একটা অভ্যুত্থান ঘটে গেল। সেই ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’ কিংবা প্রথম প্রেমের মতো প্রথম কবিতা এসে বলে’। যেন নতুন একটি রক ধারার গানের ঢেউ এসে লাগল বাংলা গানের শ্রোতাদের হৃদয়ে।
মনে পড়ে ৯৩ বা ৯৪ সালে বনানী মাঠে একটি কনসার্টের কথা। মাথায় হ্যাট আর চোখে রোদচশমা, পায়ে বুট, আর হাতে গিটার নিয়ে মঞ্চে উঠে এলেন ফ্যাশন আইকন এক রক তারকা শাফিন আহমেদ এবং তাঁর ব্যান্ড মাইলস। কিন্তু মাইলসকে ছাপিয়ে দর্শকের চোখ আটকে আছে শাফিন আহমেদের দিকেই। মাঠভর্তি দর্শক উন্মাতাল হলেন শাফিনের গানে কণ্ঠ মিলিয়ে। সেই চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি, ফিরিয়ে দাও আমার এ প্রেম তুমি, জ্বালা জ্বালা, ‘ধিকি ধিকি আগুন জ্বলে’।
শাফিন আহমেদের যে গান সব বয়সের শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে আছে, সেটি ‘আজ জন্মদিন তোমার’। প্রিন্স মাহমুদের লেখা ও সুর করা এই গানই যেন এখন জন্মদিনের অনন্য গান। কারও জন্মদিন হলেই বেজে ওঠে শাফিন আহমেদের গাওয়া এ গান।
শাফিন আহমেদ চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন একটি মাত্র গান। শাফি উদ্দিন শাফি পরিচালিত ‘ওয়ার্নিং’ ছবির এই গান আমারই লেখা। সুর করেছিলেন শওকত আলী ইমন। দ্বৈত এ গানে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন ন্যানসি। মনে পড়ে, গানটি তৈরি করার পর আমরা যখন খুঁজছিলাম, একটা ইউনিক মেল ভয়েস।
আমি প্রস্তাব করি, শাফিন আহমেদের নাম। তখন ইমন বললেন, উনি কি রাজি হবেন? আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখি। তারপর শাফিন ভাইকে ফোনে জানালাম। চলচ্চিত্রের একটি দ্বৈত রোমান্টিক গান। যেহেতু তিনি এর আগে প্লেব্যাক করেননি, তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগে জেনে নিলেন, গানটি সম্পর্কে। তারপর ইমনের সঙ্গে কথা বলে গানের আঙিক শুনে নিলেন। এরপর স্টুডিওতে এসে গাইলেন গানটি।ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন চমৎকার বন্ধুবৎসল একজন বড় ভাই। দেখা হলেই আগে বলতেন, শরীর কেমন। শরীরের দিকে খেয়াল রেখো। আজ মনে হচ্ছে, শাফিন ভাই অপরের শরীরের দিকে খেয়াল রাখতেন কেন। কারণ, তিনি নিজেই তখন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথেই হাঁটছিলেন। তাই অনেকটা নিভৃতেই চলে গেলেন ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ভোরে। সুদূর আমেরিকার নিউজার্সির একটি হাসপাতালে।আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাই বলি জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন আমি তোমায় ভালোবাসি।