নাচের সেই মেয়েটি আজ গানের মহাতারকা

নাচ থেকে শুরু; গানেই পেশাদার সংগীতজীবনের ৬০ বছর পূর্ণ করলেন রুনা লায়লাকোলাজ
গান রেকর্ডিংয়ের হিসেবে আজ রুনা লায়লার পেশাদার সংগীতজীবনের ৬০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি গেয়েছেন হাজার দশেক গান। স্বাধীনতা পদক ছাড়াও দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। সংগীতজীবনের ছয় দশক পূর্তি উপলক্ষে শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

সংগীতশিল্পী হিসেবেই পরিচিতি রুনা লায়লার। তবে তাঁর শুরুটা হয়েছিল নাচ দিয়ে। নাচ তাঁর পছন্দ ছিল। ছোট্ট রুনা লায়লার লম্বা সময় কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। সেখানে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে মেয়েকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমিনা লায়লা। এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। শিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। রুনা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন কত্থক আর ভরতনাট্যম। রুনা বললেন, ‘এখন আর সেসব মনে নেই। তবে মঞ্চে যখন গান করি, নিজের অজান্তেই তখন নাচের কিছু মুদ্রা চলে আসে।’

ছোটবেলায় নানি সব ভাইবোনকে টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকায় একেকজন একেক জিনিস কিনলেও নিজের টাকায় একজোড়া ঘুঙুর কেনেন রুনা। এই ঘুঙুর পরে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াতেন আর নাচতেন। নাচটা যে তাঁর খুব পছন্দের, মা জানতেন। তখন তিনি বলেন, ‘তোমার যেহেতু নাচের এতই শখ, একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিই।’ পরে চার বছর শিখেছেন রুনা। একাডেমির হয়ে অনেক পরিবেশনায়ও অংশ নেন।

ঢাকার পাঁচতারা হোটেলে প্রথম আলোর ক্যামেরায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা
ছবি : প্রথম আলো

পরে যে রুনা লায়লা বাঙালির অন্যতম প্রিয় সংগীতশিল্পী হয়ে উঠবেন, সেই রুনা কেবল নাচ নিয়ে থাকবেন; তা কি হয়! ভাগ্যই তাঁকে গানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বড় বোন দিনা লায়লা গানের তালিম নিতেন আবদুল কাদের, হাবিব উদ্দিন আহমেদের কাছে। পাশের ঘরে ঘুরে বেড়ানো রুনা তখন দৌড়াদৌড়ি করতে করতে বোন যা গাইতেন, তা-ই মুখস্থ করে ফেলতেন রুনা। পরে তিনিও গাইতেন। একদিন ওস্তাদ আবদুল কাদের রুনার গাওয়া গান শুনে ফেলেন। মুগ্ধ হন। বিস্মিতও হন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, একদিন রুনা লায়লা গানে অনেক সুনাম কুড়াবে। ওস্তাদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। নাচের তালিম নেওয়া রুনা লায়লা হয়ে ওঠেন বাংলা গানের মহাতারকা।

নাচ থেকে গানে

দুই পায়ে ঘুযুর পরে ঘরে দৌড়ে বেড়ানো ছোট্ট রুনা পাশের ঘরে বোন দিনা লায়লাকে শেখানো গান শুনেই মুহূর্তেই তুলে ফেলতে পারতেন। গুনগুন করে গাইতেন। সেই সময়ের কথা মনে করে রুনা লায়লা বললেন, ‘দীনা আপাকে ক্ল্যাসিক্যাল শেখাতেন ওস্তাদজিরা। আমি ঘরের মধ্যে দৌড়ে বেড়াতাম, যা শেখাচ্ছিলেন, তা মুখস্থ করে হুবহু করে গেয়েও দিতাম। একদিন যে উস্তাদজি এলেন, খেয়ালও করিনি। আমি গান গাইছি আপনমনে। উনি শুনে মাকে বললেন, ‘এই মেয়ের মধ্যে তো প্রতিভা আছে। ওকে গান শেখান। ও গানে ভালো করবে।’

কথায় কথায় রুনা বললেন, ‘ছোটবেলায় তো কোথাও বসতে চাইতাম না। খুব চঞ্চল ছিলাম। এখনো আছি। এক জায়গায় বেশি কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারি না। কিছু না কিছু করতেই থাকি। খুব দুষ্ট ছিলাম। দুষ্টামির জন্য মায়ের কত মারও যে খেয়েছি। আমাকে আর দিনা আপাকে আম্মা একই রকম খেলনা কিনে দিত। আমি আমার রেখে ওরটায় চড়তাম, আর ওরটাই ভাঙতাম। (হাসি)। এসবের জন্য যে কত মার খেয়েছি।’

ভাগ্যই তাঁকে গানের দিকে টেনে নিয়ে যায়
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

৬০ বছরের পথচলা

১৯৬৪ সালের ২৪ জুন। করাচির ইস্টার্ন স্টুডিওতে প্রথম গান রেকর্ড করে রুনা। পরের বছর ‘জুগনু’ ছবির সেই গান মুক্তি পায়। তখন রুনার বয়স ১২। বললেন, ‘লাহোর থেকে একটি ছবিতে গান করার প্রস্তাব আসে। আব্বা শুনেই না করেন। গান গাওয়া নিয়ে আব্বার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তখন অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো। তখন সব বড় শিল্পী রেডিওতে গান করতেন। ভাবতাম, একদিন রেডিওতে আমার নামও বলবে। সবাই আমার গান শুনবে। বাবাকে আমার ইচ্ছের কথা জানান মা। অনেক কষ্ট করে তিনি আব্বাকে রাজি করালেন। আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম।’

উর্দু ছবির গানটির শিরোনাম ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। পুরো এক মাস চর্চা করে রুনা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টা আর স্কুল থেকে ফেরার পর দুই ঘণ্টা। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মনজুর হোসেন। তিনিই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

রুনা বললেন, ‘মনজুর হোসেন সাহেব আমাকে সিনেমায় গাওয়ার কিছু কৌশল শিখিয়ে দেন। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে কণ্ঠ দিয়েছেন, তিনি তা ঘষে-মেজে পলিশ করেন।’ ছবিতে রুনার গাওয়া দ্বিতীয় গানটিও ছিল একই ছবির। এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান শর্মিলী আহমেদ। সেই থেকে আজও গেয়ে চলছেন রুনা লায়লা। বললেন, ‘অবাক হই, এতটা পথ পেরিয়ে এলাম! মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন। তবে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। আর সঙ্গে ছিলেন শ্রোতারা।’

বাঁয়ে বড় বোন দিনা লায়লা, সঙ্গে রুনা লায়লা
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

পেছন ফিরে তাকিয়ে

রুনা লায়লা প্রথম মঞ্চে গান করেন ছয় বছর বয়সে। তা–ও একদম হঠাৎ করেই। করাচিতে সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। এখানে গান করবেন দিনা (রুনার বড় বোন)। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। বিপদে পড়েন আয়োজকেরা। শেষে বড় বোনের জায়গায় ছোট বোনকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

রুনা বললেন, ‘ওই অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয় সংগীত করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ছয়। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি সেদিন ধুমধাম গেয়ে মাত করেছিলাম। তানপুরা নিয়ে গান করেছিলাম। আর ওই তানপুরা ছিল আমার চেয়ে দুই গুণ বড়। সবাই আমার গানে মুগ্ধ হন। খুশি হয়ে সেদিন অনেকেই আমার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।’

এরপর রুনার পরিচিতি বাড়তে থাকে। গানে গানে মুগ্ধতা ছড়াতে থাকেন। উর্দু, হিন্দির পাশাপাশি বাংলা গানও সমানতালে গেয়ে চলেন। রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’।

গত শতকের ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব পান রুনা। চলচ্চিত্র পরিচালক নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস স্বরলিপি ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। তাঁরা ছবির একটি গান রুনাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি দারুণ ব্যস্ত।

একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং করছেন। কাজ করতেন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শুনে রাজি হলেন রুনা। লাহোরের বারী স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। গানটির শিরোনাম ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। একই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন মাহমুদুন্নবী। বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি।’

বাংলাদেশে আসার পর প্রথম গান করেন সত্য সাহার সুরে জীবন সাথী ছবিতে। রুনা বললেন, ‘আমার সংগীতজীবনের ভ্রমণ খুবই স্মুথ ছিল। প্রথম গান গাওয়া থেকে শুরু করে কারও কাছে যেতে হয়নি। বাড়িতে এসে গান করে দিয়ে গেছেন। বলতে গেলে আমাকে কিছুই করতে হয়নি। স্ট্রাগল নামের কোনো জিনিসই স্পর্শ করতে পারেনি।

আশির দশকে ‘সুপার রুনা’ অ্যালবামের কাজের সূত্রে রুনা লায়লার সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ীর পরিচয়। সেই থেকে তাঁদের সম্পর্ক। পেশার কারণে সম্পর্কের শুরু হলেও, একটা সময় তা পারিবারিক সম্পর্কে রূপ নেয়।
ছবি : রুনা লায়লার সৌজন্যে

সংকটে যা করতেন

সংগীতজীবন বর্ণাঢ্য হলেও কিছু বাধা যে আসেনি, তা কিন্তু নয়। তবে এসব বাধা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। রুনা লায়লা বললেন, ‘অনেকভাবে অনেকে রুখতে চেয়েছে। বাধা হয়ে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। সেটা আল্লাহর মেহেরবানিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, মানুষের যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, দোয়া, আশীর্বাদ—এসবের কারণে খুব সহজে অতিক্রম করে চলে এসেছি, তাই আমাকে এফেক্ট করেনি। আমার বিশ্বাসও ছিল যে যা–ই করুক, কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমি পরিষ্কার মনে সবার সঙ্গে মিশেছি। কাজটা আন্তরিকতা ও ভালোবেসে করেছি।’

এখনকার স্বপ্ন

বাংলা ছাড়া উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন রুনা লায়লা। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচ, আরবি, পারসি, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজিসহ ১৭ ভাষায় গান করেছেন তিনি। পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুরে গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিদিন এই সুরকারের ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস বুকে।

বাংলা ছাড়া উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন রুনা লায়লা
কোলাজ

১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর রুনার গাওয়া বাপ্পি লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে সুপার রুনা অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। অ্যালবামের কাজ করেছিলেন লন্ডনের এবি রোডেস, যেখানে বিটলস গান রেকর্ডিং করত। দেশ–বিদেশে গান গেয়ে দাপুটে বিচরণ করা রুনা লায়লা বরাবরই তার পরের প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার একটি নাম। তিনি নিজেও স্বপ্ন দেখেন এখনকার প্রজন্মকে নিয়ে।

তিনি বললেন, ‘আমার পরের প্রজন্মের শিল্পীরা যেন আরও অনেক ওপরে ওঠে। অনেক নাম করে। ভালো করুক। প্ল্যাটফর্ম আরও বড় পাক। বিশ্বসংগীতাঙ্গনে নাম করুক।’

রুনা লায়লা প্রথম মঞ্চে গান করেন ছয় বছর বয়সে
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

গানে তৃতীয় প্রজন্ম

রুনা লায়লার একমাত্র মেয়ে তানি লায়লা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাঁর তিন সন্তান। বড় দুই সন্তানের গান প্রকাশের খবরের অনেক আগে জানা গেলেও দীর্ঘদিন কোনো খবরে নেই তাঁরা।

গতকাল দুপুরে জানালেন, ‘আমার বড় নাতি জাইন ব্যান্ড তৈরি করেছে, যেখানে সে ভোকাল আর তার তিন বন্ধু খুব ভালো বাজায়। সপ্তাহের ছুটির দিনে ওরা শো করে। ছোট নাতি অ্যারনও ভাবছে মিউজিক নিয়ে কিছু করবে। একদম ছোটজন আইজ্যাক, বয়স আড়াই বছর। ভালো গান গায়। একদিন আমি হামিং করছি, আমার দেখাদেখি দেখি সে–ও করছে। সুরও ঠিকঠাক। অনেক কার্টুনে গান থাকে না, একদম বিট থেকে ধরে সে। আমার তো মনে হয়, গান ওর শরীরজুড়ে। আমার বড় দুই নাতি সব ধরনের গান শোনে। ইংলিশ, হিন্দি, বাংলাসহ সব ওর মা শোনায়।’