হেলাল হাফিজের কবিতা থেকে গান, ‘পত্র দিয়ো’ ও অন্যান্য
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’, পঙ্ক্তি দুটির স্রষ্টা কবি হেলাল হাফিজ। সংগ্রামে, দ্রোহে, প্রতিবাদে তাঁর এই উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। পঙ্ক্তি দুটি এ কাব্যগ্রন্থের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকী’য় কবিতার।
১৯৬৯ সাল, গণ-অভ্যুত্থান চলছে। কবি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন রিকশায় চেপে যাচ্ছেন। হঠাৎ সামনে মিছিল চলে আসায় রিকশাচালক ব্রেক কষে থামলেন। মিছিলকারীদের থামাতে পুলিশ ধাওয়া দিতে শুরু করলে উল্টো দিক থেকে মিছিলকারীরাও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করলেন। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রিকশাচালক বললেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ কথাটা কানে পৌঁছাতে কবির মনে ভাবনার উদয় হয়। ‘আসলেই তো তা–ই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে।’ পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার সূত্রেই কবি রচনা করেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’।
১৯৪৮ সালে ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় কবি হেলাল হাফিজের জন্ম। বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার ও মা কোকিলা বেগম। শৈশবে মাকে হারান কবি। আপন মানুষ বলতে ছিলেন কেবল বাবা। তিনিও ১৯৭৩ সালে না–ফেরার দেশে পাড়ি দিলে কবি পুরোপুরি একা হয়ে যান। সংসারে থাকতে অবলম্বন লাগে, অবলম্বন মানে মানুষ—একান্তই আপন মানুষ। কিন্তু কেউ নেই। তাই জগৎসংসারকে তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হয়। কথায় আছে, খারাপ সময়ে পরপর খারাপ ঘটনা ঘটে। কবির জীবনেও এ ঘটনা ঘটেছে। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর তাঁর যে প্রেমিকা হেলেন, তিনিও কবির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান।
কবিকে ডেকে বলেন, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।’ জবাবে কবি কি বলেছিলেন হেলেনকে? না, তেমন কিছু বলেননি। অনুরোধও করেননি, আঁকড়ে ধরেও রাখেননি। কীভাবে সামলেছিলেন পরিস্থিতি। এক লেখায় জানিয়েছেন কবি। ‘ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে…চলে এলাম।’
জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা কবি কাউকে বুঝতে না দিলেও ঘটনাদ্বয় ভেতরে-ভেতরে তাঁকে এলোমেলো করে দেয়। বাবার চলে যাওয়ায় কিছুই করার ছিল না তাঁর। কিন্তু হেলেন? যাঁকে ভালোবেসে সম্রাজ্ঞি করেছিলেন, তাঁকে কেন যেতে দিলেন, আটকাতে কি পারতেন না? হয়তো পারতেন অথবা পারতেন না কিংবা কবিরা হয়তো এমনই। কবিতার বিশালতার মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে তুমুলভাবে ভালোবেসেও জোর করে থেকে যাওয়ার দাবিটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেন না। সে কারণেই হয়তো ‘প্রতিমা’ শিরোনামের কবিতায় কবি বলেছেন, ‘অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে/ মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’।
‘এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, পত্র দিয়ো।…কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে/ কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে/ পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।’ ‘প্রস্থান’ শিরোনামের এ কবিতার শেষে গিয়ে যখন কবি বলেন, ‘এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে,/ এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে’; তখন কথাগুলো হৃদয়ে হিল্লোল তোলে। জনপ্রিয় এই কবিতা থেকে কিন্তু গানও হয়েছে। ইউটিউবে প্রকাশিত গানটি ইমন চৌধুরীর সুর ও সংগীতায়োজনে গেয়েছেন তানজীর চৌধুরী।
‘তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?/ পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো’। পঙ্ক্তি দুটি মনে মনে আওড়ান অনেকেই। ফেসবুকেও পঙ্ক্তি দুটি অনেককে শেয়ার করতে দেখা যায়। পঙ্ক্তি দুটি হেলাল হাফিজের ‘অমীমাংসিত সন্ধি’ কবিতার। এই কবিতাতেই কবি আবার বলেছেন, ‘থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত/ পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত’। জনপ্রিয় এই কবিতা থেকেও হয়েছে গান। ‘দিন-দ্য ডে’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে গানটি। গাওয়া হয়েছে বাংলা ও ফারসি দুই ভাষাতে। ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুমিত আল রশিদ। গানটি গেয়েছেন বেলাল খান ও মোহাম্মদ রেজা হেদায়েতী।
তাঁর ‘তুমি ডাক দিলে’ কবিতাটিও জনপ্রিয়। ‘একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,/ কতো হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার’। কবিতার এই পঙ্ক্তি দুটিও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘ডাক’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেষে কবিতায় কবি বলেছেন, ‘একবার আমন্ত্রণ পেলে/ সব কিছু ফেলে/ তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,/ অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে/ লোকালয়ে থাকবো না আর/ আমরণ পাখি হয়ে যাবো, —খাবো মৌনতা তোমার’। ‘আজব কারখানা’ সিনেমায় কবিতাটি থেকে গান রূপায়ণ করা হয়েছে। কবিতা ‘ফেরীওয়ালা’ ও ‘যাতায়াত’ থেকেও গান হয়েছে সিনেমাটিতে। ভাইকিংসের সংগীতায়োজনে ‘ফেরীওয়ালা’ কবিতা থেকে নির্মিত ‘কষ্ট’ শিরোনামের গানটি গেয়েছেন তন্ময় তানসেন।
‘আজব কারখানা’ সিনেমার আবহ সংগীত পরিচালনা করেন শিল্পী লাবিক কামাল গৌরব। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘তাঁর (হেলাল হাফিজের) চারটি লিরিক (কবিতা) থেকে পাঁচটি গান দাঁড়িয়েছে। আর একটা গান থেকে দুটি ভার্সন করা হয়েছে, একটি ফোক আর একটি রক। তিনটি রক (কষ্ট, তোমাকেই চাই, কেউ জানে না, আমার কেন এমন হলো) গান করেছে ভাইকিংস।’ ‘একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতটা কাঙাল’ শিরোনামের গানের দুটি ভার্সন নিজেই করেছেন গৌরব।
হেলাল হাফিজের কবিতা মিলনে–বিরহে, যাপিত জীবনে—প্রতিটি পরশে মানুষ আপন করে নিয়েছে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই তাঁকে দিয়েছে অসাম্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। আজ পৃথিবীর বাতাসে শেষ নিশ্বাস ছেড়ে না–ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন প্রতিভাশালী এই কবি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।