কিছু প্রস্থান মনে দাগ কাটে...
বেঁচে থাকলে আজও হয়তো কোনো অনুষ্ঠানে গাইতেন তিনি কিংবা থাকতেন কোনো রেকর্ডিং স্টুডিওতে। কাজকর্মে ব্যস্ত না থাকলে হয়তো পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোনো আড্ডায় মেতে থাকতেন। কিন্তু সব অতীত করে এখন চিরঘুমে তিনি। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলা সংগীতে এক নক্ষত্রের দৈহিক প্রস্থান হয়েছে। তিনি সুবীর নন্দী, বাংলা সংগীতের এক বিস্ময়কর নাম।
চার বছর আগের এই দিনে সংগীতের সঙ্গে তাঁর সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। অনন্তের যাত্রী এখন তিনি। তাই তো তাঁর দীর্ঘদিনের অনুজপ্রতিম সহযাত্রী কনকচাঁপা নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একদিন সবাই বাঁধন কাটে। আগে আর পরে। কিন্তু কিছু প্রস্থান মনে দাগ কাটে। হে সুরের পিয়াসী, আপনার রেখে যাওয়া সুরের রেখা এখন পাথরকাটা পথ। স্রষ্টা আপনাকে ভালো রাখুন।’
২০১৯ সালের ৭ মে। অন্ধকার শেষে ঠিক যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, তখনই সিঙ্গাপুর থেকে খবর এসেছিল, বাংলাদেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী আর নেই। ৬৬ বছর বয়সে তাঁর পৃথিবীর ভ্রমণ শেষ হয়। সুবীর নন্দীর এই চলে যাওয়াতে কেউ হারিয়েছেন আত্মার মানুষ, কেউবা তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎসকে।
সুবীর নন্দীর চলে যাওয়া নক্ষত্রের পতন মনে করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা। তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘কিংবদন্তি সুবীর নন্দীর মৃত্যু একটি নক্ষত্রের পতন। তাঁর গান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে যাবে। যেখানে যান না কেন, তিনি এবং তাঁর গান সব সময় আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’
দুই বোন ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী একসঙ্গে ‘ফেরারি বসন্ত’ নামের একটি সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। গানের কয়েকটি লাইন ছিল এমন ‘আমি কাঁটার ভুবনে, আলোর পিয়াসী, সুরের আগুনে পুড়ি, এক নতুন পৃথিবী গড়ি।’ ছবিতে বাবা এবং দুই মেয়ের কণ্ঠে ছিল গানটি।
ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আব্বার গানের ভক্ত ছিলেন সুবীর কাকা, আব্বাকে অনুসরণও করতেন। তাই আব্বার ১০টি গান দিয়ে অ্যালবাম তৈরি করেন। সেই তখন থেকে কাকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল বাবা-সন্তানের মতো। মা বলে ডাকতেন। তাঁর একমাত্র সন্তান মৌকে যেমন করে ডাকতেন, তেমনি করে ভালোবাসতেন আমাদেরও। কাকাকে কখনো না বলতে শুনিনি। শুধু গান গাইলেই মানুষের মনে জায়গা করা যায় না। বিনয়ী, ধৈর্যশীল, রুচিশীল ও নিরহংকারী হতে হয়—সুবীর কাকা তা-ই ছিলেন। একজন প্রকৃত শিল্পী।’
১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় সুবীর নন্দীর জন্ম। সুবীর নন্দীর সংগীতে হাতেখড়ি মা পুতুল রানীর কাছে। পরে ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন। সিলেট বেতারে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬৭ সালে। ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম গান করেন ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ শিরোনামের। গানটি কথা রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম।
বরেণ্য এ শিল্পী দীর্ঘ ৪০ বছরের সংগীতজীবনে গেয়েছেন আড়াই হাজারের বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রেও উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। ১৯৮১ সালে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ বাজারে আসে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে। সুবীর নন্দী প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীকে।
সুবীর নন্দীর গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্যে আছে ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বারাত নিয়া’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘এক যে ছিল সোনার কইন্যা’ এবং ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’।