ক্রিপটিক ফেইটের গানে গানে মুক্তিযুদ্ধের গল্প

‘নয় মাস’ অ্যালবামের লাইনআপ; অ্যালবামের কাজ শেষ হওয়ার পর ব্যান্ডটি ছেড়েছেন রাফাছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

গায়ক ও গিটারিস্ট শাকিব চৌধুরীর বাবা চিকিৎসক দেলোয়ার রানা একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন। শাকিবের চাচা, মামারাও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আড্ডায় রণাঙ্গনের গল্প শুনে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যালবামে হাত দেন শাকিব। গানে গানে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে ‘নয় মাস’ অ্যালবাম প্রকাশ করেছে হেভি মেটাল ব্যান্ড ক্রিপটিক ফেইট। অ্যালবামে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসকে তুলে ধরে ৯টি গান রয়েছে।

আরও পড়ুন

গত বুধবার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্যান্ডের দলনেতা শাকিব চৌধুরী জানান, এটি একটি কনসেপ্ট অ্যালবাম। ২৫ মার্চের কালরাত থেকে বিজয় দিবস পর্যন্ত সময়টাকে গানে গানে তুলে ধরেছেন তাঁরা।

রক ও হেভি মেটাল জনরায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব একটা অ্যালবাম হয়নি। ২০১৩ সালে এই অ্যালবামের কাজে হাত দেয় ক্রিপটিক ফেইট; মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সব গান প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল। তবে ‘আক্রমণ’ ও ‘ভোরের অপেক্ষা’ শিরোনামে দুই গান প্রকাশের কাজটা থমকে যায়। অ্যালবামটি শেষ করতে এক দশকের বেশি সময় খরচ হয়ে গেছে।

‘প্রথম ছয় মাস অ্যালবামের কাজ করতে পেরেছিলাম। পরে কাজটা আর শেষ করতে পারিনি। আমরা সবাই চাকরিজীবী; শখের বশে গান করি। তবে তখন শেষ করতে না পেরে ভালোই হয়েছে, তখনকার প্রযুক্তির চেয়ে এখনকার প্রযুক্তি আরও উন্নত। অ্যালবামটা ভালো হয়েছে।’ বললেন শাকিব চৌধুরী।

মাঝে ২০১৭ সালে অ্যালবামের আরেক গান ‘রাতের শেষ’ প্রকাশ করেছে ব্যান্ডটি। বাকি ছয় গানের মধ্যে ‘বুদ্ধিহত্যা’, ‘মিত্র’, ‘বিচ্ছু’, ‘মহড়া’, ‘বিদায়ের গান’ ও ‘কালবৈশাখী’ আগে প্রকাশ করা হয়নি।

‘নয় মাস’ ক্রিপটিক ফেইটের চতুর্থ অ্যালবাম। এর আগে তৃতীয় অ্যালবাম দানব প্রকাশ হয়েছিল ২০০৬ সালে। প্রায় দেড় যুগ পর কোনো অ্যালবাম নিয়ে এসেছে ব্যান্ডটি।
‘আমাদের অবশ্যই খারাপ লাগে। বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। আমরা চাকরি করি, শখের শিল্পী। ফলে বিষয়টি মেনে নিতে হয়েছে। এখন অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’ বলেন শাকিব।

আগে নিজেদের স্টুডিও ছিল না; অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণেও ছিল না। বছর তিনেক ধরে নিজেদের অনেকটা গুছিয়ে এনেছেন তাঁরা। এখন নিজেদের প্যাড করেছেন, রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রপাতিও কিনেছেন।

শাকিবের ভাষ্যে, ‘এত দিন ধরে খুবই বাজে অবস্থা ছিল। এখন আরও ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারছি। সামনে কোনোমতেই বিদঘুটে লম্বা বিরতি হবে না। এখন নিয়মিত গান করছি।’

অ্যালবামের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন গিটারিস্ট ফারহান সামাদ, মাস্টার করেছেন এ কে রাতুল। এই অ্যালবাম স্পটিফাই, ইউটিউবসহ আরও কয়েকটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হয়েছে।

অদ্ভুত সেই ছেলেটির চমক
এই ব্যান্ডে চমক হিসেবে হাজির হয়েছেন ব্যান্ড তারকা সুমন। ‘বিদায়ের গান’টি গেয়েছেন অদ্ভুত সেই ছেলেটি; সঙ্গে রয়েছেন শাকিব চৌধুরী। ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’ গানের সুবাদে এই নামেও পরিচিতি পেয়েছেন সুমন। এই গানের জন্য সুমনকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে ভাবতে পারেননি শাকিব।

শাকিব বলেন, ‘এই গানের বিষয়বস্তু, ছেলেরা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে। গানে দুই ধরনের ছেলের কথা বলছি। এক ধরনের ছেলে শান্তশিষ্ট। আরেক ধরনের ছেলে ডানপিটে। ডানপিটে ছেলের কথা মাথায় আসতেই অদ্ভুত সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল। সুমন ভাইকে বললাম, এই গানের সঙ্গে অদ্ভুত সেই ছেলেটির ব্যাপারটা যায়। আপনি গানটা গাইলে গর্ববোধ করব। সুমন ভাই গেয়েছেন, আমরা খুবই খুশি। গানটা খুব ভালো হয়েছে।’

শাকিব বলছেন, ‘আর্টসেল, ব্ল্যাক, নেমেসিস, ক্রিপটিক ফেইট, আরবোভাইরাসসহ আরও বহু ব্যান্ডের পেছনে সুমন ভাইয়ের বড় অবদান রয়েছে। সুমন ভাইয়ের কথাতেই আমাদের অ্যালবাম করতে রাজি হয়েছিল জি–সিরিজ। পরে সুমন ভাই আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে যান। সুমন ভাইকে দিয়ে ক্রিপটিক ফেইটের একটা গান গাওয়ানোর খুব ইচ্ছা ছিল।’

অ্যালবামের নাম ‘নয় মাস’
ছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে
বর্তমান লাইনআপ
শাকিব চৌধুরী (ভোকালিস্ট, বেজিস্ট), খাজা সরফরাজ লতিফুল্লাহ (গিটারিস্ট), ফারহান সামাদ (গিটারিস্ট) ও জেফরি অভিজিৎ ঘোষ (ড্রামার)।

ছাড়লেন রাফা, এলেন জেফরি
রাফা এখন আর ক্রিপটিক ফেইটে না থাকলেও ‘নয় মাস’ অ্যালবামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। অ্যালবামের কাজ শেষ করার পর গত বছরের অক্টোবরে ব্যান্ডটি ছেড়েছেন তিনি। আলোচনার ভিত্তিতে ব্যান্ডটির সঙ্গে এক দশকের পথচলার ইতি টেনেছেন রাফা।

রাফা ছাড়ার পর ড্রামার হিসেবে ব্যান্ডে যোগ দেন জেফরি অভিজিৎ ঘোষ। শাকিব জানান, জেফরির সঙ্গে ক্রিপটিক ফেইটের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন রাফা। জেফরির সঙ্গে জয় বাংলা কনসার্টসহ কয়েকটি শোও করেছে ব্যান্ডটি। ক্রিপটিক ফেইটের সঙ্গে তাঁর ভালো বোঝাপড়া ছিল। চার বছর ধরে জেফরি নেমেসিসে লাইভ ড্রামার হিসেবে যুক্ত ছিলেন, তবে সদস্য ছিলেন না। নেমেসিসের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তাঁকে নেওয়া হয়েছে।

রাফা ছাড়ার পর ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপে এসেছেন জেফরি
ছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

রয়্যালটি
কনসার্ট, রেস্তোরাঁ, রেডিও কিংবা টেলিভিশনে গান বাজলেও নিয়মিত প্রাপ্য রয়্যালটি বুঝে পান ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের গীতিকার, সুরকারেরা। তবে বাংলাদেশে এই চর্চা নেই। গানের স্বত্বাধিকারীদের প্রাপ্য রয়্যালটি সংগ্রহে কাজ করছে বাংলাদেশ লিরিসিস্টস, কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি (বিএলসিপিএস)। সম্প্রতি বিএলসিপিএসের কনফারেন্সেও দেখা গেছে শাকিবকে।

তাঁর ভাষ্যে, ‘এটা ইতিবাচক একটা ঘটনা। ইন্ডিয়াতে আছে, পশ্চিমে আছে। শুধু ইউটিউব ও স্পটিফাই থেকে নয়, যেখানে আমাদের গান বাজানো হচ্ছে, সেখান থেকেই টাকা পাওয়ার কথা। এটা অবশ্যই দরকার, এটা করা কঠিন হবে। আশা করি তিন–চার বছর পর থেকে সুফল দেখতে পাব।’