এমনও হাসি আছে বেদনা মনে হয়...
‘সুখেও কেঁদে ওঠে মন, এমনও হাসি আছে বেদনা মনে হয়, জলে ভরে দুনয়ন’। ১৯৮৫ সালে ‘মিলন তিথি’ চলচ্চিত্রের গানটির কথা মনে পড়ছে কিশোর কুমারের জন্মতিথিতে। আজ ৪ আগস্ট তাঁর ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালে ৪ আগস্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর খান্ডোয়ার একটি ছোট গলির ছোট্ট বাড়িতে জন্ম কিশোর কুমারের।
বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আজ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকত। থাকত টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রাম। জীবনকে যেভাবে উপভোগ করতেন তিনি, এসব থাকাটাই স্বাভাবিক।
আচ্ছা, জন্মদিন উপলক্ষে কিশোর কুমার কী নিজের গাওয়া কোনো গানের লাইন দিতেন তাঁর স্ট্যাটাসে? কোন গানটা শেয়ার করতেন? ‘সুখেও কেঁদে ওঠে মন, এমনও হাসি আছে...’ গানটা খুব বেশি যে জনপ্রিয় তা নয়, অথচ তাঁর সঙ্গে খুব মানিয়ে যায়। নাকি দিতেন ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’, ‘ওরে মনপাগল তুই কেন কেঁদে মরিস’, ‘চোখের জলের হয় না কোনো রং’ নাকি ‘হাওয়া, মেঘ সরায়ে, ফুল ঝরায়ে ঝিরিঝিরি এলে বহিয়া খুশিতে ভরেছে লগন আজ ওঠে মন ভরিয়া’ নাকি ‘ওপারে থাকব আমি তুমি রইবে এপারে, শুধু আমার দুচোখ ভরে দেখব তোমারে’ বা ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’ গানটা? কী আশ্চর্য সব কটি গানই মনে পড়ছে!
হয়তো নিজের গানের আশ্রয় নিতেন না তিনি। তাহলে কি দিতেন? হাসির কিছু, নাকি বেদনার? চলচ্চিত্রের কোনো সংলাপ দিতেন? তবে নিজের গানের কলি দিয়ে স্ট্যাটাস দিতে হলে বেচারা নিশ্চিত মুশকিলে পড়তেন। এত এত গান, এত শ্রোতাপ্রিয় গান!
এই যেমন ফেসবুকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার পর থেকেই নানাভাবে ভেসে আসছেন কিশোর কুমার। তাঁর জন্মদিনে ইউটিউবে ঢুঁ মারি। একের পর এক গান। মন্তব্যের ঘরে গিয়ে বুঝতে বাকি নেই, সেখানেও সাম্প্রতিক শ্রোতা যোগ দিয়েছেন। মন্তব্যের ঘরে মিলল নানা বয়সের মানুষ। যে মন্তব্যগুলো বেশি দেখা গেছে, সেগুলো হলো—এই গানগুলো সারা জীবন অমর হয়ে রয়ে যাবে মানুষের অন্তরে। তুমি সেরা ছিলে, আছ, আর থাকবে।
এ হে...আহা হা...
রোববার সকালে ইউটিউবে কিশোর কুমার শুনতে শুনতে খুব চেনা একটা আওয়াজে আবার শ্রবণযন্ত্র নতুন করে উদ্দীপ্ত হয়, ‘এহে...আহা হা হুম হুম...।’ রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর পাহাড়ে। রাজেশ খান্নার ঠোঁটে আওয়াজটা। ‘আরাধনা’ চলচ্চিত্রের ‘কোরা কাগাজ থা ইয়ে মান মেরা’ গানটি শুরু হওয়ার আগে আলাপ। এমন একটা আলাপ, সেটা মুহূর্তে যে কাউকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। যেমন পারে এ ছবিরই অন্য গানগুলো, বাংলায় যা এ রকম, ‘মোর স্বপ্নের সাথি তুমি কাছে এসো’, ‘গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর’। আহা, কী আওয়াজ, কী গায়কি! আর অভিনয়?
মাঝেমধ্যে ধন্দ লেগে যায়, তিনি কি অভিনেতা, না গায়ক। তবে গায়ক পরিচয়টাই তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে তুলেছে—এ কথা বললে ভুল বলা হয় না।
‘প্রতিভা’, এমনকি তার চেয়েও বড় কোনো শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে কিশোর কুমার তা-ই। এ কথা আবেগের। যুক্তিরও। কি বাংলা, কি হিন্দি—দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে গেয়ে চলেছেন কিশোর কুমার। অভিনয় করেছেন। এমন নয় যে শখের বশে। পেশাদার শিল্পীর মতোই, দাপটের সঙ্গে।
১৯৮৭ সালে ১৩ অক্টোবর ৫৮ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে কিশোর কুমারের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর ৩২ বছর পরও আজও তাঁর গান সমান জনপ্রিয়। ভারতে এমনকি বাংলাদেশে এমন ঘরোয়া কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ কোনো গানের আসর হয় না, যেখানে কিশোর কুমারের গান থাকে না। ছোট থেকে বড়, সবাই তাঁর গানে মুগ্ধ। একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশির ভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। লোক হাসানোয় তিনি ছিলেন ওস্তাদ—সেটি পর্দার ভেতরে হোক বা বাইরে। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তাঁর মতো কেউ নেই, কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারেন। নতুন কোনো সংগীত পরিচালক যখন কোনো গানে সুর দেন, সুর দেওয়ার পর এখনো অনেকে আফসোস করে বলেন, যদি তাঁর সেই গান কিশোর কুমার গাইতেন!
গাইতে গাইতে গায়েন
কী ছিল তাঁর কণ্ঠে? কী যেন একটা ছিল, যা শুনলেই মনে হয় কণ্ঠটা চুম্বকের মতো টানে। কোমল, মধুর, কখনো দরাজ ছিল তাঁর কণ্ঠ। গায়কিও কী অসাধারণ! অথচ শুরুতে গানের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না তাঁর। জীবনকালে খুব একটা সাক্ষাৎকার না দিলেও আড্ডা-আলাপচারিতায় তিনি এমনটাই বলেছেন, জানিয়েছিলেন। কিশোর কুমার বরাবরই স্বীকার করে এসেছেন, তিনি সংগীত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। মন থেকেই তাঁর গান গাইতে ভালো লাগত। পরিণত কিশোর কুমারও হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারতেন না। বাজাতে গিয়ে ভুল হলে হাল ছেড়ে দিয়ে খালি গলায় গেয়ে দিতেন। এমনও শোনা গেছে, সিঙ্কোপেইটেড নোটস থাকলে নাকি তাঁর যেন দম আটকে আসত!
প্রকৃতির উপহার হিসেবে গলায় সুর নিয়েই যেন জন্মেছিলেন। এ নিয়ে একটা মজার তথ্যও দিয়েছিলেন বড় ভাই অশোক কুমার। ছোটবেলায় নাকি গানের গলা একদম ভালো ছিল না কিশোরের। একবার কিশোর কুমার পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত পাওয়ার পর তিন-চার দিন নাকি তিনি শুধু কেঁদেছেন। সেই কান্নার পর তাঁর গলায় কী এক পরিবর্তন এল, গলায় সুর চলে এল, আওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেল। হতে পারে এটা নেহাত কৌতুক করে বলা, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই কয়েক দিনের কান্না অনেক যুগের কোটি মানুষের মনের খোরাক হয়ে চলে আসছে।
প্রকৃত নাম আভাস কুমার গাঙ্গুলি। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি পেশায় উকিল ছিলেন। আর মা গৌরী দেবী ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। এ কথা তো সবাই জানেন, প্রখ্যাত বলিউড তারকা অশোক কুমার কিশোরের বড় ভাই। চার ভাইবোনের মধ্যে কিশোর ছিলেন সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই গান ও অভিনয়ের প্রতি অদ্ভুত টান ছিল কিশোরের। বড় ভাই অশোকের সাফল্য তাঁকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। ভাইয়ের অনুপ্রেরণাই কিশোরকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূর। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের ভক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি তাঁকে নকল করে গানও গাইতেন। ছোটবেলা থেকেই অন্যকে নকল করে দেখানোর শখ ছিল। সবার নকল করে বেড়াতেন তিনি।
১৯৪৯ সালে প্রথম ‘জিদ্দি’ চলচ্চিত্রে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেবানন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্রজগতে পদচারণ শুরু করেন। এরপর ১৯৫১ সালে ‘আন্দোলন’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে দেখা যায় তাঁকে। ১৯৫৪ সালের পর থেকে ‘নউকরি’, ‘নিউ দিল্লি’, ‘আশা’, ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পারোসান’, ‘ঝুমরু’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রতিটিতেই গান গেয়েছেন শুধু নিজের জন্য। ১৯৬৮ সালের আগপর্যন্ত তিনি হয় নিজের জন্য, না হয় দেবানন্দের জন্য গেয়েছেন। অন্য কোনো অভিনেতার জন্য নয়।
কিশোর কুমারের অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পারোসান’ এখনো ইউটিউবে খোঁজা ছবির মধ্যে অন্যতম। ছবিগুলোর প্রতিটি গানই সমান জনপ্রিয়।
গানগুলোর মধ্যে তাঁর হাস্যরসাত্মক কাণ্ডগুলো যে কাউকেই অভিভূত করবে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর সংগীত পরিচালনা করেছেন সলীল চৌধুরী, এস ডি বর্মনের মতো বিখ্যাত সংগীত পরিচালকেরা। এ সময়ে তাঁর বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ‘ছোটা সা ঘার হোগা বাদাল কি ছাও মে’, ‘ইনা মিনা ডিকা’, ‘নাখরে ওয়ালি’, ‘পাঁচ রুপিয়া বারা আনা’, ‘এক লাড়কি ভিগি ভাগি সি’, ‘চিল চিল চিল্লাকে’ ‘এক চাতুর নর’, ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে’, ‘মেরি মেহবুব কেয়ামাত হোগি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ছিল।
১৯৬৫ সালের পর দর্শকেরা আর গ্রহণ করছিলেন না অভিনেতা কিশোর কুমারকে। এতে কিশোর কুমার ভেঙে পড়েন। কোনোভাবেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার তত দিনে জীবনযাপনে আসে পরিবর্তন। তারকাজীবন বলে কথা! এ পরিস্থিতিতে আয়কর দিতেও হিমশিম খাচ্ছিলেন। জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চে গান করা শুরু করলেন। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রে যেহেতু তিনি নিজের এবং দেবানন্দ ছাড়া অন্য কোনো নায়কের জন্য গান করেননি, তাই সেখানেও কাজ কমে যাচ্ছিল।
এমন সময় শচীন দেববর্মন তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। নায়ক ছিলেন তখনকার নতুন ক্রেজ রাজেশ খান্না। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি গান দর্শকেরা পছন্দ করল। কিশোর কুমার হয়ে গেলেন সুপারহিট।
রফি নাকি কিশোর
শচীন দেববর্মনের হাত ধরে যেন নতুন জীবন পেলেন কিশোর কুমার। এর পর থেকে বলিউডের সবাই তাঁকে দিয়ে তাঁদের গান গাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। এই সময়টাতে চলচ্চিত্রগুলোর বেশির ভাগ গান মোহাম্মদ রফি গাইতেন, অর্থাৎ তখন ছিল রফির রাজত্ব। সে রাজ্যে কণ্ঠ নিয়ে হানা দিলেন কিশোর কুমার। একসময় তো এমন বিতর্ক শুরু হলো যে কে ভালো গায়ক, রফি নাকি কিশোর?
‘ফিল্মিস্তান’ নামক এক ম্যাগাজিন ছিল, যেখানে পাঠকেরা এ নিয়ে লিখিত বিতর্ক করা শুরু করে দিলেন। এ রকম দুই-তিন সংখ্যা চলার পর কিশোর কুমার সেখানে একটি চিঠি লেখেন এবং তাঁদের অনুরোধ করেন, তাঁকে রফি সাহেবের সঙ্গে যেন তুলনা না করা হয়। মোহাম্মদ রফি অনেক বড় শিল্পী। তাঁর যে সংগীতশিক্ষা, কিশোর কুমারের সেটি নেই। তিনি যেসব গান গেয়েছেন, সেগুলো কি কিশোর কুমার কখনো গাইতে পারবেন?
নিজের মতো গাইতে থাকলেন কিশোর কুমার। রাজেশ খান্নার তেজ একটু কমতে না কমতে অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন কিশোর কুমার। দেখতে দেখতে এমন হলো, অমিতাভের ছবি মানেই সেখানে কিশোর কুমারের গান। এবার শচীনপুত্র রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে যোগ হয় কিশোরের। এখানেও সফল।
একে একে তৈরি হয়, ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’, ‘হামে অর জিনে কী’, ‘দেখা এক খাওয়াব’, ‘সাগর কিনারে’, ‘চেহরা হে ইয়া’, ‘ইয়ে দোস্তি’, ‘রিমঝিম ঘিরে সাওয়ান’-এর মতো গানগুলো।
সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন
‘ওগো বধূ সুন্দরী’র ছবির কথা মনে আছে হয়তো অনেকের। ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে উত্তমকুমারের ঠোঁটে ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল কিছুই বুঝতে পারবে না’ গানটি ছিল দারুণ নাটকীয়। উত্তমকুমার অভিনয় করলেও গানটা শুনলে চোখে ভাসে রেকর্ডিংয়ের সময় না জানি কতটা অভিনয় করেছিলেন কিশোর কুমার।
কিংবা ‘অমানুষ’ ছবির ‘যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে’ রোমান্টিক গানটি! বাংলায় একের পর এক কিশোর কুমারের গান জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। মহানায়ক উত্তমকুমারের জন্য গেয়েছেন তিনি অনেক গান। ‘আমার স্বপ্ন তুমি, ওগো চিরদিনের সাথি’, ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’, ‘এই তো জীবন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন তিনি। তাঁর ‘চারুলতা’ চলচ্চিত্রে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি গেয়েছিলেন। আবার তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ চলচ্চিত্রেও গান করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতে, কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতির দৃশ্যে মানিয়ে যায়।
সংসারজীবনে উত্থান-পতন
জীবনের প্রথম দিকে অনেক ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছিল কিশোর কুমারকে। যদিও তাঁর বড় ভাই অশোক কুমার তত দিনে বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন, তবু তাঁর পথ সোজা ছিল না। অনেক নির্দেশক, প্রযোজক তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে কখনো পিছিয়ে যাননি। এমনও সময় এসেছিল, তিনি সংগীতের কোনো একটি দলের মধ্যে কোরাস গান করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বেশ কয়েকবার আঘাত পেয়েছেন। প্রথম প্রথম যাঁরা তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন, তিনি তাঁদের কখনো ভুলতেন না। একবার কিশোর কুমারের কাছে এক প্রযোজক আসেন চুক্তি স্বাক্ষর করানোর জন্য। কিশোর কুমার তাঁকে বলেন, তিনি স্বাক্ষর করবেন কিন্তু বাসায় না। গঙ্গার ধারে দুটি নৌকা পাশাপাশি থাকবে। সেখানে তাঁরা দুজন ধুতি-কুর্তা পরে যাবেন। কপালে লাল ফোঁটা আর সেই ফোঁটার ওপর একটি চাল বসানো থাকবে। এভাবে সেই নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ছবির চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করবেন। কিশোর কুমার যদি কারও সঙ্গে কাজ করতে না চান, তাহলে এমন অভিনব উপায়ে তাঁদের মানা করে দিতেন।
এই অসামান্য শিল্পী সংসারজীবনে নানা উত্থান-পতনের সম্মুখীন হয়েছেন। চারবার বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমার। প্রথম বিয়ে করেন রুমা গুহ ঠাকুরতাকে। রুমাও কিশোরের মতো একাধারে অভিনয় ও সংগীতশিল্পী। ১৯৫১ সালের মে মাসে মুম্বাইয়ে কিশোর কুমারের সঙ্গে রুমার বিয়ে হয়। পরের বছর জুলাইয়ে তাঁদের সন্তান অমিত কুমারের জন্ম হয়। রুমা দাবি করেন, কিশোর চেয়েছিলেন তিনি যেন তাঁদের সংসার সামলান। কিন্তু রুমা কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ নিয়েই দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুজনের মধ্যে। ১৯৫৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়।
কিশোর কুমার এরপর বলিউডের মেরিলিন মনরোখ্যাত মধুবালাকে বিয়ে করেন। মধুবালার পরিবারের শর্ত ছিল, বিয়ে করতে হলে কিশোর কুমারকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। তাই ধর্মান্তরিত হয়ে করিম আবদুল নাম নেন কিশোর কুমার। অন্যদিকে, কিশোরের পরিবার মধুবালাকে কখনোই মেনে নেয়নি। মধুবালার হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রে বাসা বেঁধেছিল অসুখ। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই কিশোর কুমার বাড়ি ছেড়ে মুম্বাইয়ের বাংলোয় নিয়ে আসেন মধুবালাকে। সেখানেই নয় বছর অসুস্থ মধুবালার সঙ্গে সংসার করেন। ১৯৬৯ সালে মধুবালা মারা যান। কিশোর কুমারের তৃতীয় স্ত্রী বলিউড অভিনেত্রী যোগিতা বালি। ১৯৭৬ সালে বিয়ে। মাত্র দুই বছর সংসারের পর ১৯৭৮ সালে বিচ্ছেদ।
এরপর কিশোর কুমার ১৯৮০ সালে বলিউড অভিনেত্রী লীনা চন্দ্রভারকারকে বিয়ে করেন। তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল ২১ বছর। লীনার বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না। লীনার বাবার সম্মতি পেতে কিশোর কুমার গেয়েছিলেন বিজয় আনন্দ পরিচালিত দেব আনন্দের ‘জনি মেরা নাম’ ছবির গান ‘নফরত করনে ওয়ালো কে সিনে মে পেয়ার ভর দু’ গানটি। ১৯৮৭ সালে কিশোর কুমারের মৃত্যুর আগপর্যন্ত লীনা চন্দ্রভারকারই ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী। লীনার ঘরে কিশোর কুমারের আরেকটি ছেলের জন্ম হয়।
যদি থাকতেন কিশোর কুমার
বারবার তাঁর জীবনে বিরহ এসেছে, বিচ্ছেদ এসেছে। এক বুক বেদনা নিয়ে কিশোর কুমার জীবনটাকে দারুণ উপভোগ করে গেছেন। কিশোর কুমার কোনো কনসার্টে গান করার আগে মঞ্চের মাপ জেনে নিতেন।
বলতেন, ‘আমার বড় স্টেজ চাই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি গাইতে পারব না। আমি নেচে-কুঁদে গাইব।’ আর মঞ্চে তিনি এমন সব কাণ্ডকারখানা করতেন যে বাদ্যকরেরাও বাজনা থামিয়ে হাঁ হয়ে দেখতেন।
সরাসরি কিশোর কুমারের গান শুনেছেন—এমনই একজনের সঙ্গে কথা হয়। কলকাতার থাকেন। পেশায় চিত্রশিল্পী। সন্দীপ দাস। তখন তিনি আর্ট কলেজের ছাত্র। প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করেন তিনি। জানালেন, ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। কিশোরের সঙ্গে বাপ্পি লাহিড়ী। সেদিনের কনসার্টে কিশোর কুমারকে দেখার স্মৃতি ভোলার নয়। সারাক্ষণই দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। সেকি পরিবেশনা! সেদিন অনুষ্ঠান শেষে বলেছিলেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, আবার আসব। আপনাদের গান শোনাব।’ কিশোর কুমারের কলকাতায় আসা আর হয়নি। সেটাই ছিল কিশোর কুমারের শেষ কলকাতা ভ্রমণ।
বেঁচে থাকলে আজ বৃহস্পতিবার পা দিতেন ৯৪ বছরে। তিনি নেই। এখন চাইলেই মুঠোফোনেই ইউটিউবে কিশোরের গান শোনা যায় যেকোনো মুহূর্তে। কিন্তু সরাসরি কিশোর কুমারকে দেখার আনন্দ মিলবে না কখনো। আজ শত শত কোটি টাকার ছবি করা শাহরুখ, সালমান, আমির, অক্ষয়দের আফসোস থেকে যাবে, তাঁরা কিশোর কুমারের কণ্ঠের নতুন গানে ঠোঁট মেলাতে পারেননি। শতাব্দীতে কিশোর কুমার একজনই আসেন। শুভ জন্মদিন কিশোর কুমার। ভাগ্যিস, আপনি সময় করে এসেছিলেন!