মা–বাবা আর তিন কন্যার ব্যান্ড

স্ত্রী আর তিন কন্যাকে নিয়ে ব্যান্ড গড়েছেন সাইফ শরীফ। নাম ‘এসেইস’। গত শুক্রবার এসেছে ব্যান্ডটির নতুন গান ‘অদ্ভুতুড়ে সুখ’। পারিবারিক ব্যান্ডটি সম্পর্কে আরও জানতে তাঁদের ডেরায় হাজির হয়েছিলেন নাজমুল হক

বাঁ থেকে এসেইস ব্যান্ডের পাঁচ সদস্য সাইফ, সারওয়া, ঈদ, আলিনা, ইশরা। ছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

ছিলেন বইপোকা। ক্লাস নাইনে ওঠার পর গানেও আগ্রহ তৈরি হয়। বিদেশ থেকে বাবার এনে দেওয়া কি-বোর্ড সে আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। আর বুয়েটে পড়ার সময় তো পাশ্চাত্য সংগীতেই বুঁদ হয়ে থাকতেন সাইফ শরীফ। বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য একে একে সবাই যখন বিদেশে উড়াল দিল, ব্যান্ড কী আর তখন টেকে। নিজে যখন বিদেশ পড়তে গেলেন সাইফ, তখনো ব্যান্ডের পোকা ছেড়ে যায়নি। রাজধানীর খিলক্ষেতে স্টুডিওতে বসে সংগীতজীবনের শুরুর দিকের গল্প বলছিলেন সাইফ।

ব্যান্ডের চার সদস্য। ছবি: সুমন ইউসুফ

গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া
২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান সাইফ। এর আগেই রাকিয়া ইশরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। সিডনিতে দুজনের সংসার। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশি মিউজিশিয়ানের সঙ্গে গান করেন সাইফ। দেশ থেকে যাঁরা পারফর্ম করতে যেতেন, তাঁদের সঙ্গেও বাজাতেন। সাইফ দেখলেন, সিডনিতে ভালো তবলাবাদক নেই। ভারতীয় কয়েকজন আছেন, তাঁদের নিতে অনেক খরচ। ইশরাকে অক্টাপ্যাড কিনে দিলেন। দেখিয়ে দেন কীভাবে বাজাতে হয় তবলা, ঢোল, ড্রামস। ওস্তাদও রাখা হয়। সাইফ দেখলেন, বাহ! ভালোই তো বাজায়। তাহলে তো ইশরাকে দিয়েই হবে। সিডনির বিভিন্ন কমিউনিটির প্রোগ্রামে গান করতে লাগলেন সাইফ-ইশরা। স্বামী-স্ত্রীর এই ব্যান্ডের নাম দিলেন দেহঘড়ি সিডনি। এর মধ্যে তাঁদের কোল আলো করে এল মেয়ে ঈদ। ওকে নিয়েই অনুষ্ঠানে যেতেন সাইফ-ইশরা। এভাবে তার মধ্যেও গান ঢুকে যায়। এরপর জন্ম নেয় আরও দুই কন্যা সারওয়া ও আলিনা। আলিনাকে পেটে নিয়েও নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন ইশরা। সাইফের কথায়, ‘মায়ের পেট থেকেই গান শিখে এসেছে আলিনা।’

‘আমরাই পারব’
২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটা নামী হোটেলে পারফর্ম করার সুযোগ পায় সাইফ-ইশরাদের দল। তার মধ্যে আগের রাতে গিটারিস্ট জানালেন, শোতে থাকতে পারবেন না। সাইফের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। চাইলেই তো আর হুট করে গিটারিস্ট পাওয়া যায় না। এরপর কী হয়েছিল সাইফের কাছ থেকেই শোনা যাক, ‘বড় মেয়েকে বললাম, আমি দুই কি–বোর্ডে ব্যাকআপ দেব, তুমি শুধু গিটারে রিদম দিবা।

এসেইসের আরেক সদস্য রাকিয়া ইশরা। ছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

আর ড্রামসে তো ইশরা আছেই। ১০ বছর বয়সী ঈদ যখন গিটার নিয়ে মঞ্চে উঠে ঠিকঠাক বাজাল, শো তখন হিট। এখান থেকেই যেন একটা স্ফুলিঙ্গ পেলাম। আত্মবিশ্বাসী হলাম, আমরাই পারব। মিউজিশিয়ানদের চলে যাওয়া জীবনে তো কম দেখিনি, তাই তখন মনে হলো, পরিবার নিয়েই ব্যান্ড করব। আর বাইরের মানুষ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।’

‘এসেইস’ শুরু
করোনাকালের ঠিক শুরুর দিকে মা-বাবা ও ঈদের সঙ্গে পারিবারিক গানের দলে যোগ দেয় মেজ মেয়ে সারওয়া।

তিন কন্যা। ছবি: সুমন ইউসুফ

সাইফ-ইশরা খেয়াল করলেন, তাঁদের সন্তানেরা একটু আলাদা। সাইফের কথায়, ‘একদিন দেখলাম সারওয়া “আবার এল যে সন্ধ্যা”র সলো বাজাচ্ছে। ওর বয়স তখন ৮। ভিডিওটা ফেসবুকে দিলাম। সেটা দেখল ইশরার বান্ধবী (অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ) মিথিলা। ও শেয়ার করল। তারকারা যখন কিছু শেয়ার করেন, তখন এর প্রতিক্রিয়াও তো অনেক বড় হয়। ভিডিওটি ছড়ানোর পর অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম, টেলিভিশনে তা প্রচার হলো। শোয়ের নিমন্ত্রণ পেতে থাকলাম।’

আরও পড়ুন

সে সময়ই ছোট্ট আলিনার হারমোনাইজের প্রতিভাও আবিষ্কার করেন সাইফ। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় ব্যান্ডের নামও ঠিক করে ফেলল সবাই মিলে। পাঁচজনের নামের আদ্যক্ষর সাজিয়ে ব্যান্ডের নাম দেওয়া হয় ‘এসেইস’। ছোট মেয়ে আলিনা ভোকাল হারমোনাইজার, মেজ সারওয়া লিড গিটারিস্ট, বড় ঈদ বেজ গিটার ও ভোকাল, স্ত্রী ইশরা ড্রামস। সাইফ নিজে কি-বোর্ড বাজান, কণ্ঠ দেন, সংগীত পরিচালনাও করেন।

‘ছিল সবই এখানে’
২০২১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসে সাইফদের পুরো পরিবার। অস্ট্রেলিয়ায় সব ফেলে এলেও প্রায় ২০০ কেজি মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট আনতে ভোলেনি ‘এসেইস’। সাইফ-ইশরাকে বিদেশ টানে না। বাচ্চারাও পরিবারের সঙ্গে দেশেই থাকতে চায়। অন্তর্জালের কল্যাণে আগে থেকেই তাদের পরিচিতি ছিল, দেশের আসার পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক আসতে লাগল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যান্ডটি নিয়ে এসেছে প্রথম অ্যালবাম ‘ছিল সবই এখানে’। অ্যালবামের সাতটি গানই ব্যান্ডের নিজস্ব স্টুডিওতে রেকর্ডিং, মিক্সিং ও মাস্টারিং করা হয়েছে। ছয়টি গানের কথা লিখেছেন ইশরা, সুর করেছেন সাইফ। একটি গানের কথা লিখেছেন তাহরিম হাসান, সুর দিয়েছে সারওয়া।

তিন কন্যা। ছবি: সুমন ইউসুফ

পরিবারের সবাই গান করেন, এটা নিয়ে অনেকের কথা শুনতে হয়। তবে এখন আরা এসব নিয়ে গা করেন না সাইফ-ইশরা। গান করে যেতে চান নিজেদের মতো করে।