‘আপনি পূর্ণিমাতে ভাইস্যা গেছে বলে যে টান দিয়েছেন, তাতেই মন ভরে গেছে’
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁকে স্মরণ করে প্রথম আলোতে লিখেছিলেন বরেণ্য সুরকার আলম খান। তিনিও বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাঁদের স্মরণ করে লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।
সৈয়দ শামসুল হকের (হক ভাই) সঙ্গে আমার প্রথম কাজ করার সুযোগ হয় ’৭৪-৭৫ সালের দিকে। ওই সময় তিনি নিজেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। নাম ‘ভুলি নাই’। ওই ছবির আবহ সংগীত আমার করা। ছবিতে একটি গানও ছিল। তিনিই লিখেছিলেন। গানটির কথা ছিল ‘ভুলি নাই তোমাদের মতো শতসহস্র ভুলি নাই’। তিনি আমার সংগীতায়োজন খুব পছন্দ করেছিলেন। এই প্রামাণ্যচিত্রটিতে কাজ করার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে নিয়মিত কাজ করার সুযোগ হয়।
এরপর তাঁর সঙ্গে কাজ করি ১৯৭৬ সালে। ছবির নাম ‘বড় ভালো লোক ছিল’। এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীত রচনা করেছিলেন হক ভাই। মনে পড়ে, তিনি তখন থাকতেন মণিপুরিপাড়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে। আর আমি থাকতাম কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে। নতুন বিয়ে করেছি। বাড়িতে টেলিফোন ছিল না ওই সময়। তাই আমাকে কারও প্রয়োজন পড়লে জসীমউদ্দীন রোডের চিটাগং হোটেলে ফোন করে খবর দেওয়া হতো। একদিন হোটেলের বয় এসে জানাল, আপনার জরুরি ফোন এসেছে। আমি হেঁটে গিয়ে হোটেলের ফোন ধরলাম। ওই প্রান্তে হক ভাই। বললেন, ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গানটির মুখটুকু লিখেছি। তুমি জলদি বাসায় আসো। বলে নেওয়া ভালো, হক ভাইয়ের লেখা সব গানই আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে সুর করেছি।
তো গোপীকে (আমার তবলা সহযোগী) নিয়ে তাঁর বাড়ি গেলাম। তিনি ছোট্ট একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। লেখা ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস, তবু তো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুঁশ’। এরপর বললেন, ‘ছবির স্ক্রিপ্ট লিখছি। আপনি মুখটা সুর করতে থাকেন। স্ক্রিপ্ট শেষ হলে বসে গানটা শেষ করব।’ আমি কাগজটা মানিব্যাগে রেখে দিলাম। সময় পেলে মাঝেমধ্যে সুর করতাম। প্রায় ১৫টা সুর করেছিলাম। পরে এখন যে সুরটা, এটাই মনে ধরল। তিন মাস পর হক ভাই এক সকালে তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। মুখের সুর শোনার পর তিনি অন্তরা লিখে দিলেন। কিন্তু তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও মনমতো অন্তরার সুর করতে পারলাম না। মন খারাপ করে আমার সহকারী গোপীসহ বাড়ি ফিরলাম। বাসায় ফিরে গোসল করতে তোয়ালে কাঁধে যখনই বাথরুমে ঢুকব, তখনই সুরটা মাথায় এল। দ্রুত বেরিয়ে সুরটা রেকর্ড করলাম। পরদিন গিয়ে শোনালাম।
হক ভাই শুনেই বললেন, ‘আপনি পূর্ণিমাতে ভাইস্যা গেছে বলে যে টান দিয়েছেন, তাতেই মন ভরে গেছে।’ এরপর আমরা গানটির রেকর্ডিংয়ে যাই। গানটি শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে রেকর্ড করি। ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানটি গেয়েছিল এন্ড্রু কিশোর। এই ছবির সব গানই খুব জনপ্রিয় হয়।
এর মধ্যে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘তোরা দেখ দেখ রে চাহিয়া’, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙিলা’, রুনা লায়লার গাওয়া ‘পাগল পাগল মানুষগুলা পাগল সারা দুনিয়া’ আর রুনা লায়লা ও বিপুল ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘চাম্বেলিরও তেল দিয়া কেশ বান্ধিয়া’।
এরপর তাঁর সঙ্গে আরও দুটি ছবির দুটি গান করি। একটি ‘মানসম্মান’ ছবির ‘কারে বলে ভালোবাসা কারে বলে প্রেম, মিলনও বিরহে আমি জানলেম’। এটিও এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া। আর একটি গানের কথা না বললেই নয়। সেই গানটি হলো ‘আশীর্বাদ’ ছবির ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’। কারণ, এটি ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কাজ। এই গানটি তাঁর গুলশানের বাড়িতে বসে সুর করা। তিনি সাধারণত আগেই গান লিখে রাখতেন। আমরা তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আলম, সবাই গানের যত উপমা ব্যবহার করেন, সেই সব চাঁদ, ফুল, নদী, পাখি দিয়েই গানটি লিখেছি। দেখো।’ এরপর গানটি তখনই সুর করি। এই গানটির পর হক ভাই আর কোনো গান লেখেননি।
তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে আফসোস হচ্ছে। কারণ, দুদিন আগেই এন্ড্রু কিশোর ফোন করে আমাকে জানাল, হক ভাই নাকি চারটি গান লিখেছেন এবং কিশোরকে বলেছেন, ‘গানগুলো আলম সুর করবে, আর তুমি গাইবে।’ আমিও অসুস্থ। তিন দিন ধরে হাসপাতালে আছি। ভেবেছিলাম, সুস্থ হয়ে গানগুলো এনে সুর করব এবং হক ভাইকে শোনাব। তাঁকে গান শোনানো আর হলো না।
অনুলিখন: কবির বকুল