ভুল ধারণা নিয়ে মানুষ অনেক কথাবার্তা বলছেন: অনিমেষ রায়
কোক স্টুডিও বাংলার নতুন গান ‘নাহুবো’ প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। গানটি নিয়ে বিনোদন–এর সঙ্গে কথা বলেছেন গীতিকার ও শিল্পী অনিমেষ রায়।
প্রশ্ন :
‘নাহুবো’ প্রকাশের পর কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
বেশ ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, গানটা করাটাই চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। সাধারণত কোনো গান বোধগম্য হলে তা ধারণ করা সহজ হয়। শুধু মিউজিক দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌঁছানো দুরূহ। সে জন্যই এখন গানের সঙ্গে ভিডিও থাকে, যাতে দর্শক–শ্রোতা গানটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। হাজং গান শ্রোতাদের কাছে দ্রুত বোধগম্য হবে, সে রকম কিন্তু নয়। একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল, চ্যালেঞ্জটা নিয়েই গানটা করতে নেমেছি।
প্রশ্ন :
কোন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চ্যালেঞ্জটা নিলেন?
চ্যালেঞ্জ নেওয়ার একটাই কারণ, হাজং গান। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কয়টা হাজং গান আছে? হাজং জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কয়জন জানেন? ‘নাসেক নাসেক’ প্রকাশের পর অনেকেই ইতিবাচকভাবে বলেছেন, ‘নাসেক নাসেক’ না বের হলে তাঁরা জানতেনই না যে বাংলাদেশের হাজং সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। হাজংয়ের মতো ক্ষুদ্র একটি জাতিগোষ্ঠীকে আমরা বড় জায়গায় তুলে ধরতে পারছি, এটা আমাদের সবার অর্জন।
প্রশ্ন :
গানটা নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন!
গুটিকয়েক মানুষের প্রতি আক্ষেপ থেকে পোস্টটা লিখেছি। একটা জাতিগোষ্ঠীকে চেনার প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হলো তার ভাষা। কোনো জাতিগোষ্ঠীকে জানতে হলে তার ভাষা জানতে হবে। কোনো জাতিগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে হলে তার ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সেই ফেসবুক পোস্টে নিজেকে ‘বাঙালি’ লেখার পর এখন অনেকেই বলছেন, তাহলে অনিমেষ রায় আদিবাসী নন?
প্রশ্ন :
বিষয়টা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা চলছে...
হাজং বংশোদ্ভূত মানুষ হওয়ায় জন্মের পর আমাকে ভাষাটা শিখতে হয়েছে। কিছুটা বড় হওয়ার পর যখন জানতে পারলাম, আমার রাষ্ট্রভাষা বাংলা; তখন বাংলা ভাষাও শিখতে হয়েছে। আমি সব ভাষার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। প্রতিটা ভাষাকে সম্মান করা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। আপনি বলতে পারেন, গানটা বুঝতে কষ্ট হয়েছে কিংবা গানটা ভালো লাগেনি। এখন অনেকে বলবেন, ‘আমরা তো ভাষা নিয়ে কথা বলিনি।’ কিন্তু গুটিকয়েক মানুষ ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন; ‘নাসেক নাসেক’ প্রকাশের পর আমি মানুষের যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি। তখনো দুয়েকজন হাজং ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন। তখন শুধুই দেখেছি, পুষে রেখেছি আর ভেবেছি, ঠিক আছে।
তাঁদের কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, ভাষার কারণেই এই গানের এই অবস্থা। ভাষাটা এত গুরুত্বহীন হয়ে গেল? সেই সব গুটিকয়েক মানুষের প্রতি আক্ষেপ থেকেই পোস্টটা করেছি। ভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলতে চেয়েছি। তাই বলে আমি বলছি না, আমি বাঙালি। আমরা নিজেদের আদিবাসী বলি। আদিবাসীর অধিকার নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। বাঙালি বললেই কি বাঙালি বানাতে পারবেন? পারবেন না। আমার মুখে আছে মাতৃভাষা। আমার খাবার, কৃষ্টি–সংস্কৃতি, বিশ্বাস আপনি নিতে পারবেন না। সেটা আমার কাছেই আছে।
আমি সেসব হাজং মানুষকে নিয়েই কাজ করছি। হাজং ভাষার প্রচার–প্রসারে কাজ করছি। আমার ফেসবুক পোস্টো হয়তো মানুষজন বুঝতে পারেননি। আমি ভেবেছিলাম, আমি কেন বলেছি, আমি বাঙালি, সেটা বুঝতে পারবেন। কিন্তু উল্টা অনেকেই এটার ভুল ব্যাখা দিচ্ছেন। আমার মনে হয়, এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমি আদিবাসীদের নিয়েই কাজ করছি, একজন আদিবাসী হয়ে নিজেকে বাঙালি প্রমাণ করতে বসেছি, ব্যাপারটা এমন নয়।
হাজং ভাষার প্রচার–প্রসারে কাজ করছি। আমার ফেসবুক পোস্টো হয়তো মানুষজন বুঝতে পারেননি। আমি ভেবেছিলাম, আমি কেন বলেছি, আমি বাঙালি, সেটা বুঝতে পারবেন। কিন্তু উল্টা অনেকেই এটার ভুল ব্যাখা দিচ্ছেন।
প্রশ্ন :
গানটা অনেকে পছন্দও করেছেন...
তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁদের জন্যই দ্বিতীয় গানটা করার সাহস পেয়েছি। এতকিছুর পরও মানুষ গানটা নিচ্ছেন। গুটিকয়েক মানুষ ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু সবাই গানটার জন্য উৎসাহিত করেছেন।
প্রশ্ন :
ফেসবুক থেকে পোস্টটা সরিয়ে ফেলেছেন কেন?
ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে মানুষজন অনেক কথাবার্তা বলছেন। ভেবেছিলাম, বিষয়টা মানুষ হালকভাবে বুঝবেন; ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্ত হয়নি, সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গানটা গেয়ে কোথায় একটু আরাম করে শুনব, সে সুযোগটুকু পাইনি। এটা অনেক বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে, আমি চাই বিষয়টাকে সবাই সাধারণভাবে গ্রহণ করুক।
প্রশ্ন :
‘নাহুবো’র নেপথ্যের কথা জানতে চাই।
মানুষের আত্মমর্যাদাবোধকে জাগিয়ে তোলা, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার গান এটি। গানে বলা হচ্ছে, অন্য কারও ভালো লাগার জন্য নিজস্বতা হারিয়ে প্রতিনিয়ত অভিনয়ের দরকার নেই। একসময় মানুষ আর অভিনয় করতে পারে না, মানুষের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই, এই মর্মই তুলে ধরা হয়েছে এই গানে।
প্রশ্ন :
‘নাসেক নাসেক’ মুক্তির পর রাতারাতি পরিচিতি পেলেন, এরপরের জীবনটা কেমন?
আমাকে অনেকেই ‘নাসেক নাসেক’ বলে ডাকতেন। ‘নাসেক নাসেক’ হাজং ভাষার শব্দ, অন্য ভাষার কোনো মানুষ ‘নাসেক নাসেক’ বললে ভালো লাগত। ছোটবেলায় অনেকেই বলতেন, ‘তোমার ভাষা তো বুঝি না।’ আমরা এটা সহ্য করেই বেড়ে উঠেছি; এখন কেউ ‘নাসেক নাসেক’ বলে ডাকলে খুব ভালো লাগে। হাজং ভাষাকে সম্মান দিয়ে মানুষ আমাকে এই নামে ডাকে। আমি খুবই সাধারণভাবে বাঁচতে চাই। গানটি প্রকাশের পর দেশে ও বিদেশে বহু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।
প্রশ্ন :
গানের জগতে এলেন কীভাবে?
আমার দাদু হাজং ভাষার গান করতেন, আমার মা হাজং ভাষার গান করেছেন। জন্মের পর আমি হাজং গান শিখেছি, পরে বাংলা গান শিখেছি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে স্নাতকোত্তর করেছি। করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে ফেসবুকে গানের ভিডিও পোস্ট করতাম। অনেকের ভালোবাসা পাচ্ছিলাম, সেসব গান শুনেই অর্ণবদা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কোক স্টুডিওর সঙ্গে যুক্ত হলাম।