চলে গেলেন হ্যারি বেলাফন্টে
গানকে হাতিয়ার করে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তিনি। শরিক হয়েছিলেন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সাদা-কালোর বিভেদ যখন চরমে, তখনই বেজে উঠেছিল তাঁর ‘ক্যালিপসো’র সুর। ফল, তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিল্পীর চেয়ে বেশি কিছু। সেই গায়ক, গণসংগীতশিল্পী হ্যারি বেলাফন্টে মারা গেছেন। এএফপিকে বেলাফন্টের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন তাঁর মুখপাত্র। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৯৬ বছর বয়সী বেলাফন্টে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ক্যালিপসোর জাদু
১৯২৭ সালে নিউইয়র্কে জন্ম হ্যারি বেলাফন্টের। ক্যারিবিয়ান অভিবাসী ছেলে বেলাফন্টের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। হাইস্কুল শেষ করতে পারেননি তিনি, ঝরে পড়েন মাঝপথেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোগ দেন নৌবাহিনীতে। যুদ্ধ শেষ হলে অভিনয়ের নেশা পেয়ে বসে। অভিনয় নিয়ে কর্মশালাও করেন, সে কর্মশালায় ছিলেন মার্লোন ব্র্যান্ডো, ওলটার ম্যাথু আর টনি কার্টিসও। নিউইয়র্কের ক্লাবে টুকটাক গান করতেন, আয়রোজগারও হতো মন্দ নয়। এই গানই তাঁকে রেকর্ডিং কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছে দিল, গান নিয়ে, বিশেষ করে লোকসংগীত নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন বেলাফন্টে। জানলেন ক্যালিপসো সংগীত সম্পর্কে যে সুরকে সঙ্গী করে বড় হয়েছিলেন তাঁর মা-বাবা। ক্যালিপসো হলো ত্রিনিদান অ্যান্ড টোবাগো থেকে সৃষ্ট সংগীতের ধারা যা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সমগ্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
এই ক্যালিপসোর সুরই বেলাফন্টেকে তারকা বানিয়ে দিল। ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ ও ‘ডে-ও’-এর মতো গানগুলো দিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন, দুটি গানই বেলাফন্টের তৃতীয় অ্যালবাম ‘ক্যালিপসো’ জায়গা পেয়েছিল।
১৯৫৬ সালে প্রকাশিত অ্যালবামটি বিলবোর্ড চার্টের শীর্ষে ছিল। এটিই কোনো একক শিল্পীর প্রথম অ্যালবাম, যা যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়। হ্যারি বেলাফন্টের ঐতিহাসিক সৃষ্টির মধ্যে আছে ‘শেক শেক সেনোরা’, ‘ম্যাটিল্ডা’, ‘লিড ম্যান হোলার’,‘জাম্প ইন দ্য লাইন’-এর মতো অনেক গান।
অভিনেতা বেলাফন্টে
১৯৫৩ সালে অভিনেতা হিসেবে বেলাফন্টে ব্রডওয়েতে আত্মপ্রকাশ করেন, যে জন্য তিনি পার্শ্ব-অভিনেতা হিসেবে টনি পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি প্রথম আফ্রো-আমেরিকান শিল্পী, যিনি টনি অ্যাওয়ার্ড জেতেন। হলিউডেও ডাক আসে, আইল্যান্ড ইন দ্য সান-এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিতে তাঁর সঙ্গে শেতাঙ্গ অভিনেত্রী জোন ফন্টেইনের প্রেম দেখানো হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ছবিতেই প্রথমবার শেতাঙ্গ ও অশেতাঙ্গ পাত্র–পাত্রীর মধ্যে চুমুর দৃশ্য দেখানো হয়। এমনকি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার আইনসভায় একটি বিলও উত্থাপন করা হয় যে ছবিটি দেখালে প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা হবে!
পর্দায় স্রেফ পারফর্ম করা নয়, অভিনেতা হিসেবে বেলাফন্টের ভূমিকা ছিল আরও বেশি। সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের চাকর বা শ্রমিকের চরিত্রের বাইরে ভাবা হতো না। তবে বেলাফন্টে গতানুগতিক এসব চরিত্র করতে অস্বীকার করেন।
বেলাফন্টেকে নিয়ে লিখতে গেলে পেটুলা ক্লার্কের সঙ্গে তাঁর সেই ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনার কথাও বলতে হবে। ১৯৬৮ সালে এনবিসি টিভি পেটুলা ক্লার্ককে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান সঞ্চালনার আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে হ্যারি বেলাফন্টের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী গান ‘অন দ্য পাথ অব গ্লোরি’তে পারফর্ম করার সময় বেলাফন্টের বাহু স্পর্শ করেন ক্লার্ক। ঘটনা সামান্যই, কিন্তু সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণাঙ্গ বেলাফন্টেকে শেতাঙ্গ ক্লার্কের স্পর্শ ছিল বিশেষ কিছু। এই দৃশ্য প্রচারিত হওয়ার পর দর্শকের একাংশ ক্ষুব্ধ হতে পারে, এমন শঙ্কায় দৃশ্যটি বাদ দিতে বলেন অনুষ্ঠানের স্পনসর। ক্লর্ক অবশ্য রাজি হননি। মার্টিন লুথার কিং নিহত হওয়ার চার দিন পর সম্প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি। ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এই অনুষ্ঠান, পায় এমি মনোনয়নও। এটিই যুক্তরাষ্ট্রের টিভিতে শেতাঙ্গ ও অশেতাঙ্গ পাত্র–পাত্রীদের মধ্য প্রথম স্পর্শের ঘটনা।
১৯৮০-এর দশকেও বেলাফন্টে চলচ্চিত্র নির্মাণ চালিয়ে যান, সর্বশেষ তাঁকে পর্দায় দেখা যায় স্পাইক লির ‘ব্ল্যাককেক্ল্যান্সম্যান’-এ।
বর্ণিল এক জীবন
দীর্ঘ সংগীতজীবনে ৩০টির বেশি অ্যালবাম রেকর্ড করেছেন বেলাফন্টে। ১৯৬২ সালে বেলাফন্টের অ্যালবাম ‘মিডনাইট স্পেশাল’-এ হারমনিকা বাজিয়েছিলেন বব ডিলান, যা ছিল তাঁর প্রথম রেকর্ডে তাঁর প্রথম উপস্থিতি।
মার্টিন লুথার কিংয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে, ছিলেন শিল্পী নাগরিক অধিকার আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য সমর্থক।
১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন মার্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন হ্যারি বেলাফন্টে। ১৯৬৫ সালে সেলমা থেকে মন্টগোমারি পদযাত্রায় তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।
যখন মার্টিন লুথার কিংকে বার্মিংহাম জেলে নেওয়া হয়, বেলাফন্টে তাঁর জামিনের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলারের তহবিল জোগাড় করেছিলেন, যা এখনকার হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ ডলার।
বেলাফন্টে ছিলেন সেই সময়ের শিল্পী, যখন পপ গায়কদের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তবে খ্যাতি, যশ আর অর্থবিত্তের সেই জীবনের বদলে অধিকার আদায়ের জীবনই বেছে নেন বেলাফন্টে।
হ্যারি বেলাফন্টে সম্পর্কে একবার মার্টিন লুথার কিং নিজের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিলেন এভাবে, ‘বেলাফন্টের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি; স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী সংগ্রামের মূল উপাদান—নাগরিক অধিকার আন্দোলনে একটি শক্তিশালী কৌশলগত অস্ত্র।’ বেলাফন্টে সম্পর্কে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা তাঁর সাহস ও সততার জন্য ধন্য।’
হ্যারি বেলাফন্টে আফ্রিকায় দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও এইডসের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালান।
নিজের জীবন নিয়ে ২০০৪ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় হ্যারি বেলাফন্টে বলেছিলেন, ‘মানুষ মনে করে, যাঁরা আন্দোলনে জড়ান, না জানি তাঁরা কত ত্যাগ স্বীকার করেন। তবে আমি সব সময়ই এটাকে সৌভাগ্য ও বড় সুযোগ হিসেবে দেখেছি।’
কণ্ঠ থামেনি তাঁর
হ্যারি বেলাফন্টে ছিলেন বামপন্থী। পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। ২০০৬ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশকে নিয়ে তাঁর সেই তুমুল আলোচিত মন্তব্যের কথা কে ভুলতে পারে। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, বেলাফন্টে বুশের দুই কৃষ্ণাঙ্গ মন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও কন্ডোলিৎসা রাইসকে কৃতদাসের সঙ্গে তুলনা করেন, যাঁরা মাঠের বদলে তাঁদের মালিকের বাড়িতে কাজ করতেন।
এমন মন্তব্যের জন্য হ্যারি বেলাফন্টে প্রায়ই তির্যক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন, কিন্তু তাতে তাঁর খ্যাতি আটকানো যায়নি। একের পর এক সম্মাননায় ভূষিত হতে থাকেন তিনি।
বেলাফন্টেকে ১৯৮৯ সালে কেনেডি সেন্টার অনার, ১৯৯৪ সালে ন্যাশনাল মেডেল অব আর্টসে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন সেই বিরল তারকাদের একজন, যাঁরা বিনোদনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারের চারটিই পেয়েছেন—এমি, গ্র্যামি, অস্কার ও টনি।
হ্যারি বেলাফন্টে তিনবার বিয়ে করেছিলেন। অভিনেত্রী-মডেল শারি, নৃত্যশিল্পী জুলিয়া রবিনসনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ২০০৮ সালে পামেলা ফ্রাঙ্ককে বিয়ে করেন তিনি।
বেলাফন্টের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য
হ্যারি বেলাফন্টের মৃত্যুর পর অপরাহ্ উইনফ্রে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান এভাবে, ‘আপনার সংগীত, শিল্পীসত্তা, প্রতিবাদ আর নাগরিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামের জন্য ধন্যবাদ।’
হ্যারি বেলাফন্টের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের কবি ও গীতিকার শ্রীজাত ফেসবুকে লিখেছেন, ‘খুব কম মানুষই পারে, একজীবনে প্রবাদ বা রূপকথা হয়ে উঠতে। খুব কম মানুষই পারে, হাত থেকে হাতে ইশতেহার বা নিশানের মতো ঘুরতে। খুব কম মানুষই পারে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জাগিয়ে রাখতে। আপনি সেই বিরলদের একজন। বিদায় হ্যারি, অবশেষে ফেয়ারওয়েল। এই পৃথিবী আপনাকে আর আপনার গানকে ভুলবে না।’
তথ্যসূত্র: এএফপি, বিবিসি