গানে গানে ছুটির দিন

রাজধানীর সংগীতপ্রেমীদের জন্য গতকাল দিনটি ছিল বিশেষ; এদিন ঢাকায় হয়েছে তিনটি বড় কনসার্ট। এতে অংশ নেয় দেশের বেশ কিছু ব্যান্ড ও সংগীতশিল্পী। এর মধ্যে দুটি কনসার্ট আয়োজন করা হয় বন্যাদুর্গতদের তহবিল সংগ্রহে, অন্যটি হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সহায়তায়। এসব আয়োজনে কোনো পারিশ্রমিক নেননি সংগীতশিল্পীরা। এর বাইরে ছিল সংগীতশিল্পী মিফতা জামানের একক পরিবেশনাও। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে কনসার্টগুলোতে এসেছিলেন সংগীতপ্রেমীরা। কনসার্ট ঘুরে এসে লিখেছেন নাজমুল হক

ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মুক্তমঞ্চে যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করছে শিউলি ভট্টাচার্যের বেহালার দল সর্বজয়া। ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

বন্যা–পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় তহবিল সংগ্রহে কনসার্টের আয়োজন করে বাংলার গান পরিষদ ও স্টুডিও সুরুং সাংস্কৃতিক সংগঠন। ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মুক্তমঞ্চে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এই কনসার্ট। দুপুরে শুরুর কথা থাকলেও, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা ছয়টায়। ছুটির দিনে, সঙ্গে কনসার্ট; রবীন্দ্রসরোবর হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য। শুধু গান শুনতে নয়, বানভাসি মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহে সহযোগিতা করতেও এসেছেন অনেকে। এই যেমন এসেছিলেন ৪০ বছর বয়সী আমিনুল হক। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে এসেছেন জলের গান শুনতে। কথায় কথায় জানালেন, এদিন শুধু গান শুনতে আসেননি। গ্রামের বাড়ি ফেনীর বন্যার্তদের পাশে থাকতেই এ কনসার্টে আসা।

গাইছেন আরিফ বাউল। ছবি: জাহিদুল করিম

মূল আয়োজন শুরু হয় আরিফ বাউলের গান দিয়ে। প্রথমেই তিনি গেয়ে শোনান ‘বানের পানি শুনে না বারণ’। তাঁর গানের প্রতিটি কথায় যেন উঠে এসেছিল বন্যাদুর্গতদের নিদারুণ কষ্টের চিত্র। এরপরই মঞ্চে ওঠে শিউলি ভট্টাচার্যের বেহালার দল ‘সর্বজয়া বেহালার দল’। রবীন্দ্রসংগীতের অর্কেস্ট্রা ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ বিমোহিত করে চারদিক। এরপর একে একে পারফর্ম করে ব্যান্ড দ্যুলোক ও সমঞ্চ গান। ‘নামের গোসাঁই’ গান দিয়ে পারফরম্যান্স শুরু করে ব্যান্ড সর্বনাম। একে একে গায় তাদের জনপ্রিয় ‘চোখের জলে’, ‘এক খেও সুতা কাটিবো’।

কনসার্টে অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যান্ডটির সদস্য হাসনাত রিপন বলেন, ‘আমরা গানে আছি প্রাণে আছি, মানুষের সঙ্গে আছি। আমাদের সামর্থ্য গান। গান দিয়েই পাশে দাঁড়াতে চাই। টিকিটের টাকায় প্রাপ্ত অর্থ চলে যাবে বানভাসি মানুষের কাছে। শহীদ মিনারে শো করেছি, চারুকলায় শো করেছি। আজ করছি রবীন্দ্রসরোবরে। সব কটি শোই বানভাসি মানুষের জন্য। সামনে সুযোগ হলে আরও শো করব আমরা সর্বনাম।’ জলের গানসহ কানসার্টটিতে আরও গান শোনান সংগীতশিল্পী পিন্টু ঘোষ, বাউল শফি মণ্ডল।

এসব আয়োজনে কোনো পারিশ্রমিক নেননি সংগীতশিল্পীরা। ছবি: জাহিদুল করিম

‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও প্রাণীদের জন্য সহায়তায় ‘টিকিট ভাই’ আয়োজন করে কনসার্ট ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’। শুক্রবার বেলা তিনটায় এখানে গিয়ে দেখা গেল আগেই শেষ হয়ে যায় সব টিকিট। ‘ড্যাডস ইন দ্য পার্ক’ ব্যান্ডের মাধ্যমে বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হয় আয়োজন। তাদের গান শুরুর আগেই মিলনায়তনের প্রতিটি আসনে ছিল দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। মূলত তরুণ দর্শকেরাই ছিল এ কনসার্টের প্রাণ। রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত চলা এ কনসার্টে গান শুনিয়েছে ওউনড, ব্ল্যাক জ্যাং, এ কে রাহুল, বে অব বেঙ্গল, মেকানিক্স, অ্যাভয়েড রাফা ও ব্যান্ড ইন্দালো।

আয়োজনটি নিয়ে এ কে রাহুল বলেন, যেকোনো মানবিক কাজে সবার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এমন একটি আয়োজনের পরিকল্পনা শুনে রাফা ভাইয়ের সঙ্গে আমি কথা বলি। নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে কাছের মানুষদের টিকিট কাটতে বলি। আসলে এভাবে যদি আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব।
কনসার্টের আয়োজক টিকিট ভাইয়ের প্রধান নির্বাহী শাইয়ান হুসাইন বলেন, ‘এটি আমাদের নতুন একটি টিকিট প্ল্যাটফর্ম। এমন মানবিক কাজ দিয়েই আমাদের যাত্রাটা শুরু করতে চেয়েছিলাম। এ আয়োজনে কোনো ব্যান্ড পারিশ্রমিক নিচ্ছে না। টিকিটের টাকা বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষক ও তাদের গবাদিপশুর জন্য পাঠাব আমরা। আসলে কৃষকেরা তো আমাদের দেশের মেরুদণ্ড, তাই তাদের পাশে থাকার চেষ্টায় আমাদের এ আয়োজন।’

‘স্বাধীন কণ্ঠস্বর’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সহায়তায় রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন (কেআইবি) মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় কনসার্ট ‘স্বাধীন কণ্ঠস্বর’। কনসার্টটির আয়োজন করে থার্টি সিক্স এন্টারটেইনমেন্ট। বিকেল পৌনে পাঁচটায় ব্যান্ড এন্ডিং ফেইসের পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। এর পর একে একে একে পারফর্ম করে ওমকার, ডোপ-আমিন, সোনার বাংলা সার্কাস, হাইওয়ে, সাবকনশাস, তুলকালাম, আরবোভাইরাস, সংগীতশিল্পী এরশাদ জামান ও ব্যান্ড আভাস।

আরও পড়ুন

আয়োজন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হাসান বলেন, ‘দেখুন এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। বৈষম্যহীন এ দেশের স্বপ্ন যাঁরা দেখিয়েছেন, তাঁদের পাশে আমরা থাকে চাই। এ কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ পৌঁছে যাবে আন্দোলনে আহতের কাছে। আসলে এ অর্থ আমরা দিচ্ছি না। বলা যায়, আমাদের সংগীতশিল্পীরাই এ অর্থের জোগান দিচ্ছেন। কোনো পারিশ্রমিক না নিয়ে তাঁরা আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন, এতে আমাদের উদ্যম আরও বাড়িয়েছে। দর্শকের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল এখানেও। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি রাজধানীর নানা এলাকা থেকে পরিবার–পরিজন নিয়ে আসা দর্শক দেখা গেছে এখানে।’

তেজগাঁওয়ের ইয়ামাহা ফ্ল্যাগশিপ সেন্টারে গতকাল আয়োজন করা হয় সংগীতশিল্পী মিফতাহ জামানের একক কনসার্ট ‘ওয়ান ট্রু সাউন্ড’। আয়োজকদের সৌজন্যে

একা আড়াই ঘণ্টা

বলা যায় অনুরোধের আসর। তেজগাঁওয়ের ইয়ামাহা ফ্ল্যাগশিপ সেন্টারে গতকাল আয়োজন করা হয় সংগীতশিল্পী মিফতাহ জামানের একক কনসার্ট ‘ওয়ান ট্রু সাউন্ড’। কনসার্টটি শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টায়। একটানা আড়াই ঘণ্টা দর্শকের অনুরোধ রাখেন এই সংগীতশিল্পী। জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘চির অধরা’, ‘তাই তোমার খেয়াল’, ‘হয়তো তোমারই জন্য’সহ ১৫টির মতো গান পরিবেশন করেন এই শিল্পী। রাত সাড়ে ৮টায় শেষ হয় এ আয়োজন।