মনি কিশোরের মৃত্যু: গতকাল যা ঘটেছিল রামপুরার পপি ভবনে
রামপুরা বিটিভি ভবনের পাশেই টিভি রোড। ছোট্ট একটি গলি ধরে দুই মিনিট এগোতেই বেশ পুরোনো একটি বাসা ‘পপি ভবন’। বাসার সামনে কেউ নেই। পাশের বাসার দারোয়ান প্রশ্ন করলেন, ‘শিল্পী মনি কিশোরের বাসা খুঁজছেন?’ জানা গেল, পপি ভবনের তিনতলায় থাকতেন একসময়ের জনপ্রিয় শিল্পী মনি কিশোর।
ছোট একটি গেট। সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। তিনতলায় গিয়ে দেখা গেল মনি কিশোর যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেই রুমে তালা দেওয়া। ‘প্রবেশ নিষেধ’ চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা। তালার একপাশে তখনই আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখলেন পাশের রুমের প্রতিবেশী তাজুল মিয়া। এই প্রতিবেদককে দেখে তিনি বললেন, ‘স্যার তো এখানে একা থাকতেন। তাঁর কেউ নেই। আগরবাতি দেবে, দেখতে আসবে, তেমন কেউ ছিল না মনি স্যারের। কোনো দিন কাউকে আসতে দেখিনি।’
তাজুল জানান, ছয় দিন আগেও মনি কিশোরকে দেখেছিলেন। দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় হয়। মাঝেমধ্যে মনিই খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু তিন–চার দিন ধরে বাসার ভেতর থেকে লক করা দেখছেন তাঁরা। এটা কিছুটা কৌতূহলী করেছে তাঁদের। কারণ, মনি কিশোর প্রতিদিন বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হতেন। বাসায় ফিরতেন রাত ১২টার দিকে। কিন্তু এই কয়েক দিন সব সময় রুমে লাইট জ্বালানো দেখে পরবর্তী সময়ে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন কোনো কাজ করছেন। কারণ, বাসায় থাকলে অনেকটা নীরবেই থাকেন। কখনো মৃদুস্বরে কিছুটা গানের শব্দ শোনা যেত। তবে চার থেকে পাঁচ দিন তাঁরা কোনো গান শোনেননি।
গত শুক্রবার তাজুল ও অন্যদের সন্দেহ হয়। সেটাও তেমন আমলে নেননি। তাজুলের স্ত্রী পাশ থেকে বললেন, ‘একা মানুষ থাকতেন, হয়তো ভেতরে কিছু করছেন, এই ভেবে আমি ডাকিনি। তিনি গানের মানুষ, গান আর অফিস নিয়ে থাকতেন। কিন্তু শুক্রবার রাত থেকেই গন্ধ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ গতকাল শনিবার দুপুরের পরে গন্ধ বাড়তে থাকে।’
গতকাল দুপুর থেকেই পপি ভবন ও পাশের লাগোয়া ভবনের বাসিন্দারা গন্ধ নিয়ে সচেতন হন। সন্ধ্যার দিকে বাসার মালিকও বুঝতে চেষ্টা করেন, কোথা থেকে গন্ধ আসছে। কিন্তু কোথা থেকে, সেটা কেউই বুঝতে পারছিলেন না। পরে তাঁর সন্দেহ হয় মনি কিশোরের রুম বন্ধ। পাশের প্রতিবেশী ও মনি কিশোরের রুমের জানালার পাশে ভাড়াটেরাও একই কথা বলেন।
বাসার মালিক শামসুদ্দোহা তালুকদার নিচতলায় থাকেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক পরিচালক। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মনি কিশোরের মুঠোফোন নম্বরে কল করেন। এক দিন আগেও তিনি ফোন করেছিলেন বকেয়া ভাড়ার জন্য, তখনো ফোন রিসিভ করেননি মনি কিশোর। ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো কারণে ফোন ধরছেন না। কোনো অনুষ্ঠানে হয়তো ঢাকার বাইরে গিয়েছেন। কিন্তু নম্বরটি শুক্রবারে চালু থাকলেও পরে গতকাল সন্ধ্যার পর বন্ধ পান।
গতকাল সন্ধ্যার পর পপি ভবনের সামনে ভিড় জমে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য শামসুদ্দোহা আরও কয়েকজনকে নিয়ে চলে যান মনি কিশোরের দরজার সামনে। তখন গন্ধে তাঁরা দাঁড়াতেই পারছিলেন না। ধরে নেন, মনি কিশোরের কিছু একটা হয়েছে। অনেক ডাকাডাকি করেন। শামসুদ্দোহা আজ রোববার দুপুরে প্রথম আলোকে জানান, সন্দেহ হলে তিনি মনি কিশোরের বন্ধু আদনান বাবুকে প্রথম ফোন দিয়ে দ্রুত আসতে বলেন। তখন আদনান পরামর্শ দেন দ্রুত ৯৯৯–এ ফোন করতে।
রাত ৯টা ৪৫ এর দিকে ৯৯৯ ফোন দিয়ে পুলিশকে ঘটনা জানান। রাত ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পরে বাড়ির মালিক ও পাশের বাসার প্রতিবেশীসহ আরও কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দরজা খোলা হয়। তাঁরা দেখতে পান বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন মনি কিশোর। তিনি খালি গায়ে ছিলেন। পরনে ছিল প্যান্ট। তাঁর শরীর ফুলে গেছে। কিছু জায়গায় পচন ধরেছে। রাতেই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
পাশের বাসার প্রতিবেশী তাজুল মিয়া জানান, মনি কিশোর বেশির ভাগ সময় বাইরে থেকেই খেয়ে আসতেন। আর মাঝেমধ্যে কাঁচাবাজার করে নিয়ে আসতেন। তবে সেগুলো তিনি নিজে তেমন রাখতেন না। এগুলো প্রতিবেশী অনেককেই দিয়ে দিতেন। তাঁদেরকেও অনেক সবজি দিয়েছেন। তাজুলের স্ত্রী পাশ থেকে বলেন, ‘মনি স্যারকে আমরা তিন বছর ধরে দেখছি এই বাসায়। এ সময় তাঁকে কখনোই খারাপ পাইনি। তিনি নিজের জন্য ফল কিনে আনতেন। একা মানুষ কত আর ফল খাবেন, অনেক ফল এটা–ওটা আমাদের দিয়ে দিতেন।’ এ সময় আফসোস করে তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই দেখতে আসছেন কিন্তু তাঁর আপন কেউ এখনো আসেনি। একটা মানুষ মরে গেল। কোথায় থাকত, কী অবস্থা কেউ দেখতে এল না। এমন মৃত্যু যেন কারও না হয়।’
বাসার মালিক শামসুদ্দোহা জানান, তিনি বিটিভির প্রযোজক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সেই নব্বইয়ের দশকের সময় থেকে তরুণ অনেককে দিয়ে গানের অনুষ্ঠান করিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিল মনি কিশোর। সেই থেকে পরিচয় হলেও তিন বছর আগে তেমন যোগাযোগ ছিল না। তাঁর ওই বাসায় তিন বছর আগে থাকতেন আদনান। তিনি একদিন জানালেন, বাসায় তাঁর সঙ্গে থাকবে মনি কিশোর।
‘মনি কিশোর থাকবে শুনে খুশি হয়েছিলাম। আমাদেরই ছেলে। আমি মানা করিনি। মনিকে আমি সেই আগে থেকেই তুই বলতাম। সে আমাকে আব্বা বলত। ওকে মাঝেমধ্যে দেখতাম তিন-চার দিন কোনো খবর নেই। পরে বলত, শো করতে গিয়েছিল। সেটাও খুবই কম। এবার ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভাড়া দিচ্ছিল না। আমি নিয়মিত ফোন দিতাম। কিন্তু ধরত না। পরে ব্যাকও দিত না। ধরে নিয়েছিলাম এবারও শো করতে গেছে। প্রতিদিনই ফোন দিতাম। পরে কাল রাতে যখন ফোন বন্ধ পাই, তখন মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এভাবে ওর চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক’, বলেন শামসুদ্দোহা।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন মনি কিশোর। এ ছাড়া মানসিক চাপেও থাকতেন। পরিবারের সঙ্গে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না। আগেই বিচ্ছেদ হয়। পরে তাঁর সাবেক স্ত্রী শামীমা চৌধুরী ও একমাত্র কন্যা নিন্তি চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। শামসুদ্দোহা বলেন, ‘পরিবারের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না, যত দূর জানি। মাঝে কিছু সময় মানসিকভাবেও চিন্তিত ছিল। আবার কয়েক দিন আগেই শোনাল, আবার নিয়মিত গানে ফিরছে। এটা নিয়ে কিছু সাক্ষাৎকারও দেখলাম। এর মধ্যেই ছেলেটি মারা গেল। বিটিভিতে থাকা অবস্থায় তরুণদের নিয়ে অনেক প্রোগ্রাম করেছি। সেসব আয়োজন দিয়ে তৈরি হয়েছিল মনি কিশোর। এখনো সেই সম্মান করত।’
জানা গেল, মনি কিশোর সম্প্রতি একটি টেলিভিশনে যোগদান করেছিলেন। সেই কাজেও তাঁকে ব্যস্ত দেখেছেন বন্ধু ও সহকর্মীরা। শামসুদ্দোহা জানান, মনি কিশোর রামপুরা বাজারের পাশে ‘তাল তরঙ্গ’ নামের একটি দোকানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডার এক সহকর্মী মুঠোফোনে বলেন, ‘মনি একসময় যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, পরে সেভাবে ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে পারেনি। এর জন্য বিভিন্নভাবে রাজনীতিরও শিকার হয়েছেন। এই নিয়ে মন খারাপ থাকত। পরে বিচ্ছেদ, আবার মেয়েটিও দেশের বাইরে থাকত। তার সঙ্গে তেমন কথা হতো না। সে অনেকটাই একা হয়ে গিয়েছিল। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করত। কিন্তু বাইরে থেকে কাউকে বুঝতে দিত না। চেয়েছিল গান নিয়ে আবার ফিরতে। সেটা আর হলো না। নিঃসঙ্গভাবেই মরে গেল।’
এই সময় আড্ডার ওই সহকর্মী আরও বলেন, ‘আজ মনি কিশোরকে আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে দাফন করতে হয় কেন? অথচ শিল্পীদের সংগঠনের কেউ কোনো খবরও রাখেননি। কেউ বলেনি লাশটা দায়িত্ব নিয়ে দাফন করা হোক। এর চেয়ে হতভাগ্য আর কোনো শিল্পীর হয়েছে। মনি নিজেও জানত, সে মরে গেলে এমনই হবে। শিল্পী হয়েই আমরা শিল্পীদের সম্মান দিতে পারি না।’
‘কী ছিলে আমার বলো না তুমি’, ‘মুখে বলো ভালোবাসা’, ‘আমি মরে গেলে তুমি জানি কাঁদবে না’, এমন বহু গানের এই শিল্পী নীরবেই থাকতে পছন্দ করতেন। চলতেন সাধারণ যেকোনো মানুষের মতো। ভক্তরাও তাঁকে চিনতে পারতেন না। পপি ভবনের পাশের বাসার দারোয়ান আসাদ আলী আফসোসের সুরে বলেন, ‘মনি স্যারকে বহুদিন ধরেই চিনি। কিন্তু তিনি যে গায়ক সেই মনি কিশোর, এটা জানতাম না। কলেজে পড়ার সময় তাঁর গান নিয়মিত শোনতাম। তাঁর অ্যালবাম কিনেছি। তিনি আমার পছন্দের শিল্পী। কিন্তু গতকাল জানতে পারলাম, তিনি সেই মনি কিশোর। আগে জানলে তো ছবি তুলে রাখতাম।’