‘ভালো গায় বলে সংগীত ভবনেও ওর আলাদা পরিচিতি ছিল’

পাপিয়া সারোয়ারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকোলাজ

চলে গেলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। আজ বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এর আগে কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। গতকাল শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। আজ সকালে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট খুলে দেওয়া হয়। পাপিয়া সারোয়ারের মরদেহ বেলা একটায় ধানমন্ডি ২৮ নম্বরের বাসায় নেওয়া হয়। আজ রাতে বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। কাল জুমার পর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
পাপিয়া সারোয়ার প্রসঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও অনুজেরা শিল্পী ও মানুষ হিসেবে কেন তিনি আলাদা ছিলেন, সে বিষয়ে কথা বলেছেন। স্মৃতিচারণা করেন বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা—পাপিয়াকে যখন আমি চিনি, সময়টা তখন ১৯৭৫ সাল।

বই পড়তে ভালোবাসতেন পাপিয়া সারোয়ার
ছবি: কবির হোসেন

পাপিয়া তখন পাপিয়া রহমান, শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনে থার্ড ইয়ারে, আমি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম। তখন থেকেই পাপিয়ার নিজস্ব গায়ন, সাজগোজের আলাদা একটা ধরন, ব্যক্তিত্ব—সবকিছু নিয়ে একটু স্বতন্ত্র ছিল। সংগীত ভবনের সবাই পাপিয়াকে আলাদা করে চিনত। তখন থেকেই পাপিয়া খুব ভালো গাইত। ভালো গায় বলে সংগীত ভবনেও ওর আলাদা পরিচিতি ছিল। পাপিয়াকে আমরা বলতাম, পাপ্পু খালা। আমাদের এক বন্ধু শম্পার (অভিনয়শিল্পী শম্পা রেজা) খালা ছিল, তাই। অনেক দিন পর পাপ্পু খালা পাপিয়া হয়ে গেছে, তত দিনে আমরা আমাদের শিল্পের জীবনে পথচলা শুরু করেছি।

এত দিনের পুরোনো পরিচয়, পুরোনো সম্পর্ক—আমি যখন শান্তিনিকেতনে, পাপিয়া ফোর্থ ইয়ারে গ্র্যাজুয়েশন করে বাংলাদেশে চলে এল, বিয়ে করে সংসার শুরু করে। আর মাস্টার্স করেনি। এরপর দেশে সংগীতজীবন শুরু করে। আমি তারপর ১৯৭৯ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম। এরপর মাস্টার্স করলাম। অনেক পুরোনো সম্পর্ক, পুরোনো পরিচয়। আমার পাশের ঘরে সে থাকত। তার রেয়াজ করার ভঙ্গি—সবকিছু আমরা সে সময় অনুসরণ করতাম। সিনিয়র হিসেবে তার আলাদা একটা স্টাইল ছিল। সে হিসেবে আমাদের সবারই খুবই আগ্রহের ছিল, আমরা অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম।
আমাদের দুজনের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাদি, আমি, পাপিয়া, নিঝু—শান্তিনিকেতন থেকে পাস করেছিলাম। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র ছিল। সবকিছুতে পরামর্শ দিত।

ঢাকায় আসার পরও নিজে নিজের ক্ষেত্রে পায়ের তলার মাটি শক্ত করার জন্য চেষ্টা করছি, যুদ্ধ করছি; তখন পাপিয়া একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমাদের সবাইকে নিয়ে কীভাবে থাকব, কী করব—একটা বড় একজন বন্ধু, গাইড ও ফিলসফার ছিল। আজকে এত দিন পর পাপিয়ার চলে যাওয়াটা, আমি জানতাম যে ওর ক্যানসার হয়েছে, কিন্তু চলে যাবে যে এত তাড়াতাড়ি, আমার ভাবনায়ও ছিল না। আমি সত্যিই মানতে পারছি না। খুবই খারাপ লাগছে। দেশের বাইরে আছি বলে, ওকে একটা শ্রদ্ধা ও শেষবিদায় জানাব—তা–ও পারছি না। এটা আরও বেশি মনঃকষ্টের কারণ হয়ে গেল। আমরা সবাই একই গুরুর কাছে গান শিখেছি, মোহরদি, বাচ্চুদি, অশেষদা, মঞ্জুদি—একই গুরুর শিষ্য আমরা। সে হিসেবে আমাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক অলিখিত বন্ধন ছিল, যেটা শান্তিনিকেতনে যারা পড়েনি তারা বুঝতে পারবে না—এই বন্ধনটা কী রকম।