মমতাজুল হক দুলু ছিলেন সংগীতপাগল এক কিশোর। যেখানেই গানের আসর, সেখানেই দুলু। ১৯৭২ সালে সেন্ট মেরীস স্কুলে এমনই এক কনসার্টে আরেক গানপাগলের সঙ্গে পরিচয়। নাম সাজেদ উল আলম। দারুণ গিটার বাজান সাজেদ। প্রথম দিনই তাঁকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন দুলু। গিটার আর বেনজু বাজিয়ে শোনালেন। দুলুর বাদনে দারুণ খুশি সাজেদ। এবার তাঁর নিজের পালা। কাজীর দেউড়ি বাসায় দুলুকে অ্যাকোর্ডিয়ান ও গিটার বাজিয়ে শোনালেন সাজেদ। পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়ে সংগীতের প্রতি আগ্রহ বাড়ল দ্বিগুণ। ঠিক হলো, একটা অর্কেস্ট্রা গড়ে তুলবেন। সাজেদের বাবা সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম দলের নাম ঠিক করে দিলেন ‘সুরেলা’। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করে সুরেলা। একপর্যায়ে তারা বুঝতে পারে, ধ্যানধারণা পাল্টাতে হবে, হতে হবে বৈশ্বিক। এ ভাবনা থেকেই ১৯৭২ সালের শেষ দিকে সুরেলা হয়ে গেল ‘সোলস’।
শুরুর দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মমতাজুল হক বলেন, ‘আমরা এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে নিয়ে আসি। একজনের পরিচয়সূত্রে আরেকজনকে পাই। শুরুর দিকে তো পাড়ার অনুষ্ঠানে, ক্লাবের অনুষ্ঠানে গান করতাম। সেই সময় সাজেদ একদিন নিয়ে এল তার কলেজিয়েট স্কুলের বন্ধু সুব্রত বড়ুয়া রনিকে। তবলা ও কঙ্গো বাজাত ও। রনি আসার পর আমাদের দলে নতুন মাত্রা এল। তপন চৌধুরীও যোগ দিয়েছিল আমাদের একেবারে শুরুতে। রনিই নিয়ে এসেছিল। একদিন বিকেলে ডিসি পার্কে তপন আমাদের গান গেয়ে শোনাল। আমরা মুগ্ধ। সে যোগ দিল। আমাদের গায়কের অভাব মিটল। কদিন পর রুডি ও লরেঞ্জো নামে দুই তরুণকে নিয়ে এল রনি। তারা ইংরেজি গান গাইত। এভাবে আমরা ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হতে লাগলাম।’
সোলসের বর্তমান লাইনআপ
নাসিম আলী খান: কণ্ঠ
পার্থ বড়ুয়া: গিটার ও কণ্ঠ
আহাসানুর রহমান আশিক: ড্রামস
মীর মাসুম: কি–বোর্ড
মারুফ হাসান: বেজ গিটার
সোলসের আরেক অবিচ্ছেদ্য শিল্পী নকীব খান। ১৯৭৪ সালে সোলসে যোগ দেন। মাত্র ১৫ কি ১৬ বছর বয়সী এই তরুণ শিল্পী সোলসে মৌলিক গান অন্তর্ভুক্ত করেন। নকীব আগে বালার্ক ও সৈকতচারী নামে দুটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সোলসের প্রথম অ্যালবাম সুপার সোলস-এর অধিকাংশ গানের সুর দিয়েছেন নকীব। পারিবারিক কারণে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যেতে হলো বলে নকীবকে সোলস ছাড়তে হলো। ১৯৮৩ সালে।
সোলস সম্পর্কে নকীব খান বলেন, ‘একেবারে তরুণ অবস্থায় সোলসে যোগ দিই। তাই সোলসের মায়া ছাড়তে পারিনি। আমাদের গানের জগতে সোলস একটি মাইলফলক।’
সোলসের আলোচিত
শুধু মন ছুঁয়েছে
এ এমন পরিচয়
কেন এই নিঃসঙ্গতা
এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে
কলেজের করিডোরে দেখেছি
চায়ের কাপে পরিচয় তোমার সাথে
যেতে যেতে পরিচয় কিছু কথা বিনিময়
ফরেস্ট হিলে এক দুপুরে
ব্যস্ততা আমাকে দেয় না
ভালোবাসি ওই সবুজ মেলা
সোলসের জনপ্রিয় অনেক গান আবদুল্লাহ মামুনের লেখা।
সোলস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সোলসের উত্থান চট্টগ্রামে। কিন্তু সারা দেশের সংগীতে দলটি একটি বিরাট তরঙ্গ তুলতে পেরেছে।’ ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সোলসে বেজ গিটার বাজাতেন মোহাম্মদ আলী। তিনি বললেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পপ সংগীতে যে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে সোলস।
একেবারে তরুণ অবস্থায় সোলসে যোগ দিই। তাই সোলসের মায়া ছাড়তে পারিনি। আমাদের গানের জগতে সোলস একটি মাইলফলক।
সোলসের নাম বললে এই নামগুলো ছাড়াও আমাদের মনে পড়ে আইয়ুব বাচ্চু, পিলু খান, নাসিম আলী খান, জেরেট, র্যালি পিনারু, রুডি থমাস, আহমেদ নেওয়াজের নাম। তাঁদের স্বপ্ন থেকেই সোলসের আবির্ভাব। নতুন এসেছে, পুরোনো বিদায় নিয়েছে, কিন্তু সোলসের যাত্রা অক্ষুণ্ন থেকেছে। তাই তো ৫০ বছরেও প্রবীণ হয়নি সোলস।
সোলসের জনপ্রিয় ১২টি অ্যালবাম: সুপার সোলস, কলেজের করিডোরে, মানুষ মাটির কাছাকাছি, ইষ্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, এ এমন পরিচয়, আজ দিন কাটুক গানে, অসময়ের গান, মুখরিত জীবন, তারার উঠোনে, টু-লেট, ঝুটঝামেলা ও জ্যাম।
বর্তমানে সোলসের প্রাণপুরুষ পার্থ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘সংগীতপ্রেমী মানুষের ভালোবাসায় ৫০ বছর ধরে বেঁচে আছে। মানুষের ভালোবাসার টানে রয়ে গেছি।’ সোলসের গানে বাংলাদেশের আত্মার স্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাই ৫০ বছরেও ফুরায়নি তাদের গানের আবেদন। এখনো তরুণদের মুখর আড্ডায়, পিকনিকের আনন্দে কিংবা আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে উল্লাসের সঙ্গে নেচে নেচে নতুন প্রজন্মের গানপ্রেমীরা গেয়ে ওঠেন ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ অথবা ‘এই মুখরিত জীবনের চলার পথে’। এগুলো জনপ্রিয় এই ব্যান্ডেরই গান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সী এই দল। হয়তো আরও ৫০ বছর পর সেদিনের কোনো এক তরুণের কণ্ঠেও উচ্চারিত হবে ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’। এভাবেই বেঁচে থাক সোলস যুগের পর যুগ।