১৭ বছরেও সঞ্জীবের গানের রং ফিকে হয়নি
লেখাপড়ায় অসাধারণ ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—দুটি পরীক্ষাতেই মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু ভালো লাগল না বলে থিতু হলেন না। বিভাগ পরিবর্তন করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে গেলেন। কর্মজীবনে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। ভালোবেসে ফলিয়েছিলেন সোনার ফসল। তাঁর হাতে ‘ফিচার’ ভাষা পেয়েছে।
সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের মাকালকান্দি গ্রামে। বাবা-মায়ের সপ্তম সন্তান তিনি। কর্মমুখর জীবনে অনেক পরিচয়ে অভিষিক্ত করেছেন নিজেকে। লিখেছেন কবিতা, গল্প, নাটকসহ নানা কিছু। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর পৃথিবীর বাতাসে শেষবার নিশ্বাস ছেড়েছেন তিনি। ৪৩ বছর বয়সের ছোট্ট জীবনে বাংলা গানে তৈরি করে গেছেন নতুন ধারা। গান দিয়ে জিতে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়। ১৭ বছর পরও তাঁর গানের রং ফিকে হয়নি। একইভাবে ভালোবেসে তাঁর গান আঁকড়ে রেখেছেন শ্রোতারা। ভক্ত, অনুরাগীরা আজও তাঁকে শ্রদ্ধা নিয়ে স্মরণ করছেন। আজ সারা দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে কথা হয়েছে, ছবি শেয়ার করেছেন অনেকে। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সঞ্জীব চত্বরে ‘সঞ্জীবসন্ধ্যা’র আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন।
‘আমি তোমাকেই বলে দেব/ কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে/ আমি তোমাকেই বলে দেব/ সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়/ ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া’। কথাগুলো উচ্চারিত হতেই কেমন যেন ভালো লাগা অনুরণিত হয়। বাপ্পা মজুমদারের সুরে গানটিতে জীবনের চূড়ান্ত সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন সঞ্জীব। তাই তো গানের পরের চরণে তিনি যখন গেয়ে ওঠেন, ‘আমি কাউকে বলিনি সে নাম/ কেউ জানে না, না জানে আড়াল/ জানে কান্নার রং, জানে জোছনার ছায়া’, তখন মন কেমন করে ওঠে।
ভালোবাসা, প্রেম, বিরহ, প্রতিবাদ, দ্রোহ—প্রতিটি বিষয়কেই নিজস্ব ভাষায় গানে তুলে ধরেছেন সঞ্জীব। যা কেবল তাঁর নিজের ভাষা বা নিজের গান হয়েই থেকে যায়নি, ক্রমেই শ্রোতাদের ভাষা ও অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে। শোষকের বিরুদ্ধে গানে গানে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। কঠিন সময়েও তাঁর গান থামেনি, প্রতিবাদ জারি রেখেছেন।
সঞ্জীব সংগীতচর্চা শুরু করেছিলেন শঙ্খচিল নামের একটি সংগীত দলে যুক্ত হয়ে। ফোক গানের প্রতি তাঁর বিশেষ ভালো লাগা ছিল। তাঁর কণ্ঠে ফোক জমেছেও বেশ। বাউল শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘গাড়ি চলে না চলে না/ চলে না রে, গাড়ি চলে না’ গানটি তাঁর কণ্ঠে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে জনপ্রিয় ব্যান্ড দলছুট গঠন করেন সঞ্জীব। দুজনের প্রয়াসে দলছুট শ্রোতাদের মন জিতে নেয়। দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। ১৯৯৭ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরও কয়েকটি অ্যালবাম বেরিয়েছে দলছুট থেকে।
কবি কামরুজ্জামান কামুর লেখা সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া ‘আগুনের কথা বন্ধুকে বলি,’ ‘তোমার ভাঁজ খোলো, আনন্দ দেখাও’, ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ’ গানগুলোও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে।
নিজের লেখা কবিতাতেও সুর দিয়েছেন সঞ্জীব। কবিতা থেকে বানিয়েছেন গান। ছোটগল্পও লিখেছেন কিছু। তাঁর ‘রাশ প্রিন্ট’ আশির দশকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সেরা গল্পগ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত হয়। নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখার কাজেও দক্ষ ছিলেন সঞ্জীব। ‘সুখের লাগিয়া’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয়েও নাম লিখিয়েছিলেন এই শিল্পী।
গল্পকার, নাট্যকার, সাংবাদিক—নানা পরিচয়ের মধ্যে শিল্পী হিসেবেই সমধিক পরিচিত সঞ্জীব চৌধুরী। গান দিয়েই আসন করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। ‘আমি ফিরে পেতে চাই/ সেই বৃষ্টিভেজা সুর/ আমি ফিরে পেতে চাই /সাত সুখের সুমুদ্দুর’। গানের এই আহ্বান কেবল সঞ্জীবের একার নয়, প্রত্যেকে এভাবে বলতে চাই। প্রেমিকমাত্রই বলতে চাই, ‘আমি রাগ করে চলে যাব ফিরেও আসব না/ আমি কষ্ট চেপে চলে যাব খুঁজেও পাবে না/ মেয়ে আমাকে ফেরাও/ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’। গানে সহজভাবে বলতে পারা, সবার কথা বলতে পারাই কি তাঁর গানের প্রতি শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে? কনসার্ট থেকে ঘরোয়া আয়োজন—সর্বত্র নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাঁর গান গেয়ে থাকেন।