আশার বয়ানে আশা
লতা মঙ্গেশকর না আশা ভোসলে—রাহুল দেববর্মনও নিশ্চিত ছিলেন না, কে সেরা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মতে, আশাকে দিয়ে যেকোনো গান গাওয়ানো যায়। কিন্তু কিছু গান আবার লতা ছাড়া হয় না!’ একই প্রসঙ্গে গীতিকার, পরিচালক গুলজার বলেছিলেন, ‘চাঁদে দুটি লোক একই সঙ্গে নামল। তুমি যে প্রথম পা দিল, তাকে নিয়ে এমন নাচানাচি শুরু করলে যে অন্য লোকটার কথা ভুলেই গেলে। আরে, সে–ও তো ভাই চাঁদে একই সঙ্গে গিয়েছে!’ আশা ভোসলে তেমনই—দ্বিতীয় জন। আজ তাঁর ৯২তম জন্মদিন। ১৯৩৩ সালে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর গানের ভক্ত অনেক। তবে আজ ব্যক্তি আশা ভোসলেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করুন প্রথম আলোর সঙ্গে। বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে এই প্রতিবেদন।
এক সাক্ষাৎকারে আশা ভোসলেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন গানে আপনাকে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করা যায়? হেসেই জবাব দিয়েছিলেন আশা, ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা/ইঁহা কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা...’
ঠিকই। আশা ভোসলের জীবনটা এ রকমই। অনেক চড়াই-উতরাই সেখানে। আশা বলে চলেন, ‘আরেকটা গান আছে, আমার সঙ্গে খুব যায়—“আগে ভি জানে না তু, পিছে ভি জানে না তু।” তুমি আগে কী হয়েছে জানো না, পরে কী হবে, তা–ও জানো না। তাহলে এত ভেবে কী করবে?’
এ–ই হচ্ছে আশা ভোসলে। অনেকে বলে থাকেন, বড় বোন লতার যুগে জন্ম নেওয়াটা যাঁর জীবনে সবচেয়ে দুর্ঘটনা।
কিন্তু যাঁর নামেই আশা, তিনি কেন দুর্ঘটনাকে পাত্তা দেবেন?
গান ও সংসার সমান্তরালে
আশা ভোসলে কিংবদন্তি গায়িকা। পাশাপাশি পুরোদস্তুর সংসারী এক নারী, সফল মা। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, এতটা ‘কমপ্লিট ওম্যান’ হওয়া কী করে সম্ভব?
আশা ভোসলে বলেছিলেন, ‘আমি চাই মানুষ আমাকে মনে রাখুক সেই নারী হিসেবে, যে সৎ মন নিয়ে আপ্রাণ কাজ করেছে। যে কাজ থেকে কখনো পালিয়ে যায়নি। যে কাজ পেলেই এনার্জি পেয়ে গেছে। যে মঞ্চে পারফর্ম করেই বসে থাকেনি। যে স্টেজ থেকে নেমে আবার সংসারটা চালিয়েছে। যে নিজে রান্না করেছে। যে পরিবারের সবাইকে দেখেছে। যে কর্তব্য সামনে দেখলেই নতুন এনার্জিতে ভরপুর হতে পেরেছে।’
প্রশ্ন ছিল, এই বয়সেও যে এত উদ্যম, শরীরজনিত সমস্যা নেই?
আশার জবাবটা ছিল পরিষ্কার, ‘আমার রক্তচাপ পুরোপুরি ঠিক আছে। সুগার নেই। কোলেস্টেরল নেই। তবে হিমোগ্লোবিনটা একটু কম আছে। মাঝেমধ্যে সেটা বেশ সমস্যা করে। পাত্তা দিই না। সেটা নিয়েই লড়ছি।’
আশা বলেন, ‘আমাদের দেশে ষাট হতে না হতেই বেশির ভাগ মানুষ খুব মনমরা হয়ে পড়ে। অবসরজীবনে তারা হতাশায় ভোগে। অনেককে দেখেছি অবসরে যাওয়ার আগেই প্ল্যানিং করছে, আহা, দুপুরে আরামে ঘুমোতে পারব! কিন্তু আমার কাছে সেটা আলসেমি। আমি অসুস্থ না হলে জীবনে দুপুরে ঘুমাইনি। একদম হাতে কাজ না থাকলে ঘর পরিষ্কার করি। চুপ করে বসা আমার ভাগ্যে নেই। আমার সাফ কথা হলো, ভাই, জীবনে থাকতে হলে সামনে তাকাতে হবে। দৌড়াতে হবে। কিসের অবসর? “অবসর” শব্দটাই আমার কাছে অরুচির। আমি বলব, অবসরের আগে মনে মনে ছকে নিন, এবার নতুন নতুন কী কাজ করবেন।’
আশার নেশা রান্না আর পড়া
আশার ছোটবেলার কথা। ভারতে তখনো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। ছোট্ট আশা মঙ্গেশকর তাই কোনো কোনো দিন খোলা দরজা দিয়ে আসা রাস্তার লাইটের আলোয় বই পড়তে পড়তে কাটিয়ে দিতেন সারা রাত। পড়ার এমনই নেশা ছিল তখন। নেশাটা কিন্তু যায়নি। মারাঠি সাহিত্য, মারাঠিতে অনুবাদ করা যেকোনো ভাষার উপন্যাস বা হিন্দি গল্প—হাতের কাছে পেলে কিছুই এখনো ছাড়েন না। নিয়মিত লেখালেখিও করেন ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘গায়িকা না হলে কী হতেন?’ আশার ঝটপট জবাব, ‘পেশাদার রাঁধুনি হতাম। বেছে বেছে চারটা বাসায় রান্না করে প্রচুর টাকা কামাতাম। হা হা হা।’
রান্না করতে খুব ভালোবাসেন আশা। রাঁধেনও চমৎকার। মুম্বাইয়ের অনেক নায়ক-নায়িকাই তাঁদের প্রিয় আশাজিকে পেলে মাংস আর বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য চেপে ধরেন। কাপুর পরিবারে তো আশা ভোসলের রান্না করা মাছ, পায়া কারি আর ডাল ভীষণ জনপ্রিয়। ‘আশাজ’ নামে দশটা রেস্তোরাঁ আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
নিজেকে ঠিক রাখার মন্ত্র
মঙ্গেশকর পরিবারের তৃতীয় সন্তান আশার জীবনে কঠিন সময় এসেছে বহুবার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন গণপত রাও ভোসলেকে। প্রথম বিয়েতে সুখী হননি। বিচ্ছেদের পর ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সুরকার, সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মনকে।
১৪ বছর সংসার করার পর রাহুল মারা যান। রাহুল দেববর্মনের মৃত্যুর পর আদৌ তাঁদের বিয়ে হয়েছিল কি না, এসব নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন আশা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ছেলের মৃত্যু দেখেছেন। দেখেছেন সব সময়ের সঙ্গী একমাত্র মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুও।
লড়াই করতে অনেকেই পারে, কিন্তু এত সব উথালপাতালের মধ্যে নিজেকে ঠিক রাখার মন্ত্র কী? আশা ভোসলে আশাবাদী জবাব দিলেন, ‘নিজেকে বোঝানো। সবার জীবনে খারাপ দিন আসে, ভালো দিন আসে। নিজের মধ্যে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, খারাপ দিনে যতই ঝোড়ো হাওয়া দিক, নিজের জায়গা থেকে নড়ব না। নিজের মেহনত থেকে সরব না। একদিন না একদিন সময় ফিরবেই।’