বাস্তবে ফিরে এসে বুঝি তিনি নেই, কী হারালাম!
পেশাদার সংগীতজীবনে ১৫ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এর মধ্যে নন্দিত, কালজয়ী গানের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। তাঁকে বলা হয় দেশের প্লেব্যাক–সম্রাট। চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের অন্যতম সহশিল্পী ছিলেন কনক চাঁপা। তাঁরা জুটি বেঁধে বহু শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। প্লেব্যাক–সম্রাটের জন্মদিনে গতকাল সোমবার গায়িকা কিছুটা আক্ষেপের সুরেই তাঁকে স্মরণ করলেন। জানালেন, তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। বাংলা গানের অসাধারণ এই শিল্পীকে আরও মূল্যায়নের দরকার ছিল বলে মনে করেন কনক চাঁপা।
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। তাঁর পুরো নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। মা ছিলেন সংগীতানুরাগী, কিশোর কুমারের ভক্ত। সেই সূত্রেই ছেলের নাম রাখেন কিশোর। বড় হয়ে ছেলে তাই মায়ের স্বপ্ন পূরণে গানের ভুবনে পা রাখেন আর রচনা করেন ইতিহাস। মূলত সিনেমার গানের শিল্পী হিসেবে কালজয়ী এন্ড্রু কিশোর। ১৯৭৭ সালে ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায় আলম খানের সুরে প্রথম গান করেন তিনি। তবে শ্রোতামহলে তাঁর কণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ে ১৯৭৯ সালের ‘প্রতিজ্ঞা’ সিনেমার ‘এক চোর যায় চলে’ গানের মাধ্যমে। তাঁর গাওয়া কালজয়ী গানের মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমার ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘সব সখিরে পার করিতে’, ‘ও সাথিরে’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আকাশেতে লক্ষ তারা’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’, ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও’ ইত্যাদি।
এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানের মতোই তিনি এখনো ভক্ত-সহকর্মীদের মনে রয়ে গেছেন। বিশেষ এই দিনে তাঁকে স্মরণ করেছেন সংগীত অঙ্গনের অনেকেই। সিনেমায় একসময় জনপ্রিয় গানের জুটি ছিলেন এন্ড্রু কিশোর ও কনক চাঁপা। তাঁরা একসঙ্গে অনেক সিনেমায় গান করেছেন। জনপ্রিয় এই গায়কের জন্মদিন উপলক্ষে গতকাল সোমবার আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন কনক চাঁপা। এন্ড্রু কিশোরকে স্মরণ করে কনক চাঁপা লিখেছেন, ‘আমাদের এন্ড্রু কিশোর। আমি বলি গলিত সোনার নহর। তিনি দৈহিকভাবে কত বছর হয় চলে গেছেন, আমি তা গুনি না। ভাবতেই ভালো লাগে না যে তিনি নেই। তাঁর গান আকাশ, বাতাস, পাতাল, নদী, সাগরে ভাসে।’
এখনো দেশের শ্রোতারা নিয়মিত এন্ড্রু কিশোরের গান শোনেন। তাঁর গান নিয়ে গবেষণা হয়, এ বিষয়টি উল্লেখ করে কনক চাঁপা লিখেছেন, ‘আমার তো মনে হয়, পৃথিবীর আনাচকানাচ যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী আছেন, সেখানেই প্রতি সেকেন্ডেই কারও না কারও কাছে তাঁর গান বাজে, কেউ গায়, কেউ গুনগুন করে, কেউ শেখার চেষ্টা করে, কেউ তাঁকে, তাঁর গান, তাঁর কণ্ঠ নিয়ে গবেষণা করে। আমি ভাবতেই চাই না তিনি নেই, তবু আমি মানুষ! তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে বিষণ্ন করে। হঠাৎ আনমনা হয়ে ভাবি, একদিন তাঁকে মজার রান্না করে খাওয়াব, পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরে পাই, বাস্তবে ফিরে এসে বুঝি তিনি নেই এবং কী হারালাম!’
চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ার। দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে বাংলা, হিন্দিসহ বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তাঁর চলে যাওয়া যেন অপূরণীয় ক্ষতি। কনক চাঁপা লিখেছেন, ‘আবারও বলি, আমাদের একজন কিশোরদা ছিলেন, যিনি আমাদের অনেক দিয়েছেন কিন্তু আমরা কি তাঁকে সঠিক সম্মান দিয়েছি? স্টেডিয়ামে বিশাল করে একটা এন্ড্রু কিশোর নাইট করে রাতভর তাঁর গান পেটভরে, হৃদয়ভরে শুনেছি! এখন কোটিবার উচ্চারিত হয় “বড্ড অপূরণীয় ক্ষতি” হয়ে গেল! তাতে তাঁর আর কিছুই আসে-যায় না। যায় কি?’
২০২০ সালের ৬ জুলাই মারা যান এন্ড্রু কিশোর। শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে এন্ড্রু কিশোর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ ছাড়া বাচসাস পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারও রয়েছে তাঁর অর্জনের খাতায়।