ধলেশ্বরীর পাড়ের পালাগান থেকে রাজনীতির ময়দানে, মমতাজ যেন বিস্ময়
বাংলাদেশের লোকগানের তুমুল জনপ্রিয় গায়িকা মমতাজ বেগম বড় হয়েছেন মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের চরদুর্গাপুর গ্রামে। এই জীবনে কখনোই তাঁর চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি ছিল না। অল্পেই তুষ্ট থাকতেন। বাবা ছিলেন বাউল। তাঁর সাধ্যও ছিল কম। মমতাজের জীবনকাহিনি যেন হার মানায় রূপকথার গল্পকেও। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো পেয়েছেন সুনাম, যশ-খ্যাতি। নিজের জীবনী থেকে চলচ্চিত্র, গানে গানে বাংলার কোটি কোটি মানুষকে মুগ্ধ করেছেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে রাজনীতি থেকে সুরের ময়দান—সবখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শিল্পী মমতাজ বেগম। ধলেশ্বরীর পাড়ের পালাগানের শিল্পী থেকে হালের বড় রাজনীতিবিদ, সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ যেন এক অবাক বিস্ময়ের নাম।
১৯৭৪ সালের ৫ মে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন মমতাজ বেগম। তাঁর মা উজালা বেগম। বাবা মধু বয়াতি ছিলেন বাউলশিল্পী। মমতাজ প্রথম জীবনে বাবা মধু বয়াতি, পরে মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, শেষে লোকগানের শিক্ষক আবদুর রশীদ সরকারের কাছে গান শেখেন। এরপর গানকে সঙ্গী করে এখান থেকে সেখানে দৌড়ে বেরিয়েছেন শিল্পী। বাধার বিশাল পাথর ডিঙিয়ে হয়েছেন আজকের মমতাজ। গানকে আপন করে নিয়েই এগিয়ে গেছেন তিনি। সংসারে নানান অস্থিরতা থাকলেও সেটি তাঁর সংগীতজীবনের ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি।
লোকগানকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন সংগীতশিল্পী মমতাজ। একটা সময় মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ভক্তদের ভালোবাসায় কয়েক দফায় হয়েছেন সংসদ সদস্যও। তবে মমতাজ জানিয়েছেন, রাজনীতি আর সমাজসেবা করলেও গানই তাঁর আপন ভুবন। রক্তের সঙ্গে মিশে আছে সুর। গান কখনো ছাড়তে পারবেন না। সত্যিই, মমতাজ গ্রামবাংলার মানুষের প্রাণের শিল্পী। বাংলা লোকসংগীতের সুরধ্বনি তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তা গ্রামগঞ্জ থেকে ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। যদিও মা উজালা বেগমকে হারানোর পর জন্মদিন নিয়ে তেমন আবেগ কাজ করে না শিল্পীর। তবে সব সময়ের মতোই সবার কাছে দোয়া ও ভালোবাসা চান শিল্পী। দুই দশকের বেশি তাঁর পেশাদারি সংগীতজীবনে ৭০০টির বেশি একক অ্যালবাম প্রকাশ পায়। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে অগণিত গান।
জন্মদিন নিয়ে আগ্রহ কমছে মমতাজের। তিনি বলেন, ‘এখন জন্মদিন উদ্যাপন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ পাই না। অবশ্য কখনোই এসব নিয়ে আলাদা আয়োজন আমার জীবনে ছিল না। তবে ছেলেমেয়েরা আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করে। এবারও হয়তো করবে।’
এবারের জন্মদিনে মমতাজ আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ২ মে নিউজার্সিতে সম্মাননা পান দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ। পরে গান গেয়ে শোনান। দেশে বাঙালি উৎসবে গান গাওয়া, আর প্রবাসে বাঙালি উৎসবে গান গাওয়া—এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে মমতাজ জানান, ‘বাংলাদেশের নিজ সংস্কৃতি থেমে নেই, প্রবাসেও এর চর্চা অব্যাহত। তবে আমরা ছোটবেলায় যে বৈশাখী উদ্যাপন করতাম, তা এখন আর হয় না। সেই মেলায় যাওয়া, খেলাধুলা করা, নানান বাহারি জিনিস কেনা, বাতাসা-কদমা খাওয়া এখন খুব মিস করি। তবে এখন শহরের মানুষ খুব জোরেশোরেই বৈশাখী উদ্যাপন করে। বিশেষ করে প্রবাসে, আমার দুই মেয়ে কানাডায় থাকে। তারা বৈশাখী উপলক্ষে শাড়ি-চুড়ি-টিপ জোগাড় করে উদ্যাপন করেছে। আমি নিউইয়র্কে দেখেছি, যেকোনো বয়সের প্রত্যেক বাঙালি চিরায়ত বাঙালি সাজে মেলায় এসেছেন। তাঁরা বাউল গান গাইছেন, এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দেখেই আমার শান্তি।’
মমতাজ তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরে ফ্লোরিডা, নিউজার্সি, কানেকটিকাটসহ আরও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঘুরেছেন। সামনের সপ্তাহে ভার্জিনিয়া, টেনেসি যাওয়ার ইচ্ছা আছে। নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় শেষ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ১৯ মে বাংলাদেশে ফিরবেন মমতাজ। এই বছরে আগস্টে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁর। মমতাজ নিজেকে প্রাণের মানুষ ভাবেন। প্রচণ্ড গান ভালোবাসেন। মানুষকে সেবা করার মাধ্যমে জীবন কাটাতে চান এই শিল্পী।