২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

মহারাজার জন্মদিন: ৮টি কালজয়ী সিনেমা চরকিতে

দাদার শূন্য কাজের ঘর থেকে একটি কাঠের বাক্স পেয়েছিল ছেলেটি। সেখানে থাকত দাদার রং, তুলি আর তেলরঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড অয়েলের শিশি। উত্তরাধিকারের সেই ধারা পরবর্তীকালে প্রজন্ম জয়ী হয়েছিল ছেলেটির হাত ধরেই। মায়ের আদরের সেই ছেলের নাম প্রথমে যা রাখা হয়েছিল, পছন্দ হয়নি নবজাতকের বাবার। পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় ‘সত্যজিৎ’। তিনি প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় ও সুপ্রভা রায়ের সন্তান। দাদা ছিলেন সে যুগের এক প্রতিভাবান শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্ম তাঁর। অস্কারজয়ী এই নির্মাতা একাধারে চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক, সংগীত পরিচালক ও লেখক। আজ জন্মদিন তাঁর। মহান এই ব্যক্তির জন্মদিন উপলক্ষে চরকিতে মে মাসজুড়ে মোট ৮টি সিনেমা নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘সত্যজিৎ স্পেশাল’। ২ মে মুক্তি পাবে ‘হীরক রাজার দেশে’। এরপর ৯ মে দর্শক দেখতে পারবে ‘অশনিসংকেত’ ও ‘সোনার কেল্লা’। এরপর ১৬ মে ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’, ২৩ মে ‘অভিযান’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ এবং ৩০ মে ‘জলসাঘর’। নিচে অল্প কথায় জানি চরকিতে সাজানো সেসব ছবির কথা।

হীরক রাজার দেশে
তখন সত্যজিৎ রায়ের বয়স প্রায় ৬০ বছর। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক অনুদানে ১৯৮০ সালে ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়া হয়। এর কাহিনি, সংলাপ, মঞ্চসজ্জা, পরিচালনা—সবকিছুই করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রূপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের প্রায় সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে।
পরিণত বয়সের পরীক্ষিত অভিজ্ঞতার সবটুকু ঢেলে দেওয়ার পরও বাংলা চলচ্চিত্রের জনক এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি যে একটি সাধারণ রূপকথার সাদামাটা এবং স্বল্প বাজেটের চলচ্চিত্র বছরের পর বছর সারা দুনিয়ার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মন জয় করার মাইলফলক স্থাপন করতে পারবে।

সোনার কেল্লা
‘সোনার কেল্লা’ সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় বানানো একটি রহস্য রোমাঞ্চ চলচ্চিত্র। সত্যজিৎ রায় নিজের কাহিনি নিয়েই চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। তিনি ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসটি রচনা করেন ১৯৭১ সালে। ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। চলচ্চিত্রটির শুটিং হয়েছিল রাজস্থানে। ছবির পটভূমিটা এমন, স্কুলপড়ুয়া মুকুল ধর দাবি করে, তার পূর্বজন্মের সব কথা মনে আছে। সোনার কেল্লায় রত্নের কথা উল্লেখ করার পর মুকুলকে অপহরণ করেন ড. হাজরা। ফেলুদা এই কেস নিজ হাতে নেন। ফেলুদা কি পারবেন মুকুলকে ড. হাজরা থেকে উদ্ধার করতে?

পথের পাঁচালী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদি জীবনীমূলক উপন্যাস। চিরায়ত বাংলার অপরূপ আনন্দ-বেদনার আখ্যানে যে উপন্যাস রচনা করেন বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ সেলুলয়েডের মাধ্যমে তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাহিনির সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক। স্থান নিশ্চিন্তপুর নামক বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল। প্রধান চরিত্র অপু ও তার পরিবারের জীবনযাত্রার কথাই পথের পাঁচালীর মুখ্য বিষয়।
অপু এবং দুর্গার বাবা নিশ্চিন্তপুরের পুরোহিত হরিহর রায় পরিবার রেখে শহরে যান উন্নত জীবনের আশায়। আর গ্রামে অপু-দুর্গার দুরন্ত শৈশব কাটে অভাব-অনটনে। একপর্যায়ে দুর্গা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু তার মায়ের ওষুধ কেনার মতো সামর্থ্য নেই। দুর্গা-অপুর দুরন্ত শৈশব ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে নির্মিত পথের পাঁচালী।

অপরাজিত
অপরাজিত অপু ত্রয়ীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। এটি ১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের শেষ এক-পঞ্চমাংশ এবং অপরাজিত উপন্যাসের প্রারম্ভিক এক-তৃতীয়াংশের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ছবিতে অপুর শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ এবং কলকাতায় কলেজে পড়ার সময়কার গল্প তুলে ধরা হয়েছে। ছবিটি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে, যার মধ্যে আছে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের স্বর্ণ সিংহ পুরস্কার। বাবা হরিহর মারা যাওয়ার পর অপু ও তার মা সর্বজয়ার নতুন জীবন শুরু হয় বেনারসে। একসময় বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনার জন্য কিশোর অপু বেনারসের মামার বাড়ি থেকে কলকাতায় পাড়ি জমায়। একা হয়ে পড়ে সর্বজয়া। ছেলের জন্য অপেক্ষায় দিন কাটে তার। ছেলের জন্য পথ ধরে বসে থাকে সে। অপু কি ফিরে আসে তার মায়ের ডাকে?

অভিযান
রাজপুত হওয়া সত্ত্বেও নরসিংহ নিজেকে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। ব্যবসায়ী সুখারাম একদিন তাঁকে বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আফিম পাচারের প্রস্তাব করেন। নরসিংহ কি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন?
তারাশঙ্করের লেখা থেকে করা এই দুটি চলচ্চিত্রতেই মানুষের অহংবোধের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। জলসাঘরে বিশ্বম্ভরের জমিদারি অহংবোধ আর অভিযানে নরসিংহের আভিজাত্যের অহংবোধ সুস্পষ্টভাবে রূপায়িত হয়েছে। তবে অহংবোধ ছাপিয়ে দুটি চলচ্চিত্রেই মানবতা বড় হয়ে উঠেছে। সত্যজিতের শৈল্পিক পরিচালনা দুটিকেই ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়েছে।

চিড়িয়াখানা
ব্যোমকেশ বক্সীর হাতে আসে এক নতুন কেস। সুনয়না নামের এক অভিনেত্রীর নিখোঁজ যাওয়ার ঘটনা তদন্তের জন্য নিশানাথ বাবু অনুরোধ করেন ব্যোমকেশকে। কিন্তু নিশানাথ বাবু নিজে খুন হওয়ার পর ঘটনা আরও জটিল হয়ে ওঠে। এখন কী করে ব্যোমকেশ বক্সী এই কেস সলভ করবেন, সেটাই দেখতে হবে। এই সিনেমায় সত্যজিৎ সমাজ, আইন, অপরাধবিষয়ক ধারণাগুলোকে ক্রিটিক্যালি দেখেছেন। চিড়িয়াখানা নামটাই স্পষ্ট। আপাত সত্যের গভীর থেকে বের করে এনেছেন আরও কিছু। সিনেমায় ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহানায়ক উত্তম কুমার।

জলসাঘর
জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা তাঁর জলসাঘর। সেখানে কদিন পরপর বাইজি ডেকে গানে আর সুরায় মশগুল হয়ে থাকতেন তিনি। হঠাৎ একদিন এক দুর্ঘটনায় বিশ্বম্ভর বাবুর স্ত্রী ও ছেলে খোকা মারা যায়। এরপর থেকে জমিদার বিশ্বম্ভর গানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। হারিয়ে ফেলেন তাঁর সহায়-সম্পত্তিও। বিশ্বম্ভর বাবু কি আবার তাঁর জলসাঘরে আলো ফেরাতে পারবেন? ফিরে পাবেন হারানো প্রভাব-প্রতিপত্তি?
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ১৯৫৮ সালে নির্মিত বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের চতুর্থ চলচ্চিত্র। ছবির শুটিং হয় মুর্শিদাবাদ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নিমতাতা গ্রামের একটি রাজবাড়িতে। এতে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস, পদ্মা দেবী, পিনাকী সেনগুপ্ত, গঙ্গাপদ বসু, কালী সরকার প্রমুখ।