যে কোরিয়ান ছবি সাড়া ফেলেছে নেট দুনিয়ায়
ছবির রিভিউ নিয়ে খোঁজখবর করতে গেলে ধন্দে পড়ে যেতে পারেন। বেশির ভাগ সমালোচকই ছবিটিকে ‘মাঝারি মানের’ বলে রায় দিয়েছেন। রটেন টোমাটোজে মোটে ৩২ শতাংশ, আইএমডিবিতে ৫.১, ভারতীয় সংবাদপত্র দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দিয়েছে ৫-এ ১! ভাবছেন এই ছবি নিয়ে তাহলে আলোচনার কী আছে। তবে রিভিউ রেটিং যেমন সত্যি, তেমনি সমালোচকদের পাত্তা না দিয়ে ছবি দেখতে দর্শকের হুমড়ি খেয়ে পড়ার বিষয়টিও সত্যি। যে ছবি নিয়ে এত কথা, সেই ‘কার্টার’ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ৫ আগস্ট। কয়েক বছর ধরেই কোরিয়ার কনটেন্টের বিশ্বব্যাপী যে আধিপত্য, সেটার নতুন প্রমাণ ‘কার্টার’। মুক্তির মাত্র তিন দিনের মধ্যেই নেটফ্লিক্সে ২৭.৩ মিলিয়ন ঘণ্টা স্ট্রিমিংয়ের রেকর্ড গড়ে ছবিটি। নেটফ্লিক্সের গ্লোবাল টপ চার্টের (নন–ইংলিশ) শীর্ষে উঠে যায়। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ৯০টি দেশে নেটফ্লিক্সের টপ টেন তালিকায় ছিল ‘কার্টার’।
‘কার্টার’ নিয়ে এত মতামাতির সবচেয়ে বড় কারণ, দুর্দান্ত অ্যাকশন। দুনিয়াজুড়ে প্রতি সপ্তাহেই কত যে অ্যাকশন ছবি মুক্তি পায়, ইয়ত্তা নেই। কিন্তু অ্যাকশন কোরিওগ্রাফির যেন নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে ‘কার্টার’। ছবিটির কট্টর সমালোচকও এর অ্যাকশন দৃশ্যের তারিফ করেছেন। বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘কার্টার’-এর অবিশ্বাস্য অ্যাকশন দৃশ্য অনায়াসে হলিউডের বিগ বাজেটের ছবিকে টেক্কা দিতে পারে। বিশেষ করে ছবির লাইভ অ্যাকশন, হেলিকপ্টার যুদ্ধ ও রাতের স্কাই ডাইভিং অ্যাকশন দৃশ্য থেকে চোখ সরানো দায়।
ইন্দোনেশিয়ার অ্যাকশন থ্রিলার ছবি ‘দ্য রেইড’ হলিউডকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ছবির অ্যাকশন দৃশ্য থেকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয় কিয়ানু রিভসের জনপ্রিয় ‘জন উইক’ সিরিজ। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন ‘কার্টার’-এর ক্ষেত্রেও সেটা হবে। ‘কার্টার’-এর পরিচালক জুং বেউয়ং। অ্যাকশন সিনেমা বানাতে তাঁর দক্ষতার প্রমাণ বহুবার দিয়েছেন। ২০১২ সালে দারুণ ব্যবসাসফল ছবি ‘কনফেশন অব মার্ডার’ নির্মাণ করেন। যে ছবি পরে মালয়ালমে রিমকে হয় ‘অ্যানজেল’ নামে।
২০১৭ সালে ছবিটির জাপানি রিমেক ‘মেমোরিজ অব আ মার্ডারার’ মুক্তি পায়। তবে ‘কার্টার’-এর মতো অ্যাকশন সে ছবিতে ছিল না। যার কিছুটা ছিল ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য ভিলেনেজ’-এ। নব্বই দশকের ফরাসি ছবির প্রেরণায় নির্মিত ছবিটিও অ্যাকশনের জন্য ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সেবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে চার মিনিট স্ট্যান্ডিং ওভেশান পেয়েছিল ‘দ্য ভিলেনের’। ওই ছবিতে অবিশ্বাস্য যে অ্যাকশন দেখিয়েছিলেন পরিচালক, ‘কার্টার’-এ সেটিকেই ছাড়িয়ে গেছেন। ‘দ্য ভিলেনের’-এ যে দীর্ঘ লম্বা টেক অ্যাকশন দৃশ্য ছিল, সেটা আরও বেশি আছে নতুনটিতে।
ফেরা যাক ‘কার্টার’ প্রসঙ্গে। ছবির গল্প কার্টার লিকে নিয়ে। ঘুম ভাঙার পর নিজেকে সে অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে—ঘরে মেঝে রক্তের ভেসে যাচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে একদল বন্দুকধারী। কোথায়, কেন, কীভাবে এখানে এল, ভাবতে গিয়ে কার্টার আবিষ্কার করল—আগের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে সে। তবে তাঁর কানে যুক্ত ডিভাইস থেকে আসতে লাগল রহস্যময় কণ্ঠের নির্দেশনা। একদিকে সিআইএয়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে, উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দাদের সহি সালামতে কার্টারকে নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। এর মধ্যে কার্টার জানতে পারে সিআইয়ের হাতে বন্দী এক শিশুকেও উদ্ধার করাও অবশ্যকর্তব্য। এখানেই শেষ নয়—কার্টারকে আরেক পক্ষ জানায়, সে ছিল মূলত সিআইএ এজেন্ট মাইকেল ব্যান! পরিকল্পিতভাবে আগের স্মৃতি মুছে দিয়ে কার্টার নাম দেওয়া হয়েছে তাঁর। সুস্থির হয়ে এই ধোঁয়াশা নিয়ে ভাবার সময় অবশ্য কার্টারের নেই, এই ছবিতে তাঁর ভূমিকা ‘মারো নয়তো মরো’। ছবিতে একা কার্টারকে লড়তে দেখা গেছে অনেকের সঙ্গে। তাদের কেউ বন্দুকধারী, কেউ ছুরি চালাতে ওস্তাদ। অ্যাকশন দৃশ্যের কোনোটা পাবলিক গোসলখানায়, কোনোটা সিঁড়িতে, কোনোটা রাস্তায়, মোটরবাইকে, গাড়িতে। ছবিতে যে গভীরতার সঙ্গে দুরন্ত গতির অ্যাকশন দেখানো হয়েছে, মূলত সেখানেই অন্য অনেক ছবিকে টেক্কা দিয়েছে ‘কার্টার’।
কার্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কে-ড্রামার অতিপরিচিত মুখ জু উন। আগে ‘কিং অব বেকিং, কিম টাকজু’, ‘গুড ডক্টর’, ‘মাই সেসি গার্ল’, ‘অ্যালিস’-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজে দেখা গেছে তাঁকে। এ সিনেমায় তাঁকে দেখে চমকে গিয়েছেন অনেক দর্শক। রোমান্টিক, ড্রামা ঘরানার টিভি সিরিজ থেকে এমন ধুন্ধুমার অ্যাকশন সিরিজে—বলা যায় খোলনলচে হাজির হয়েছেন অভিনেতা, যা তাঁর নিজের কাছেও ছিল চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার। ‘যখন প্রথম চিত্রনাট্য পাই, মনে হয়েছিল—এত ইনটেন্স অ্যাকশন দৃশ্য কি চিত্রায়ণ সম্ভব? তবে আমি অবশ্যই চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছি। মনে হয়েছে, এটা করতে পারলে আমার ক্যারিয়ারের জন্য মাইলফলক হবে,’ বলেন অভিনেতা। জু উনের প্রত্যাশাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে ‘কার্টার’। এমনটা যে হবে, সেটা ছবিটি শুটিংয়ের পরেই বুঝেছিলেন তিনি। ছবিটি মুক্তির আগে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এটা যে নতুন ধরনের অ্যাকশন ছবি হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আশা করি এই ছবির মাধ্যমে কোরিয়ার অ্যাকশন ছবিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারব।’ জু উন জানান, ছবিটি কেবল তাঁর জন্যই নয়, পুরো টিমের জন্যই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ছবিটি করতে সবাইকে ভীষণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ গাড়ি, মোটরবাইক, হেলিকপ্টার, ট্রেন, বিমানে অ্যাকশন কোরীয় সিনেমায় খুব একটা দেখা যায় না।
ছবিটি চিত্রায়ণের প্রযুক্তিগত দিক নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। ছবিটি এমনভাবে ধারণ করা হয়েছে যেন দর্শকের কাছে দেখে ওয়ান টেক ছবি মনে হয়।
পরিচালক জানিয়েছেন, এটা তাঁরা করেছেন পরিকল্পনা করেই। এমনিতেও ছবির অনেক দৃশ্যই দীর্ঘ লং শটের, যা অভিনেতার জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। জু উন বলেন, ‘দুই ঘণ্টার ছবিটি অ্যাকশনে ভরপুর। ফলে আমাকে ছবির প্রতিটি অ্যাকশন দৃশ্য মনে রাখতে হয়েছে। এ জন্য প্রচুর অনুশীলন করতে হয়েছে।’ পরিচালক জানিয়েছেন, অনেক লম্বা ওয়ান টেক শট থাকায় সামান্য ভুল হলেও আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ছবিটি করতে আমাদের অনেক শ্রম দিতে হয়েছে।’
ছবিতে অভিনয়ে জন্য ৩৪ বছর বয়সী অভিনেতাকে ৭ কেজি ওজন বাড়াতে হয়েছে। চুল কামাতে হয়েছে, শরীরে ট্যাটু আঁকতে হয়েছে। ‘আমি এ ছবির জন্য নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছিলাম। ফলে শুটিং শেষে চরিত্র থেকে বের হয়ে আসা ভীষণ কঠিন ছিল,’ বলেন জু উন। ছবির সব অ্যাকশন দৃশ্যই ছিল তাঁর জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জের। তবে সবচেয়ে কঠিন ছিল প্রথমটি। ‘আমাকে প্রায় নগ্ন অবস্থায় পাবলিক গোসলখানায় মারামারি করতে হয়েছে। এটা ছিল সবচেয়ে কঠিন,’ বলেন তিনি।
তবে পরিচালকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল স্কাই ডাইভিং অ্যাকশন দৃশ্যগুলো। জু বলেন, ‘ছবিতে স্কাই ডাইভিং অ্যাকশন দৃশ্য ততটা দীর্ঘ নয়। তবে যা আছে, সেটা করতেও আমাদের প্রায় ১০ দিন লেগে গেছে। যখন ওপর থেকে পড়ছে, তখন দৃশ্য ধারণের জন্য হাতে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ড সময় থাকে।’
গত বছরের মার্চ মাসে ছবিটির কাজ শুরু হয়। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয় শুটিং। এখনো ঘোষণা না এলেও ৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়া এ ছবির শেষ দেখে অনেক দর্শকই মনে করছেন, ছবিটির সিকুয়েল আসবে।