চিরঞ্জিত তাহলে বেঁচেই ছিলেন!

‘নিকষছায়া’য় চিরঞ্জিত। হইচই

চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গিয়ে কী দারুণ অভিনয়, সঙ্গে সেই ট্রেডমার্ক কণ্ঠস্বর। এ যেন কেবল তাঁকেই মানায়। আশি-নব্বইয়ের দশকে এন্তার বাণিজ্যিক ছবিতে দেখা গেছে তাঁকে। শহুরে মানুষ বিশেষ পাত্তা দিত না তখন। তবে গ্রামের মানুষের কাছে ঠিকই হয়ে উঠেছিলেন ‘তুফান’। তাঁর আর শাহরুখের খানের জন্মদিনও একই দিনে—২ নভেম্বর। কিছুদিন আগেই তিনি পা দিয়েছেন ৬৯-এ। জন্মদিনের ঠিক আগে তিনি পর্দায় এসে চমকে দিয়েছেন দারুণ একটি কাজ দিয়ে। গ্রামবাংলার দর্শকের সেই ‘যোদ্ধা’ এবার হয়ে উঠেছেন শহুরে মানুষেরও প্রিয়। তিনি চিরঞ্জিত। পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা চিরঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়। হালে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইতে মুক্তি পাওয়া সিরিজ ‘নিকষছায়া’য় অভিনয় করে আবার তিনি আলোচনায়। এ সিরিজ দিয়ে তিনি আবার প্রমাণ করলেন নিজেকে। দেখলে হয়তো আপনিও বলবেন, ‘চিরঞ্জিত তাহলে বেঁচেই ছিলেন!’

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে যেমন অনেক বাণিজ্যিক সিনেমা করেছেন, তেমনি ‘বাড়িওয়ালি’, ‘চতুষ্কোণ’-এর মতো ভিন্নধারার ছবিতেও দেখা গেছে চিরঞ্জিতকে। তবে কয়েক বছর ধরে সেভাবে তাঁকে পাওয়া যায়নি। সাক্ষাৎকারে বাংলা সিনেমার প্রসঙ্গে এলেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন। সেই চিরঞ্জিতকে ওটিটির দর্শকের কাছে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

‘নিকষছায়া’য় চিরঞ্জিত। হইচই

গত বছর হইচইতে তিনি ‘নীরেন ভাদুড়ি’ চরিত্রে হাজির করেন চিরঞ্জিতকে। সমালোচকদের কাছে পাত্তা না পেলেও ভয়ের আবহ, সাহিত্যগুণ আর চিরঞ্জিতের অভিনয়ের কারণে দর্শকপ্রিয়তা পায় সিরিজটি। সেই পথ ধরেই আবার পর্দায় ফিরেছেন নীরেন ভাদুড়ি। তাঁকে নির্মিত নতুন সিরিজ ‘নিকষছয়া’ কেমন হলো?

শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। পড়াতেন সংস্কৃত কিন্তু একাডেমিক কৌতূহলে যোগ দেন তন্ত্রের অন্দরে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় ভরপুর বহুবর্ণের জীবন! এই হলেন নীরেন ভাদুড়ি। পশ্চিমবঙ্গে তন্ত্রনির্ভর অনেক লেখালেখি হয়েছে, হালে ইউটিউবে প্রচারিত অডিও স্টোরির কারণে এর অনেকগুলোই জনপ্রিয়ও হয়েছে। তবে অন্য চরিত্রের চেয়ে নীরেন ভাদুড়ি সিরিজটি একটু আলাদা।

‘নিকষছায়া’র দৃশ্য। হইচই

লেখক সৌভিক চক্রবর্তী মনে করেন, তন্ত্রনির্ভর যা লেখালিখি হয়েছে, নীরেন ভাদুড়ি দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীতে। তিনি বিশ্বাস করেন, অলৌকিকেরও লজিক থাকে। তাই এই কাহিনিগুলো হয়ে উঠেছে আদ্যন্ত লজিক্যাল, অলৌকিকের অ্যান্টিথিসিস।

এবার আসা যাক ‘নিকষছায়া’র গল্পে। ‘পর্ণশবরীর শাপ’ সিরিজে পাহাড়ি প্রেক্ষাপটে ভৌতিক গল্প বলেছিলেন পরমব্রত। তবে এবারের প্রেক্ষাপট শহর। সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে আচমকাই উধাও একের পর এক মৃতদেহ। নেপথ্যে কে বা কারা? রহস্য ভেদ করতে মাঠে নামে পুলিশ অফিসার অমিয় (গৌরব চক্রবর্তী)। তবে প্রাথমিক পর্যায়েই বুঝতে পারে যে এই কেস তার নয়।

‘নিকষছায়া’র দৃশ্য। হইচই

এর জন্য প্রয়োজন নীরেন ভাদুড়িকে। তন্ত্র সাধক ভাদুড়ি মশাই অভিযানে নেমেই আবিষ্কার করেন এ কর্মকাণ্ড কোনো সাধারণ তান্ত্রিকের নয়। উধাও হয়ে যাওয়া সব মৃতদেহ শবসাধনায় কাজে লাগিয়েছে কোনো এক কাপালিক। আর সেই শক্তিশালী অঘোরীর মদদের জন্যই শহরে এক পৈশাচিক উৎপাত শুরু হয়েছে। গল্পের মোড় ঘোরে, যখন অমিয় টিমেরই এক পুলিশের মেয়ে বন্যা অপহৃত হয়ে যায়। সেই সূত্র ধরেই তান্ত্রিক ভানুর হদিস পান নীরেন ভাদুড়ি। তার পর?

হ্যালোইন উপলক্ষে গত ৩১ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছিল সিরিজটি। তবে ‘নিকষছায়া’ দেখতে বসলে যে প্রচণ্ড ভয় পাবেন ব্যাপারটা তা নয়, সেটা নির্মাতার উদ্দেশ্যও ছিল না। তিনি বরং ভয়ের একটা আবহ তৈরি করে তন্ত্রনির্ভর সিরিজ উপহার দিতে চেয়েছেন। পিশাচ, ভয়ংকর তান্ত্রিক, ভয়ের কিছু দৃশ্য অবশ্য আছে কিন্তু নিয়মিত এ ধরনের কনটেন্ট দেখা দর্শককে ভয় দেখাতে যথেষ্ট না। তবে অনেক বিচারেরই ‘পর্ণশবরীর শাপ’-এর চেয়ে ‘নিকষছায়া’ ভালো। প্রথম সিজনে চরিত্রগুলোর ঠিকঠাক বিন্যাস, চিত্রনাট্যের দুর্বলতা মিলিয়ে সমালোচিত হয়েছিল। এবার এসব দুর্বলতার দিকে নজর দিয়েছেন নির্মাতা। চেষ্টা করেছেন গল্পটা ঠিকঠাক বলার। সে কারণেই মোটামুটি উতরে গেছে সিরিজটি। পরমব্রত এবার অভিনয়ের দিকেও নজর দিয়েছেন। নীরেন ভাদুড়ি চরিত্রে চিরঞ্জিত যথারীতি দুর্দান্ত। তাঁর কথা বলা, বাচনভঙ্গি, অস্বস্তি প্রকাশ; সব মিলিয়ে মনে হয়েছে তিনি যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা নীরেন ভাদুড়ি। রক্তবর্ণ পোশাক, কপালে তিলক, তেমনই বলিষ্ঠ তান্ত্রিকের ভূমিকায় বাজিমাত করেছেন।

তবে এই সিরিজে নীরেন ভাদুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন কাঞ্চন মল্লিক। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেই দর্শক সাধারণত তাঁকে দেখেছেন, তবে পরমব্রতর সিরিজে অঘোরী তান্ত্রিকের ভূমিকায় চোখ দিয়েই অভিনয়ের ব্যাকরণ শেখালেন কাঞ্চন মল্লিক। নীরেন ভাদুড়ির অ্যাসিস্ট্যান্ট মিতুলের চরিত্রে যেমন সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় অনবদ্য, তেমনই পুলিশ অফিসারের চরিত্রে তুখোড় গৌরব চক্রবর্তী। তবে বিশেষ করে নজর কেড়েছেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়। শৈশবের ট্রমা কীভাবে সারা জীবন একটা মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়, সাবলীল অভিনয়ে সেটাই ফুটিয়ে তুলেছেন অনুজয়। অনিন্দিতা বোসও যথাযথ।

আরও পড়ুন

ছয় পর্বের সিরিজটির আরেকটি ইতিবাচক দিক সিনেমাটোগ্রাফি। আলো-আঁধারির মধ্যে এই সিরিজের কিছু দুর্দান্ত দৃশ্য আছে প্রশংসার দাবিদার। এর আগে নেটফ্লিক্সের সিরিজ ‘আরণ্যক’-এ অভিনয় করেছিলেন পরমব্রত, ‘নিকষছায়া’ নির্মাণে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ছয় পর্বের সিরিজটির বেশ কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। গল্পের কিছু সাবপ্লট বুদ্ধিদীপ্তভাবে তুলে ধরতে পারেননি নির্মাতা, মূল ঘটনা নিয়ে কিছু ক্লু ছেড়ে গেলেও সেটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তবে ‘নিকষছায়া’র দ্বিতীয় পর্ব আসবে। সেখানে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে।