অদৃশ্য: আনিস অপহৃত হওয়ার পেছনে শুধুই রাজনীতি নাকি অন্য কিছু
ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—‘অদৃশ্য’ সিরিজে সবই হাজির করেছেন নির্মাতা শাফায়েত মনসুর রানা।
বিরোধী দল বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি পার্টি থেকে নির্বাচনী টিকিট পাওয়ার পরপরই অপহৃত হন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ (মাহফুজ আহমেদ)। চোখ থেকে কালো পর্দা সরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেন এক পরিত্যক্ত ঘরে। ঘরের দরজা, জানালা বাইরে থেকে বন্ধ। দেয়ালজুড়ে মাকড়শার জাল, কালিঝুলি; চৌকিতে পাতা পুরোনো তোশক।
ঘরের কোণে সিসিটিভি ক্যামেরা আর টিভি। একটা বেসিন, ছোপ ছোপ দাগভর্তি আয়না। আয়নার সামনে কেতাদুরস্ত আনিসের চেহারা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে। দরজার তলার ফোকর দিয়ে তিন বেলা ভালো–মন্দ খাবার আসে, কখনো খামে বার্তাও আসে।
তাঁকে কারা, কেনই–বা অপহরণ করেছে; তিনি এই মুহূর্তে কোথায় আছেন—কূলকিনারা করতে পারেন না আনিস; পারেন না দর্শকেরাও। সময় গড়াতে থাকে আর আনিসের অন্তর্ধান-রহস্য ঘোঁট পাকাতে থাকে।
সিরিজজুড়ে একের পর এক প্রশ্ন উসকে দিয়েছেন নির্মাতা শাফায়েত মনসুর রানা। আমাদের সমাজবিজ্ঞান নির্মাতা শাফায়েতের নির্মাণে বরাবরই সময়ের ছাপ থাকে, এবার হালের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ফ্রেমবন্দী করলেন। ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—এক সিরিজে সবই হাজির করেছেন শাফায়েত।
হলিউডে কিংবা কাছেপিঠে বলিউডে, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমায় হামেশায় রাজনীতিকে পাওয়া যায়। তবে হালের বাংলাদেশের সিনেমা-সিরিজে রাজনীতি নেই বললেই চলে।
তবে ঢাকাই সিনেমায় রাজনীতি যে একেবারেই ছিল না, ব্যাপারটা এমনও না। আশি-নব্বইয়ের দশকে বহু সিনেমায় রাজনীতির ছাপ দেখা গেছে। তবে ধীরে ধীরে কমতে কমতে পর্দা থেকে রাজনীতি প্রায় ‘নাই’ হয়ে গেছে। প্রায় হারাতে বসা রাজনৈতিক থ্রিলারকে পর্দায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই ও হইচই। দৃশ্যের পর দৃশ্যে এই সময়ের রাজনীতির চালচরিত্র রচনা করলেন নির্মাতা শাফায়াত।
শুধুই রাজনীতি নাকি অন্য কিছু
আর দশজন মানুষের মতো সাধারণ কেউ নন, আনিস আহমেদ একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তাঁকে ‘বিজনেস আইকন’ অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল জনতার কাতার পার্টি (জেকেবি)। আনিসের জন্য জেকেবির দুয়ার খোলা ছিল। তবে আনিস ‘বাঘের রাজ্যে বিড়াল হতে’ চাননি, ‘বিড়ালের রাজ্যে বাঘ’ হতে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি পার্টিতে। ফরিদগঞ্জ–২ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার পরপরই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়।
আনিসের অন্তর্ধান রহস্যের পেছনে ঘুরেফিরে রাজনীতিই সামনে এসেছে। প্রাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা অপহৃত আনিসকে নিয়ে রাজনৈতিক চাল চালতে থাকেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা।
ক্ষমতাসীন দল জেকেবির অভিযোগ, আনিস আহমেদ নিজেই আত্মগোপনে আছেন; এর পেছনে বিরোধী দলের হাত রয়েছে। বিরোধী দল বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি পার্টির অভিযোগের জেকেবির দিকে। প্রতিশ্রুতি পার্টির নেতা আজাদ (সুমন আনোয়ার) এক সভায় বলছেন, ‘আনিস সাহেবকে কারা তুলে নিয়ে গেছে আপনারা জানেন। তাঁদের নাম বলব না, নাম বললে চাকরি থাকবে না।’ এরপর যথারীতি মোনাজাত ধরা হয়।
‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’–এর মতো হালের রাজনীতিতে আলোচিত কিছু দৃশ্য ও সংলাপের জুতসই ব্যবহার করেছেন শাফায়েত। এই সময়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ানো স্লোগান ‘খেলা হবে’ থেকে মধ্যরাতে টেবিল চাপড়ানো রাজনৈতিক টক শো—সবই ছিল সিরিজজুড়ে। টিভি স্ক্রলে দেখানো সংবাদ শিরোনামগুলোও বুদ্ধিদীপ্ত ছিল।
প্রশ্ন উঠেছে, আনিসের অন্তর্ধানের পেছনে কি শুধুই রাজনীতি? নাকি এর বাইরে কেউ রয়েছেন? — আনিস আহমেদের বখে যাওয়া পুত্র রাকিন (পার্থ শেখ), ঈর্ষাকাতর ব্যবসায়িক অংশীদার (শাহাদাত হোসেন), আনিসের কবিতার অনুরাগী সোনিয়া (নিশাত প্রিয়ম) কিংবা আনিসের স্ত্রী রিজওয়ানা আহমেদ (অপি করিম)—এদের মধ্যে কারও হাত থাকতে পারে? নাকি সেই রাজনীতিই? —প্রথম মৌসুমে খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও তা জট খোলার জন্য যথেষ্ট নয়। সিরিজের দ্বিতীয় মৌসুমে খোলাসা করা হতে পারে।
আনিস আহমদকে কেন্দ্র করে সিরিজের গল্প আবর্তিত হলেও সমান্তরালে আরও কিছু বিষয়ে আলো ফেলা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে মতপ্রকাশের দায়ে এক তরুণকে তুলে নেওয়ার ঘটনা দেখানো হয়েছে। হালের কোনো নির্মাণে এমন দৃশ্য পাওয়া যায়নি বলেই চলে। তিন বছরেও সেই তরুণের খোঁজ না পাওয়ায় ‘নিখোঁজে খোঁজে’ নামের একটি সংগঠন করেন তাঁর মা আনোয়ারা (তানিয়া আহমেদ)।
সংগঠনের ব্যানারে নিখোঁজ বাবা কিংবা সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে সন্তান ও বাবা–মায়েদের আর্তনাদের দৃশ্য দর্শকদের ছুঁয়ে গেছে। এর বিপরীতে বাবাকে নিখোঁজ দাবি করে ফেসবুক লাইভে এক তরুণীর নাটুকেপনাকেও তুলে ধরেছেন নির্মাতা।
নির্মাণের সঙ্গে চিত্রনাট্য ও সংলাপেও যথেষ্ট যত্নের ছাপ রেখেছেন শাফায়েত মনসুর। ‘ইংরেজিতে যেহেতু বলছেন, ঠিকই বলছেন’—সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত সংলাপটি জুতসইভাবেই টুকেছেন। আবার একটি টিভি টকশোর আলোচিত এক প্রশ্নও তুলে এনেছেন।
চিত্রনাট্য আর নির্মাণের বাইরে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন মাহফুজ আহমেদ, অপি করিমরা। পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন শিল্পীরা। চরিত্রের উত্থান-পতনের সঙ্গে নিমগ্ন ছিলেন মাহফুজ। রিজওয়ানা আহমেদ চরিত্রে সুবাস ছড়িয়েছেন অপি করিম, সাবলীল অভিনয় করেছেন তিনি। এর বাইরে রাকিন চরিত্রে তরুণ অভিনেতা পার্থ শেখের অভিনয় আলাদাভাবে নজরে পড়েছে।
তারকাবহুল এই সিরিজে আনিসের ব্যবসায়িক অংশীদার চরিত্রে শাহাদাত হোসেন, জেকেবির নেতা শহীদুজ্জামান সেলিম, বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি পার্টির চেয়ারপারসন আমেনা চরিত্রে শম্পা রেজা, প্রতিশ্রুতি পার্টির নেতা সুমন আনোয়ার, ‘নিখোঁজের খোঁজে’ সংগঠনের নেত্রী আনোয়ারা চরিত্রে তানিয়া আহমেদ, সাংবাদিক চরিত্রে আহমেদ রুবেল, আনিসের কবিতার অনুরাগী সোনিয়া চরিত্রে নিশাত প্রিয়ম—নিজ নিজ চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা।
আবহসংগীতকে নিয়ে বলতেই হয়, কিছু দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছে আবহসংগীত। আট পর্বের এই সিরিজের শেষ দুইটা পর্ব ছিল জমজমাট। তবে প্রথম দুই পর্ব খানিকটা ধীরগতির ছিল। কিছু দৃশ্যও ছেঁটে ফেলা গেলে সিরিজটি আরও আঁটসাঁট হতে পারত।
এক নজরে
অদৃশ্য
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান: আলফা আই
মুক্তি: ৫ অক্টোবর, হইচই
নির্মাতা: শাফায়েত মনসুর
অভিনয়ে: মাহফুজ আহমেদ, অপি করিম, পার্থ শেখ, শম্পা রেজা, শহীদুজ্জামান সেলিম, আহমেদ রুবেল, তানিয়া আহমেদ, সুমন আনোয়ার, শাহাদাত হোসেন, নিশাত প্রিয়ম প্রমুখ।