পেয়ারার সুবাসে মন মাতোয়ারা
দেখব দেখব করেও সিনেমা হলে গিয়ে দেখা হয় নাই। তত দিনে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে। সেই সুবাদে ঘরে বসেই দেখা হয়ে গেল নির্মাতা নুরুল আলম আতিকের সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’। ছোটবেলা থেকেই অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখতাম তাঁর কাজ এবং সম্ভবত সব কটি বা বেশির ভাগই দেখা হয়েছে আমার। তবে এ-ও বলে রাখি, সব যে বুঝেছি তখন তা নয়, কিন্তু না বুঝলেও ভালো লাগত। তাঁর কাজ অন্য রকম লাগত। এবারেও যে বুঝেছি, তা নয়। সিনেমাটা বোঝার জন্য এবার গুগল ও বইপত্র ঘেঁটেছি। ঘাঁটাঘাঁটির পর মনে হলো, এবার যা বুঝলাম, এটা নিয়েই একটা কিছু লেখা যাক। পাঠক ও সিনেমাবোদ্ধারা আমার বোঝার ভুল শুধরে দেবেন নিশ্চয়ই।
এখন বলি, কেন এই সিনেমা নিয়ে আমি এত আগ্রহী হলাম। উত্তর খুব সোজা আবার কঠিন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই সিনেমা সম্পূর্ণই একটা বাংলাদেশের সিনেমা হয়েছে, যেখানে এই জনপদের অনেক গল্পকাহিনি ও এই ভূমণ্ডলের প্রাকৃতিক নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে। মানে, বাংলাদেশের একটা বিশেষ অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক পটভূমি, আবহাওয়া, সেই অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা, পেশা, লোকাচার, প্রযুক্তির ব্যবহার, খাবারদাবার, বিশ্বাস, ভক্তি, স্বভাব, কাম-প্রেম, উপকথার নানা উপাদান দিয়ে সিনেমাটি সাজানো হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সিনেমা হিসেবে একে আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আর উত্তরটা কঠিন এই কারণে, এই সিনেমার গল্প বলার ধরন, দৃশ্যায়ন, সংলাপ, ফটোগ্রাফিক ইমেজ—সব মিলিয়ে যে পরিবেশনা, সেটা আমার খুব ভালো লেগেছে, এই ভালো লাগার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সিনেমাটা শুরু হয় একটি বন্যাকবলিত গ্রামের ভেতরে একটা রেলগাড়ির প্রবেশের মধ্য দিয়ে। ট্রেন চলতে চলতে ফ্রেমটা বড় হয়, ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও প্রবেশ করি জলমগ্ন একটি গ্রামের ভেতর। দৃশ্য পাল্টালে আমরা গাজী রাকায়েতের কণ্ঠে শুনি গ্রামবাংলার লোকজ ধারণায় এই পৃথিবীর জন্মের কথা। যে বুড়ো কচ্ছপ দুনিয়াটাকে পিঠে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজ এত দূর এল—দৃশ্যায়নে সেই কচ্ছপের অবয়ব আর কুণ্ডলী পাকানো বরফের ধোঁয়া কেমন এক কাব্যময়তার জন্ম দেয়। পালাকার তারপর গানের সুরে সুরে বলেন এক রূপবতী কন্যার কথা, আর তখন ফ্রেমে দেখতে থাকি এক যুবতী মাটির পুতুল। এই দেশে মেয়েরা তো অন্যের হাতের পুতুলই। অন্যের ইচ্ছায় নড়েচড়ে, ঘর পাল্টায় আর জীবন্মৃত হয়ে সারা জীবন পার করেও দেয়। আবার অনেকে হয়তো কৌশল অবলম্বন করে বেঁচে থাকে এবং মুক্তি লাভের জন্য পাঁয়তারা করতে থাকে। পেয়ারা এমনই এক মেয়ে।
বিপত্নীক আয়নাল মুন্সি বিয়ে করে আনে যুবতী পেয়ারাকে। বিয়ের প্রথম দিনেই পেয়ারা বুঝতে পারে, তাকে মিথ্যা বলে এক বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দেয় তার মামারা। ঘরবাড়ির দৈন্যদশা, বাসর ঘরে রাখা কাঠের কফিন বাক্স। ভয় পায় পেয়ারা। ঘটনা আরও ঘনীভূত হয়, যখন মুন্সির মেয়ে বাড়ি ফিরে দেখে তার নতুন মাকে। মেয়ে আসমা এ সত্য মেনে নিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। পেয়ারা দরজার ফাঁক গলে এ দৃশ্য দেখে বলে ওঠে, ‘এই মাইয়া, ফিট খাওনের অ্যাক্টিং ভালো হইসে।’ ওদিকে সকাল থেকেই মুন্সির মেয়ে ফোনে খবর লাগায় গোখরো বা কালসাপের। বিষ দাঁতওয়ালা সাপ দিয়ে এবার শিক্ষা দেবে নতুন বউকে। সিনেমার প্রথম ১০ মিনিটেই ঘটে যায় এসব।
নির্মাতা আতিক বলেন, এ সিনেমায় ‘গন্ধ হলো ট্রিগার পয়েন্ট’( সূত্র: প্রথম আলো)।
আমরা দেখি, মুন্সির ঘর্মাক্ত শরীরের কটু গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে পেয়ারার। একসময় পাকা কাঁঠাল খুবলে ভেতর থেকে কোয়া বের করে এনে পেয়ারাকে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পেয়ারার গন্ধবিষয়ক এই সংবেদনশীলতাকে পিষে ফেলতে চায় মুন্সি। পেয়ারার বমি আসার উপক্রম হয়। রাগে গজরায় মুন্সি। ঘরে জিইয়ে রাখা জিয়ল মাছের হাঁড়ি তুলে আছাড় দিয়ে ভাঙে। ঘরময় কিলবিল করে কালো মিশমিশে শিং মাছ আর আমাদের নাকে এসে লাগে মাছের আঁশটে গন্ধ। নীরবে পুড়তে থাকে আগরবাতি। দুর্গন্ধের বিপরীতে সুগন্ধযুক্ত পৃথিবী অধরাই থেকে যায় পেয়ারার কাছে।
‘পেয়ারার সুবাস’ এই শিরোনামের নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘দ্য সেন্ট অব সিন’, যা বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘পাপের গন্ধ’। তার মানে কি পাপের গন্ধ একরকম আর পুণ্যের আরেক রকম? বা পুণ্য সুবাস ছড়ায় আর পাপ ছড়ায় দুর্গন্ধ? আমাদের মনের ভাবনাটা তো এ রকমই। দুর্গন্ধকে আমরা ঘৃণা করি, আর সুগন্ধকে কাছে টানি, ভালোবাসি। গন্ধের এমন কারবার আছে সিনেমার অনেকাংশেই। নির্মাতা আতিক আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘বিপরীত লিঙ্গের যাদের প্রাণ আছে, তারা ঘ্রাণ থেকে জোড়া বাঁধে’ ( সূত্র: প্রথম আলো)।
যে কথা শুরুতে বলছিলাম, এই অঞ্চলের মানুষের জীবন, আচার-আচরণ তো একদিনে গড়ে ওঠেনি, যুগ যুগ ধরে নানা কিছু দিয়েই হয়েছে প্রভাবিত। মনসা দেবীর পূজা-অর্চনা, মনসার ঘট, মহাভারতের শকুন্তলার মূর্তি, বেহুলার ভাসান, তাবিজকবচ— এমন নানা উপাদানের ব্যবহার করে নির্মাতা আতিক বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের একটা ইঙ্গিত দেন। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে হয় মনসাঘট পূজা। আমরা বুঝি এখন শ্রাবণ শেষে আষাঢ় মাস। বাংলার জলবায়ু অনুযায়ী, এখন প্রবল বর্ষণের সময়। এই বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে এই অঞ্চলের মানুষের যে দুর্ভোগ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট, শিশুদের সহজ-সরল আনন্দ, ভরা বর্ষায় বড়দের মন আনচান করা একাকিত্ব—সব মিলিয়েই যে জীবনযাপন, সেই চিত্রের দৃশ্যায়ন দেখা যায়।
মানুষ খাঁচায় পোষে প্রাণী। নিজের মনোরঞ্জনের জন্য খেতে দেয়, ইচ্ছা হলে কোলে বসিয়ে নরম লোমশ গায়ে হাত বুলিয়ে ওম ওম উষ্ণতা নেয়। পেয়ারাও যেন মুন্সির পোষা খরগোশের সঙ্গে উপস্থিত আরেকটি পোষা প্রাণিবিশেষ মাত্র। অপর দিকে হাশেম এমন একটি চরিত্র, যে কবুতর পোষে, কিন্তু তাকে বন্দী করে নয়। তাকে মুক্ত আকাশে প্রাণখুলে উড়তে দিয়ে। ছেড়ে দিলেও যে পাখি মায়া বা ভালোবাসার টানে তার কাছেই ফিরে আসে। মুন্সির সঙ্গে এই চরিত্রের বৈপরীত্য আমরা প্রথমে এভাবেই আবিষ্কার করি। এই ব্যক্তি গলা ছেড়ে গান গায়, গুনগুন করে সুর ভাঁজে সারাক্ষণই। শক্ত কাঠে ফুটিয়ে তোলে ভালোবাসাপূর্ণ নানা রকম নকশা, যে নকশার কোনো মানে বোঝে না ভোগবাদী মুন্সি। আলোর দিক থেকে, খোলা দুয়ার দিয়ে এই চরিত্রের এগিয়ে আসা বোঝায় যে সে একজন উদার, মুক্তমনা মানুষ, যে ভালোবাসতে জানে। মুন্সির মতো যে স্বার্থান্বেষী নয়।
সিনেমায় মেটাফোরের ব্যবহার আছে অনেক, যা দিয়ে নির্মাতা বোঝাতে চেয়েছেন হয়তো আরও অনেক কিছু। সংলাপ দিয়ে সবকিছু না বলে দিয়েও বা সংলাপ দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন অনেক কিছু, অনেক কিছু না দেখিয়ে দিয়েও। তাই সিনেমাটা অনেক মনোযোগ দিয়েই দেখতে হয়। সিনেমার আবহ সংগীত, কস্টিউম, রূপসজ্জায় যাঁরা ছিলেন, সবাই মন দিয়েই কাজ করেছেন। তবে গল্পটা যে খুব আহামরি কোনো গল্প, তা আমার মনে হয়নি।
কিন্তু গল্পের পরতে পরতে তিনি এমন সব উপাদান জুড়ে দিয়েছেন যে সাধারণ গল্পটিও তখন অসাধারণ হয়ে উঠেছে। রূপসজ্জার নানা প্রলেপ দিয়ে অভিনেতার ত্বকের বলিরেখা আর পোড়া দাগকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা না করে, বরং জীবনের ফাঁকফোকরসহ জীবন যে রকম, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের বাইরের অবয়বের নিচে মনের অন্ধকার জগতে খেলা করে লোভ, ধোঁকাবাজি, আধিপত্য স্থাপনের বাসনা, মুক্তিকামিতা । শামুকের শ্লথ গতির মতো, কিংবা দেয়াল বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা চুইয়ে পড়ার মতো মানুষের মনেও তিরতির করে কাম, বাসনা। মরে পচে যাওয়া খরগোশের গায়ে জন্ম নেওয়া পোকার মতোই মনে কিলবিল করে শয়তানি, নোংরামি।
আয়নাল মুন্সি, পেয়ারা, সরলা, হাশেম, আসমা— এসব প্রধান চরিত্রের পাশে সমান্তরালে অনেক চরিত্রের গল্পও দেখতে পাই আমরা। পার্শ্বচরিত্র বাটুল, ওয়াকিল, পোশাককর্মী মেয়ে দুজন, আসমার স্বামী, সরলার ছেলে—তাদের উপস্থিতি শুধু মূল গল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নয়, বরং তাদের চরিত্রগুলোও পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসেবেই স্থান পেয়েছে। লিবিডো বা যৌনাকাঙ্ক্ষা কীভাবে মানুষের গন্তব্য নির্ধারণ করে, এই সিনেমায় সেটাও দেখতে পাই আমরা।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই, যেটির নাম ‘পেয়ারার সুবাস’, ইংরেজিতে ‘ফ্র্যাগরেন্স অব গুয়াভা’। সেখান থেকে সিনেমার নাম ধার করা হয়েছে বলে টাইটেলে ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। তবু মার্কেসের বর্ণনার দু-একটি উপাদানের দৃশ্যায়ন যে এখানে দেখা যায় না, তা নয়। এই বইয়ের মধ্যে গ্রামের ভেতর রেলগাড়ির প্রবেশ, বরফ দেওয়া মাছের বাক্স থেকে কুণ্ডলী পাকানো ঠান্ডা ধোঁয়ার দৃশ্য ইত্যাদি দৃশ্যকল্প নিশ্চয়ই নির্মাতাকে আকৃষ্ট করেছিল। তবে নির্মাতা আতিক মার্কেসের মতোই জাদুবাস্তবতা (অবিশ্বাস্য বাস্তব) বা অলৌকিকতা দিয়ে আচ্ছন্ন বা অনুপ্রাণিত সেটা তার আগের কাজগুলো দেখেও জেনেছি (যেমন বিকল পাখির গান, চতুর্থমাত্রা ইত্যাদি)। মার্কেস যেমন বলেন, ‘স্বপ্ন, কল্পনা—এসব তো মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’-এও স্বপ্ন বা কল্পনার উপস্থিতি দেখতে পাই।
১ ঘণ্টা ৩১ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রের গাঁথুনি বড় টানটান, শক্তপোক্ত। প্রথম ১০ মিনিটেই এস্টাবলিশ করে ফেলেছেন প্রোটাগনিস্ট, অ্যান্টাগনিস্ট আর তাদের ভেতরের দ্বন্দ্বকে। অ্যান্টাগনিস্ট আয়নাল মুন্সির জীবনযাপন, তার বসবাস, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডল ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পেয়ে যায় দর্শকেরা এই সময়েই, যাদের পরবর্তী পরিণতিগুলো দেখতে দর্শক অবচেতনেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। চিত্রনাট্যের কাঠামোগত নিয়ম মেনে সিনেমার ঠিক মধ্য সময়ে আবির্ভাব হয় হাশেমের, যা গল্পে নতুন টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টি করে। সিনেমার সমাপ্তি পর্যায়ের ক্লাইম্যাকটিক মোমেন্টে মুন্সি আর হাশেমের চূড়ান্ত মুখাপেক্ষিতা ও একজনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে গল্পের সমাপ্তি ঘটে।
বলাই বাহুল্য, মুন্সি, পেয়ারা, সরলা, হাশেম, আসমা—এই প্রধান চরিত্র রূপদানকারী অভিনেতারা যথাক্রমে তারিক আনাম খান, জয়া আহসান, দিহান, আহমেদ রুবেল, সুষমা সরকার প্রত্যেকেই ছিলেন অনবদ্য। সরলা চরিত্রের কণ্ঠাভিনয়ে শর্মীমালাও ছিলেন দুর্দান্ত। এ ছাড়া অন্য চরিত্রগুলোয় যাঁরা অভিনয় করেছেন, প্রত্যেকের অভিনয়ই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। সরলা চরিত্রটিও অনেক আকর্ষণীয় একটি চরিত্র। ‘অপরিমিত যৌবনের অধিকারী’ সরলা আধিপত্য, অধিকার, প্রেম—সব হারিয়ে ও প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে নিঃস্বই মনে করে একসময়।
ছোট পর্দায় আর বড় পর্দায় সিনেমা দেখার পার্থক্য আছে অনেক—এ আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। এখন মনে হচ্ছে, সিনেমা হলে গিয়ে কেন তখন দেখলাম না! ছোট পর্দায় অনেক কিছুই দেখা হয়ে ওঠে না।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি সাবস্ক্রাইব করে দেখে নিতে পারেন, যাঁরা এখনো দেখার সুযোগ করতে পারেননি। আপনারা আমার লেখার সঙ্গে আপনাদের অভিজ্ঞতার মিল বা অমিল খুঁজে পাবেন নিশ্চয়ই। তবে এই সিনেমা সব দর্শকের ভালো যে লাগবে না, এটাও হলফ করে বলতে পারি আমি।
লেখা: ইভা আফরোজ খান (থিয়েটারকর্মী ও চলচ্চিত্র শিক্ষানবিশ)